প্রসঙ্গ বই, ই-বই, মেধাস্বত্ব

আনিসুর রহমান
Published : 23 April 2020, 10:58 AM
Updated : 23 April 2020, 10:58 AM

২৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক বই ও মেধাস্বত্ব দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর জাতিসংঘ দুনিয়াব্যাপী পঠন, প্রকাশনা আর মেধাস্বত্বের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্যে দিনটি উদযাপন করে থাকে। দিনটি ঘিরে দুনিয়ার শহরে শহরে উৎসব সেমিনার শোভাযাত্রা, বই ও পঠনকেন্দ্রিক আলোচনা বিতর্ক কত কী আয়োজন করা হয়ে থাকে। এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। মহামারীর ধাক্কায় দুনিয়ার মানুষের জীবন ও যাপন অনেকাংশে তছনছ হয়ে গেছে। বাদ যায়নি বইয়ের জগতও।

থেমে গেছে লেখকদের রোজগারের পথ; লালবাতি জ্বলেছে বইয়ের দোকানে। গ্রন্থাগারও রেহাই পায়নি দরজা বন্ধ রাখার হুকুমাত থেকে। প্রকাশক, সম্পাদকদের কর্মযজ্ঞ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। স্থগিত হয়ে গেছে বইকেন্দ্রিক নানা উৎসব, অনুষ্ঠান এবং মেলা। এরকম তছনছ মুহূর্তেও ভাল খবর নিয়ে এসেছে বইয়ের বিপণন এর জন্যে ই-বাণিজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আমাজন। প্রতিষ্ঠানটি একলক্ষ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি করোনাভাইরাসের অতিমারীর ধাক্কা সামাল দিতে অঞ্চলভিত্তিক কর্মীদের বেতন বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছে।

দুনিয়ার তাবৎ চাকরির বাজার যখন সংকুচিত তখন আমাজনের অবস্থা ঠিক উল্টো হল কিভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এ লেখার শেষের দিকে আলোকপাত করব। এই পর্যায়ে মেধাস্বত্ব বিষয়ে আলোচনা করতে চাই।

বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রণীত এবং ২০০৫ সালে সংশোধিত কপিরাইট আইন ২০০১ নামে একটি আইন রয়েছে। আইনে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির স্বত্বের বিষয়ে বিশদ বলা থাকলেও তার প্রয়োগ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। বই, গান, ছবি, ভিডিও হরহামেশাই কোনো রকম আর্থিক মূল্য পরিশোধ না করে, অনুমতি না নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পর্যন্তও দেয়া হয় না। এমনকি মূলধারার গণমাধ্যমও ছবি বা লেখার সূত্র উল্লেখ না করে দেদারছে ব্যবহার করে যাচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে বড় বড় প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষও একই কাজ করে থাকে। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের রাজস্ব কর্তৃপক্ষ রাজধানীর একটি বিলবোর্ডে অনুমতি না নিয়েই কবি নির্মলেন্দু গুণের ছবি আর একটি উক্তি ব্যবহার করেছিল। বিষয়টি কবির গোচরে এলে তিনি রাজস্ব কর্তৃপক্ষকে তার ছবি ব্যবহারের জন্যে প্রাপ্য টাকা দিতে অনেকটা বাধ্য করেছিলেন। এমনকি ঐ ছবির আলোকচিত্রীর প্রাপ্য টাকাটাও আদায় করে দিয়েছিলেন।

এবার বইয়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসার আগে বাংলাদেশের মেধাস্বত্ব আইনের অধীনে যে সমস্ত জিনিস মেধাস্বত্বের জন্যে নিবন্ধনের আওতাভুক্ত তা উল্লেখ করতে চাই। সাহিত্য, গবেষণাতত্ত্ব, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ডাটাবেজ, মোবাইল অ্যাপস, কম্পিউটার গেইম, সংগীত, রেকর্ড (অডিও-ভিডিও), ই-মেইল, ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া, বেতার ও টেলিভিশন সম্প্রচার, চলচ্চিত্র, নাটক, কার্টুন, অ্যানিমেশান, বিজ্ঞাপন (ভিডিও, অডিও, পোস্টার, বিলবোর্ডসহ অন্যান্য), অনুবাদকর্ম, বাংলা ডাবিংকৃত (বিদেশী চলচ্চিত্র, নাটক, কার্টুন, অ্যানিমেশান), শ্লোগান, থিমসং (Theme Song) ফেসবুক ফ্যান পেইজ (Facebook Fan Page), স্থাপত্য নকশা, চার্ট, ফটোগ্রাফ, স্কেচ, ভাস্কর্য, পেইন্টিংসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম এবং লোক সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি ইত্যাদি।

আমাদের মেধাস্বত্ব আইনে মেধাস্বত্ব নিয়ন্ত্রণের কথা যাই বলা থাকুক তার বাস্তব চিত্র কী? মেধাস্বত্ব নিয়ে আমার কয়েকটি প্রশ্ন:

১)      একটি বই ছাপা হল, প্রকাশক লেখককে জানাল এক হাজার কপি ছাপা হয়েছে। আদতে যদি প্রকাশক পাঁচ হাজার বা দশ হাজার বা আরো বেশি নমুনা ছাপান, সেক্ষেত্রে লেখকের কী করার আছে? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কাটতি অনেক বই বছরের পর বছর প্রথম সংস্করণেই আটকে আছে। একই অবস্থা গান, চলচ্চিত্র আর নাটকের সিডি-ভিসিডির ক্ষেত্রেও।

২)      প্রকাশক বা প্রযোজক কিংবা অন্যান্য প্রত্যক্ষ ব্যবহারীর কাছে বা চুক্তির ক্ষেত্রে মেধার স্বত্বাধিকারী তার প্রাপ্য পাওনা দাবি করার এখতিয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বা প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তার নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টি ব্যবহার হচ্ছে নানাভাবে, নানা রূপে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বা অনুষ্ঠানে, বিবিধ উপলক্ষে, সেক্ষেত্রে মেধাস্বত্বের বিপরীতে পাওনা মিটিয়ে দেবার ব্যবস্থা কী? গ্রন্থাগার থেকে বই ধার নিয়ে হাজার হাজার মানুষ পড়ছে, তাতে মেধাস্বত্বের অধিকারীর প্রাপ্য নির্ধারিত হবে কীভাবে?

৩)      বিভিন্ন বৃহৎ ওয়েবসাইটভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবসা বা নেটওয়ার্ক আমাদের দেশের তথ্য, উপাত্ত, ছবি অডিও-ভিডিও ব্যবহার করে। বিনিময়ে তারা বিজ্ঞাপনসহ নানা উপায়ে রাজস্ব উপার্জন করছে। সেক্ষেত্রে দেশ হিসেবে আমাদের সামগ্রিক প্রাপ্তি কী? আমাদের মেধাস্বত্বের অধিকারীদের তাদের প্রাপ্য বুঝে পাবার উপায় কী?

প্রথম প্রশ্ন নিয়ে আমার বলার কিছু নাই। দ্বিতীয় প্রশ্নের ব্যবহারে অন্যান্য আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশ উল্লেখযোগ্য যে দৃষ্টান্ত রয়েছে তা উল্লেখ করতে চাই।

শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে লেখক সংস্থা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংঘের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। ওই চুক্তির অধীনে শিক্ষা বিভাগ বড় অঙ্কের একটা টাকার তহবিল জোগান দেয়। পেশাজীবী সংঘ ওই তহবিল থেকে লেখকদের মাঝে প্রতিবছর বৃত্তি আকারে সে টাকা বিতরণ করে। শিক্ষা বিভাগ এই অর্থ দিয়ে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত লেখকদের বই ব্যবহারের আর্থিক মূল্য হিসেবে।

একইভাবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দেশব্যাপী গ্রন্থাগার থেকে প্রতিবার প্রতিটি বইয়ের ধারের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ একটি টাকা লেখক তহবিলে পরিশোধ করে। এতে করে বড় অঙ্কের একটা টাকা সরকার লেখক তহবিলে দিয়ে থাকে। এই তহবিল থেকে লেখকরা স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মবৃত্তি এবং ভ্রমণবৃত্তি পেয়ে থাকে। এরকমভাবে সংগীতের জন্যে আলাদা তহবিল জোগানের ব্যবস্থা রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো আমাদের অবস্থা কী? এবার আমাজনের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমাজন করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলাতে উদ্যম আরো বাড়ালো তার কারণ কী? করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে দুনিয়াব্যাপী যখন সামাজিক মেলামেশা এড়ানোর ডাক এসেছে, মানুষ ঘরবন্দী হয়ে গেছে তখন অনলাইনে বিক্রি বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই আমাজন সময় থাকতেই প্রস্তুতি নিয়েছে। যা ছিল যথার্থ।

সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের অনলাইনভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থা কিন্তু ধাক্কাটা ঠিক খেয়েছে। দুই এক জায়গায় বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দিয়েছে- করোনাভাইরাসের এই সময়ে তারা ফরমায়েশ ঠিকই নেবে, তবে জিনিস কখন সরবরাহ দিতে পারবে তার নিশ্চয়তা নাই। এর মানে দাঁড়ালো করোনার ভয়ে, সাবধানতাবশত আমি ঘরে বসে একটা বইয়ের ফরমায়েশ দিলাম, বইটা কবে পাব তার নিশ্চয়তা নাই। করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে ওঠার পরে ই-ব্যবসা বা ই-বিপণন নিয়েও আমাদের নতুন করে আলোচনা শুরু করতে হবে।

ই-বিপণনে কয়েকটা সমস্যাও রয়ে গেছে, যেমন বাংলাদেশে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান অনলাইনে বইয়ের কেনাবেচা করেন তাদের কেউই দেশের বাইরে থেকে ফরমায়েশ নিতে পারেন না। কেননা বাইরে থেকে অনলাইনে পরিশোধের ব্যবস্থা যেমন নাই তেমনি কাগজে ছাপানো বইটির কম সময়ে কম খরচে পাঠানোর তেমন বন্দোবস্তও নাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা এক বড় সমস্যা।

বাংলাদেশের বাইরে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েক কোটি বাংলা ভাষাভাষী পাঠক রয়েছে। সেই বাজারটা ধরতে হলে আমাদের দেশের প্রকাশনা জগতকে কাগজে ছাপানো বইয়ের পাশাপাশি ই-বইয়েও ঝুঁকতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের প্রকাশকই ছাপানো বইয়ের পাশাপাশি ই-বইয়েও বিনিয়োগ করছে। এক্ষেত্রে আমাদের বড় অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা অর্জনের সুযোগ যেমন থাকবে, কর্মসংস্থানও বাড়বে। বিদেশি মুদ্রা অর্জনের নামে শ্রম শোষণভিত্তিক দর্জিশিল্পে আটকে থাকলেই হবে না। করোনভাইরাস পরবর্তী পৃথিবী নতুন দরজা খুলবে। সে দরজা প্রকাশনা জগতেও। ই-বই প্রকাশনায় মেধাস্বত্ব নিয়ন্ত্রণটাও বাস্তবসম্মত হবে। সেখানে পাঁচ হাজার বই ছেপে এক হাজার বলে চালিয়ে দেয়া যাবে না।

বিগত বছরগুলোতে দেশে দেশে সামগ্রিক পাঠ অভ্যাস আর বই বিক্রি নিম্নমুখী হলেও ই-বই পড়ার এবং বিক্রির প্রবণতা ছিল উর্ধ্বগামী। করোনাভাইরাস পরবর্তী পৃথিবীতে ই-বইয়ের প্রসার এবং বাজার আরো বিস্তৃত হবে। সেই বিস্তারে আমাদের লেখক প্রকাশকরা কতটা প্রস্তুত? আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মূলধারার কোনো প্রকাশকই ই-বই প্রকাশে উদ্যোগী হয়নি। আমরা গত একযুগে ডিজিটাল ডিজিটাল করে অনেক কথাই বললাম। কিন্তু আমাদের প্রকাশনা জগত ডিজিটাল তাৎপর্য থেকে এখনও অনেকটা দূরেই রয়ে গেল কেন?

এক যুগ আগে জাপানের আর্থিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের কপিরাইট দফতর লেখক প্রকাশকদের সঙ্গে নিয়ে মেধাস্বত্ব বিষয়ে দুইদিনব্যাপী একটা সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। সে সময় ই-বুক প্রসঙ্গ জোরালো বিষয় হিসেবে সামনে আসেনি। নতুন বাস্তবতায় আমাদের সামনে করোনাভাইরাস পরবর্তী দুনিয়ার প্রকাশনা জগতে ই-বুকের অসন্ন দাপটকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিতে হবে। এজন্যে কপিরাইট দফতর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, লেখক, প্রকাশক, দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে সিম্পোজিয়াম আয়োজন করা যেতে পারে।

নতুন পৃথিবীর নতুন বাস্তবতায় নিজেদের অবস্থান করে নিতে চাইলে ঘরবন্দী তাতে কি; ঘরে বসে ভাবতে আর আলোচনা শুরু করতে তো বাধা নাই।