আফগানিস্তানে তালেবান ও ভবিষ্যতের শঙ্কা!

জি এম আরিফুজ্জামান
Published : 31 August 2021, 07:26 AM
Updated : 31 August 2021, 07:26 AM

"আফগানিস্তান ছেড়েছেন আশরাফ গনি!

আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ দেশটির সংবাদমাধ্যম টোলো নিউজ প্রথম এমন খবর প্রকাশ করেছে৷" (ডি.ডব্লিউ, ১৫ অগাস্ট ২০২১)।

এই ঘটনার সাথে সাথেই রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানদের হাতে চলে যায়। সেদিনই কাতারের দোহায় বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও স্ট্রিমিংয়ে তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার যুদ্ধে বিজয়ের ঘোষণা দেন। এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় তালেবানরা অধিষ্ঠিত না হলেও রাষ্ট্রের সকল কাঠামোয় তাদের প্রভাব এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যে, এটা অনেকটা নিশ্চিত, আগামীতে তালেবান সরকার দেশের ক্ষমতায় আসছে। পাকাপোক্তভাবে প্রেসিডেন্ট ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবানরা। বিমানবন্দর, রাস্তা ঘাট, বিভিন্ন সরকারি ভবন, চেকপয়েন্ট, আফগানিস্তান সীমান্ত সর্বত্র নিরাপত্তার দায়িত্বে দেখা যাচ্ছে তালেবান বাহিনীকে। এমনকি তারা নির্ধারণ করে ফেলেছে আফগানিস্তানের নতুন নাম এবং তাদের আদর্শের সাথে মিল রেখে জাতীয় পতাকা।

দীর্ঘ ২০ বছর পর তালেবানদের এমন উত্থান আফগানিস্তানের নিরাপত্তার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় এবং মানবাধিকারের বিষয়কে নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলছে। তালেবানের এমন উত্থান ভবিষ্যতের জন্য কি বার্তা বয়ে আনতে পারে, সে বিষয়ে আলোকপাতের পূর্বে তালেবানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও তাদের কর্মকাণ্ড বিষয়ে জানাটা জরুরি।

পশতু ভাষায় 'তালেবান' শব্দের অর্থ হচ্ছে 'ছাত্র'। ১৯৯০ দশকের শুরুতে আফগানিস্তান থেকে যখন সোভিয়েত সৈন্যরা পিছু হটে তখনই মূলত উত্তর পাকিস্তানে "তালেবান" নামক আন্দোলনের জন্ম হয়। প্রাথমিক অবস্থায় মাদ্রাসাগুলোকে কেন্দ্র করে এবং সৌদি অর্থে কট্টর সুন্নি মতাদর্শের ইসলাম প্রচারের জন্য তালেবান কাজ করত বলে অনেক বিশ্লেষক জানিয়েছেন। মূলত কঠোর শরিয়া শাসন জারির বিষয়কে লক্ষ্য করে তারা পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান– এই দুই দেশের সীমান্তের দু'দিকেই বিস্তীর্ণ পশতুন অধ্যূষিত অঞ্চলে দ্রুতই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তাদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। আফগানিস্তান থেকে নিজেদের বলয়কে সম্প্রসারিত করে ১৯৯৫ সালে সেপ্টেম্বরে তারা ইরান সীমান্তবর্তী আফগান প্রদেশ হেরাত দখল এবং ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখল করে নেয়। তারা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দীন রাব্বানির সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করে। সোভিয়েতরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মুজাহিদীনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং তাদের অত্যাচারের কারণে সাধারণ জনগণ বুরহানউদ্দীন রাব্বানীর সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে স্বাগত জানায় তালেবানকে। তালেবানরা ১৯৯৮ সাল নাগাদ আফগানিস্তানের প্রায় ৯০ শতাংশ অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। দুর্নীতি দমনে সাফল্য, শান্তিপূর্ণ আইন-শৃঙ্খলা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরাপদ ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ তাদেরকে প্রাথমিক পর্যায়ে জনপ্রিয় করলেও ধীরে ধীরে কঠোর শরিয়া শাসনের অধীনে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, অপরাধীদের প্রকাশ্যে হত্যা করা, চুরির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হাত কেটে নেয়া, পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং মেয়েদের পুরো শরীর ঢাকা বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা, টেলিভিশন, সঙ্গীত এবং সিনেমা নিষিদ্ধ করা এমনকি দশ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই বলে বিভিন্ন কট্টর নিয়ম জারি করার কারণে তারা নিন্দিত হতে থাকে। তাছাড়াও অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান বা উদারতা প্রদর্শনের পরিবর্তে মেতে ওঠে ধ্বংসযজ্ঞে। তার একটি নমুনা, ২০০১ সালে আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলে বিখ্যাত বামিয়ান বুদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করা। এমনকি, বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংসে মত্ত হয়ে উঠেছিল তালেবান। তাদের এমন কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয় এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনভিত্তিক কর্মকাণ্ডকে বন্ধের আহবান জানায় সকলে। তবে তালেবানরা আন্তর্জাতিক মহলের অনুরোধে কর্ণপাত না করে তাদের প্রণীত কঠোর শরিয়া আইনের আলোকে দেশকে পরিচালনা ( শাসনকাল: ১৯৯৬-২০০১ সাল) করতে থাকে।

বিশ্বজুড়ে তালেবানদের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারণা পায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। সেদিন ঘটে যায় আমেরিকার ইতিহাসে ভয়াবহতম সন্ত্রাসী হামলা। নির্মল সকালটা মলিন হয়ে ওঠে ভারী ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে। যা ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে "৯/১১ (নাইন ইলেভেন) হামলা" হিসেবে। চারটি বিমান আঘাত হানে নিউইয়র্কের দুটি আকাশচুম্বী ভবনে, নিহত হয় হাজার হাজার মানুষ।

দুটি বিমান বিধ্বস্ত করা হয় নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ভবনে। প্রথম বিমানটি আঘাত হানে নর্থ টাওয়ারে আমেরিকার পূর্বাঞ্চলীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে। দ্বিতীয় বিমানটি সাউথ টাওয়ারে বিধ্বস্ত করা হয় এর অল্পক্ষণ পর, সকাল ৯টা ৩ মিনিটে। তৃতীয় বিমানটি পেন্টাগনের সদর দপ্তরের পশ্চিম অংশে আঘাত হানে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে। সকাল ১০টা ৩ মিনিটে চতুর্থ বিমানটি আছড়ে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার এক মাঠে। ( বিবিসি বাংলা, ৬ অগাস্ট ২০২১)।

এই হামলার জন্য মার্কিন প্রশাসন এবং তাদের মিত্ররা আফগানিস্তানের ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন উগ্র মতাদর্শের ইসলামপন্থী সংগঠন আল-কায়দাকে দায়ী করে। প্রসঙ্গত, আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন তালেবান সরকারের আশ্রয়ে ছিলেন। ২০০১ সালের আগেও জাতিসংঘ থেকে তালেবান এবং আল কায়েদার কর্মকাণ্ডকে নিন্দা জানিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৫ অক্টোবর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটা প্রস্তাব (প্রস্তাব ১২৬৭) পাস করে তথাকথিত আল-কায়েদা এবং তালেবান নিষেধাজ্ঞা কমিটি গঠন করে। তালেবান এবং আল কায়েদা দুটি গ্রুপকে সন্ত্রাসী সত্তা হিসেবে যুক্ত করে এবং তালেবান সরকারের অর্থায়ন, যাতায়াত এবং অস্ত্রের চালানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নাইন-ইলেভেনের হামলার পর ২০০১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ যুক্তরাষ্ট্রে হামলার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের অনুমোদন সংক্রান্ত একটি যৌথ রেজোলিউশনে অনুমোদিত আইনে স্বাক্ষর করেন। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর ব্রিটিশ সহায়তায় মার্কিন সামরিক বাহিনী "অপারেশন এনডুরিং ফ্রিডম" নামে আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান বাহিনীর বিরুদ্ধে বোমা হামলা শুরু করে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মার্কিনিরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং পতন ঘটে তালেবান সরকারের। যুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর পর ২০১১ সালে মার্কিন সৈন্যরা ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পায় প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে এবং তাকে হত্যা করে। তবে, এতকিছুর পরও তালেবান সর্বদাই তৎপর ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র বাহিনীদের বিরুদ্ধে। চালিয়ে নিয়েছে যুদ্ধ। আফগানিস্তানের পাশাপাশি তালেবানরা পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের অনেক অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। ২০১২ সালের অক্টোবরে পেশাওয়ারে এক স্কুলে হামলা চালিয়ে বহু ছাত্রকে হত্যা করে তালেবানরা। পাকিস্তানের মিনগোরা শহরে স্কুলছাত্রী মালালা ইউসুফজাই যখন বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তাকে গুলি করে তালেবান জঙ্গিরা। দীর্ঘ এক যুগের মাথায় এসেও তালেবানরা যে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধেও দুর্বল হয়ে যায়নি, সেই বার্তা সারা বিশ্বে জানিয়ে দেয়। ২০১৮ সালে তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলোচনা শুরু হয়।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারের রাজধানী দোহায় দুই পক্ষের মধ্যে যে শান্তি চুক্তি হয়, তার শর্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করবে এবং তালেবানরাও আর মার্কিন বাহিনীর ওপর কোন হামলা চালাবে না। চুক্তির আরও শর্তের মধ্যে ছিল তালেবান আর আল কায়েদা কিংবা অন্য কোন জঙ্গী সংগঠনকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আশ্রয় দেবে না এবং আফগান শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাবে। (বিবিসি বাংলা, ৫ অগাস্ট ২০২১)।

এই চুক্তির পরও তালেবান আফগান নিরাপত্তা বাহিনী এবং বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত রাখে। এরই মধ্যে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালের এপ্রিলে ঘোষণা করেন যে, আফগানিস্তানে থাকা সব মার্কিন সেনা ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়বে। এই ঘোষণার পরে তালেবানরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বড় বড় শহর, সামরিক ঘাঁটির দখলের জন্য তারা টার্গেট করে করে হত্যা শুরু করে। তাদের টার্গেট ছিল সাংবাদিক, বিচারক, শান্তির জন্য আন্দোলনকারী এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নারীরাও। প্রতিদিনই তালেবানরা আফগানিস্তানের নানা শহর-বন্দর-গ্রামে হামলা চালায়, দখল করে নেয় আফগান সরকারের সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি। অবশেষে, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তালেবানেরা ২০২১ সালের ১৫ অগাস্ট দীর্ঘ দুই দশক পর পুনরায় কাবুল এবং প্রেসিডেন্ট ভবনের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে।

দীর্ঘ দুই দশক পরে তালেবানদের কাবুল দখল এবং স্বঘোষিত বিজয়ের ফলে ভবিষ্যতে অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তৈরি হয়েছে অস্পষ্টতা এবং শঙ্কা।

অভ্যন্তরীণ শঙ্কা

আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ শঙ্কায় বিষয়ে বিস্তারি যাওয়ার পূর্বেই একটি চিত্র বিষয়টি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দিতে পারে। তালেবানরা কাবুল দখলের পর হাজার হাজার মানুষ নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আশ্রয় নেয়। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কীভাবে মানুষ বিমানের মধ্যে উঠে পড়ছে। এমনকি বিমানের ছাদে, চাকায়, পাখার ওপরেও মানুষকে দেখা গেছে। বিমানটি চলতে শুরু করার পরে কয়েকজনকে পড়ে যেতে দেখা যায়। অনেক মানুষের প্রানহানি ঘটে। বিমানবন্দরে মানুষের আশ্রয় নেয়ার পরে সেখানেও তালেবান বাহিনী হামলা চালিয়েছে। ফলে মৃত্যু এবং আতঙ্কের মধ্যে পার হচ্ছে সময়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়, কীভাবে দেয়াল টপকিয়ে, এমনকি ছোট ছোট বাচ্চাদের ছুড়ে দেয়ালের এক পাশ থেকে অন্য পাশে পার করা হচ্ছে। একটি ছবিতে দেখা যায়, মা বাবা হারিয়ে একটি বাচ্চার আহজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে বিমানবন্দরের পরিবেশ। এমন আশঙ্কার মধ্যে হাজার হাজার মানুষ দিন পার করছে।

কাবুলসহ বিভিন্ন দখলকৃত এলাকায় প্রত্যেকদিন বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এতে আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছে সাধারণ জনগণ। তালেবানের প্রতিনিধিরা "সাধারণ ক্ষমা" ঘোষণা এবং সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ের কর্মচারীদের কাজে যোগদানের কথা বললেও সেই বিষয়ে রয়েছে চরম দ্বিধা। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে এই ধরনের ঘোষণা মুখরোচক হলেও বাস্তবে তালেবান বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সাথে রয়েছে অনেক অমিল। গোপনে তালেবান বাহিনী স্বরূপে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করছে, যেন তালেবান বাহিনীর আমানবিক কর্মকাণ্ড মিডিয়ায় প্রকাশ না পায়, সেই বিষয়ে তারা খুবই সচেষ্ট। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতে সে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজে যোগদানের বিষয়ে নানা শ্রেণির মানুষের মাঝে রয়েছে অনিশ্চয়তা।

মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি বিষয় খুব সামনে আসছে নারী অধিকার বিষয়। নারীদের কণ্ঠকে রোধ করার এবং তাদের প্রতি অমানবিক আচরণের বিষয়টি তাদের ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামলে সারা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে। এমন আশঙ্কার মধ্যে নারীদের কাজে যোগদান, শিক্ষা, ব্যবসার মতো বিষয়গুলোতে দেখা গিয়েছে অনিশ্চয়তা। তালেবান সরকার যদিও নারীদের কাজ, শিক্ষাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে হিজাব মেনে এবং শরিয়া সম্মতভাবে চালানোর কথা বলছে। কিন্তু, পূর্বের তালেবান সরকারের নারীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের কারণে এর ওপর আস্থা রাখা অনেকটা শঙ্কায় পরিণত হয়েছে। শুধু দেশের নারীদেরকে নয়, বিদেশী নারীরাও বাধ্য হচ্ছে তাদের দেয়া বিধান পালন করতে। হয়তো বিদেশীদের উপর বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু তারাও বিভিন্ন শঙ্কায় তালেবানের দেয়া নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করছে। ক্লারিসা ওয়ারড (Clarissa Ward), সিএনএনের চিফ ইন্টারন‌্যাশাল করসপন‌ডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। একটা ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি বোরখা বা হিজাব পরে সংবাদ সংগ্রহ করছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি তালেবানদের বাঁধার সম্মুখীন হন। একজন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকর্মীকে শুধু নারী হবার জন্য যদি এই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়, সেক্ষেত্রে স্থানীয় নারীদের জন্য বিষয়টি কতটা চালেঞ্জিং।

আফগানিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কত দ্রুত সমাধানের দিকে ধাবিত হবে সেই বিষয়টি নিয়ে রয়েছে বিরাট আশঙ্কা। তালেবানরা কাবুল দখলের পর ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে যে, তাদের শাসনবাবস্থা হতে যাচ্ছে "শরিয়া আইন ভিত্তিক", কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নয়, বরং কাউন্সিল সদস্যদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। কোনো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থাকবে না। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে রয়েছে তালেবানদের ঘোর আপত্তি। তারা সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণে আগ্রহী। এই রাজনৈতিক সংকট কীভাবে সমাধান হবে সেটা এখন দেখার বিষয়।

আঞ্চলিক শঙ্কা

আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার একটি অঞ্চল। অনেকে আবার মধ্যপ্রাচ্যের অংশ হিসেবেও গণ্য করে। আফগানিস্তানের পূর্বে ও দক্ষিণে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং উত্তর-পূর্বে গণচীন। আফগানিস্তানের সাথে এই সমস্ত রাষ্ট্রের সীমান্ত থাকলেও আফগানিস্তানের রাজনীতিকে ঘিরে আবর্তিত হয় আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়াদি। আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশেষ করে দেখা যাচ্ছে চীন ও পাকিস্তান অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আফগানিস্তানকে ঘিরে কৌশল নিচ্ছে। তালেবনাদেরকে নিজেদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশে আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখতে চীন এবং পাকিস্তান তৎপর। খবরে প্রকাশ পায়, তালেবানের প্রতিনিধি দল জুলাই মাসে চীন সফরে যায়। চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, শান্তি প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনার হয়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে, চীন তালেবানকে সমর্থন দিচ্ছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণপূর্বক জানা যায়, তালেবানদেরকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সরাসরি মদদ দিয়েছে। তালেবানদের প্রশিক্ষণ, অর্থ ও রসদ সরবরাহ করে নির্বাচিত আফগান সরকারের বিরুদ্ধে তালেবানদের প্রতি পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সমর্থন সবসময় আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। যদিও কৌশলগত কারণে পাকিস্তান তাদের ভূমিকাকে অস্বীকার করে আসছে। তবে, এখন অনেকটা স্পষ্ট তালেবানদের বিজয়ে পাকিস্তান অনেক ফায়দা নিতে চাইবে।

অপরদিকে, ভারত তালেবানের উত্থানে অনেকটাই শঙ্কিত। আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে গত দুই দশকে চারশোরও বেশি সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং বড় বড় কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ডজন ডজন প্রকল্প ছাড়াও, দিলারাম-জারাঞ্জ মহাসড়ক নামে ২১৮ কিমি দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক তৈরি করে দিয়েছে ভারত। কাবুলে নতুন আফগান পার্লামেন্ট ভবনটিও তৈরি করেছে তারা। (বিবিসি বাংলা, ১৩ জুলাই ২০২১)। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতীয় কাশ্মীর অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে তালেবানকে ব্যবহার করতে পারে পাকিস্তান এবং চীন। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে এবং লাদাখ নিয়ে চীনের সাথে দ্বন্দ্ব রয়েছে ভারতের। অতীতে আফগানিস্তান থেকে মুজাহিদীনরা কাশ্মীরে তৎপরতা দেখিয়েছে। তালেবানরা ক্ষমতায় থাকলে তার পুনরাবৃত্তি হয় কিনা, সেটা ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি, তালেবানের উত্থান ভারতের মধ্যে জঙ্গিবাদ ও উগ্রপন্থীদের উত্থান ঘটাতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষকই আশঙ্কা করেছেন।

আফগানিস্তানের পশ্চিম সীমান্তজুড়ে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানের সাথে তালেবানের সম্পর্ক কেমন হবে সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও এটা বলা যেতে পারে, মার্কিনবিরোধী নীতিতে ইরান তালেবানদের ব্যবহারের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

বাংলাদেশের সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত না থাকলেও আফগানিস্তানের পরিস্তিতির ওপর সবসময় বাংলাদেশকে নজর রাখতে হয়। বিভিন্ন সময় জঙ্গিবাদ এবং উগ্রবাদের মদদের সাথে আফগানিস্তানের তালেবান, আল কায়েদার নাম ঘুরেফিরে এসেছে। এটাও মনে করা হয়, বাংলাদেশ থেকে অনেক তরুণ আফগানিস্তানে তালেবানদের সাথে যুদ্ধের জন্য দেশত্যাগ করেছে। তার একটি আভাস পাওয়া যায় গত ১৪ অগাস্ট ২০২১ সালে প্রকাশিত বিবিসির প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বলেন, "আফগানিস্তানে যুদ্ধে যাবার জন্য একটি আহবান জানানো হয়েছে তালেবানদের পক্ষ থেকে। এবং বাংলাদেশ থেকে কিছু মানুষ অলরেডি তালেবানদের সাথে যুদ্ধে যোগদান করার জন্য হিজরত করেছে। কিছু মানুষ আমরা ধারণা করছি যে ইন্ডিয়ায় ধরা পরেছে। আর কিছু পায়ে হেঁটে বিভিন্নভাবে আফগানিস্তানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।" বাংলাদেশ সরকার জঙ্গি এবং উগ্রবাদী মতাদর্শকে দমনের জন্য সর্বদা তৎপর রয়েছে। তবে, এই তালেবানদের উত্থান বাংলাদেশের জন্য কিছুটা হলেও শঙ্কা তৈরি করতে পারে। তালেবানের এমন বিজয় বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় উগ্রবাদীগোষ্ঠীকে উসকে দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক শঙ্কা

দীর্ঘ ২০ বছর ধরে মার্কিন সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে থাকলেও তালেবানদের এমন উত্থানকে অনেক বিশ্লেষক মার্কিনিদের পরাজয় হিসেবে আখ্যায়িত করছে। দু'দশকব্যাপী এই আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারি হিসেব মতে, ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেছে, এতে নিহত হয়েছে তাদের ২,৩১২ জন সৈন্য, জখম হয়েছে ২০ হাজারের বেশি, আফগান সৈন্য ও পুলিশ নিহত হয়েছে আনুমানিক ৬৪,০০০- আর আফগান বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে অন্তত ১১১,০০০। (বিবিসি বাংলা, ১৪ অগাস্ট ২০২১)। দীর্ঘ ২০ বছর অবস্থানের পরেও তালেবানের এমন উত্থান সত্যিই মার্কিন রাজনীতির জন্য একটা লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বিশ্লেষক এই পরাজয়কে ভিয়েতনামের যুদ্ধের পরাজয়ের সাথে তুলনা করেছেন। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের সায়গন থেকে আমেরিকানদেরকে হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, ২০২১ সালে এসে কাবুলেও মার্কিনিদের জন্য একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত দুই দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৮৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে আফগান সেনাবাহিনী তৈরি ও প্রশিক্ষিত করতে। কিন্তু, তালেবানদের হামলার মুখে নিমিষে ভেঙ্গে পড়ে আফগান বাহিনী। তাছাড়াও, গত বিশ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাদেরকে বিশেষ করে অভিজাত সম্প্রদায়দেরকে সুবিধা দিয়েছে তারা বহুধাবিভক্ত, দুর্নীতিপরায়ণ। তালেবানের উত্থানের মুখে তারা সহযোগিতা না করে বরং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে ছিল তৎপর। এটাকেও মার্কিন প্রশাসনের একটা বিরাট ব্যর্থতা হিসেবে অনেক বিশ্লেষক অভিমত দিয়েছেন। যদি জো বাইডেনের সরকার এটা মানতে নারাজ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, "আরো এক বছর বা পাঁচ বছরও যদি মার্কিন সেনা যদি আফগানিস্তানে থাকতো, তাহলেও কোনো ফারাক হতো না। আফগান সেনাই নিজের দেশকে রক্ষা করতে পারল না। অন্য দেশের অসামরিক বিরোধ মেটাতে অ্যামেরিকার সেনা অনন্তকাল ধরে সেখানে থাকবে এটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।" (ডি.ডব্লিউ, ১৬ অগাস্ট ২০২১)। তবে, এমন বক্তব্য যে তাদের পরাজয়ের সান্ত্বনা মাত্র। এদিকে তালেবানের বিষয়ে চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক তাদের সমর্থনের ইঙ্গিত দিয়েছে এবং তালেবান সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তালেবান প্রতিনিধি দল সর্বশেষ রাশিয়াও সফর করে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের আধিপত্য হারাবে এবং নতুনভাবে বিশ্ব শাসনের দায়িত্ব চলে যাবে চীন এবং রাশিয়ার হাতে। তালেবান ইস্যুটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যোগ করেছে নতুন শঙ্কা।

তালেবানের উত্থানের ফলে কোন দিকে ধাবিত হতে পারে আগামীর আফগানিস্থান, মানবাধিকার, আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতি পরিস্থিতি, সেটাই এখন দেখার বিষয়!