বিএনপি কেন আন্দোলন করে না– প্রথম পর্ব

বিএনপির নেতাকর্মীরা সব সময় চেষ্টা করেছেন কোনো অবস্থাতেই যেন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে না হয়। নেতাকর্মীদের এ ধরনের আচরণে কারও কারও কাছে বিএনপিকে সরকার অনুগত বিরোধী দল বলে ভ্রম হতে পারে।

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 14 May 2023, 11:30 AM
Updated : 14 May 2023, 11:30 AM

আন্দোলন করবার জন্য যেসব উপাদান দরকার, তার সবকিছুই দেশে বিদ্যমান। স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পার হয়ে গেলেও দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। সব দলের কাছে আস্থাভাজন নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা আজও গড়ে তোলা যায়নি। দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশসমূহের তালিকায়।

দ্রব্যমূল্য নিম্নমধ্যবিত্তসহ প্রান্তিক জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদী দূষণ, বায়ু দূষণ ইত্যাদি সমস্যা জনজীবনের সংকটকে আরও গভীরতর করে তুলছে। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবার সব উপাদান দেশে বিরাজমান। কিন্তু তারপরও বিএনপি কেন আন্দোলন করছে না? নাকি, দলটি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না?

লেখার শুরুতে নিবন্ধটির শিরোনাম দিতে চেয়েছিলাম, ‘বিএনপির আন্দোলন কেন সফল হয় না?’ গত বছরের শেষ দিক থেকে বিএনপি দাবি করে আসছে তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। কিন্তু লিখতে গিয়ে মনে হলো, বিএনপি কি আসলেই আন্দোলন করছে? নাকি আন্দোলনের ভান করে যাচ্ছে দলকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য?

২০১৮-এর নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি যেন অনেকটাই ‘শীতনিদ্রায়’ চলে যায়। সরকারও বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নেয়। কঠোর অবস্থা মোকাবেলা করে রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাবার ব্যাপারে বিএনপি নেতৃত্ব আগ্রহী নয়—এভাবেই বিষয়টা ধরা পড়ছে অনেকের কাছে। 

লক্ষণীয় যে, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই দলটিকে আর আন্দোলনের মাঠে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর মুক্তির দাবিতেও তারা সরব হয়নি, হাতেগোণা দুই-একটি লোক দেখানো কর্মসূচি ব্যতিরেকে। 

২০০৯ সাল থেকে একটা বড় সময় বিএনপি আন্দোলনে জামায়াতের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছে। জামায়াত তাদের নেতাদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থেকে মুক্ত করবার কৌশল হিসেবে বিএনপিকে নানাভাবে পাশে চেয়েছে। জামায়াত যেহেতু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করছে, সেহেতু বিএনপিও জামায়াতকে সহায়তা করে গিয়েছে। 

অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের একে একে সাজা হয়ে গেলে, জামায়াত আন্দোলনের মাঠ থেকে সরে যায়। জামায়াত সরে যাওয়ার পর আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হঠকারী আন্দোলন এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের কঠোর নীতির ফলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রাজনীতির মাঠ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব থাকতেই বিএনপির কিছু কর্মী-সমর্থককে স্বাছন্দ্য বোধ করতে দেখা যায়। 

বিপুলসংখ্যক কর্মী, সমর্থক এবং বড় জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপির অবস্থান রাজনীতির মাঠে ফিকে হয়ে আসতে থাকে দলের নেতৃত্বের সরকারবিরোধী আন্দোলনে অনাগ্রহ বা রাষ্ট্রযন্ত্রের মোকাবেলায় সাহসিকতার অভাবে। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সরকার হঠাৎ করেই বিএনপির প্রতি নমনীয় হতে শুরু করে।

এ ধরনের আচরণ এর আগে সরকার ইসলামী আন্দোলন, সিপিবিসহ বামপন্থী দলগুলোকে দেখিয়েছে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে-ময়দানে যথেষ্ট কঠোর বক্তব্য এবং শ্লোগান দিলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এর বিপরীতে বিএনপিকে অনেকটাই মাঠে দাঁড়াতে দেয়নি সরকার। বিএনপি সমর্থকদের কাছে বিষয়টা ধরা পড়ে এভাবে যে, সরকারের বিরুদ্ধে যারা মাঠে নামতে পারছে তারা হয় সাজানো বিরোধী দল, নতুবা ভারতের সঙ্গে তাদের ভালো যোগাযোগ রয়েছে।

বিএনপির প্রতি নমনীয় আচরণের সময় বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে দলটি সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। একটি বাদে প্রতিটি সমাবেশের আগে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। আওয়ামী লীগ এই সব পরিবহন ধর্মঘটের সঙ্গে তাদের কোনো যোগ নেই বলে দাবি করে। অপরদিকে, বিএনপিসহ যারা সরকারবিরোধী অবস্থানে রয়েছে, তাদের সবার কাছে বিষয়টি সরকারের ইন্ধনে ঘটছে– এভাবে ধরা পড়ে।

অনেকদিন পর বিভাগীয় সমাবেশ কর্মসূচিকে ঘিরে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের মাঝে বিপুল উৎসাহ তৈরি হয়। এ উৎসাহ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল বাস্তবতা বিবর্জিত। জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল সমীকরণ এবং মাঠে বিএনপির আন্দোলন গড়ে তোলার সক্ষমতা– এসব বিবেচনায় না নিয়েই দলটির মধ্যমসারির কিছু নেতা অল্প সময়ের মাঝে সরকার পতন ঘটবে বলে ঘোষণা দেন। অনলাইনে বিএনপি এবং সমমনা দলের সমর্থকরা এ কথার সূত্র ধরে ব্যাপক প্রচারণায় নামেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এসব বিষয়ে চুপ থাকার নীতি নেন। তাঁরা ধরে নেন, এসব প্রচারণা সরকার বিরোধিতার পালে হাওয়া যোগাবে। নিঃসন্দেহে যে কোনো আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রপাগান্ডা-গুজব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রুশ বিপ্লব থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন—সব জায়গাতেই প্রপাগান্ডা-গুজব ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব যেটা বুঝে উঠতে পারেননি সেটা হলো, প্রপাগান্ডা-প্রচারণার সঙ্গে বাস্তবতার যদি একেবারেই যোগ না থাকে, তখন যে দলের কর্মীরা এসব প্রপাগান্ডা চালায়, ওই দলের ওপর তাদের সমর্থকদের আস্থার সংকট তৈরি হয়। সার্বিকভাবে দলটি নিজেও ইমেজ সংকটে পতিত হয়।

বিএনপির সমর্থকেরা পরিবহন ধর্মঘট উপেক্ষা করে নানাভাবে সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছেন। ধর্মঘটের কোনো প্রভাব সমাবেশে দেখা যায় না। বরং ধর্মঘট ডাকবার ফলে জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মাঝে এ ধারণা জন্মায় যে, সমাবেশ যাতে সফল না হয়, সরকার সে চেষ্টাই করছে। ফলে সমাবেশকে ঘিরে জনগণের মাঝে আগ্রহ তৈরি হয়।

উল্লেখ্য যে, জেলায় জেলায় সমাবেশ না করে বিএনপি প্রতি বিভাগে সমাবেশ করবার সিদ্ধান্ত নেয়। এর একটি কারণ হতে পারে লোকসমাগম বেশি দেখানো। এছাড়া এটাও হতে পারে যে, জেলায় জেলায় গিয়ে জনসংযোগ করবার মতো পরিশ্রম করতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আগ্রহী নন। অনেকের কাছে এটাও মনে হয়েছে, সংক্ষিপ্তভাবে এবং ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু দায়সারা কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে দলকে গতিশীল রাখতেই খালেদা জিয়া-উত্তর বিএনপি নেতাদের মূল আগ্রহ।

বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৯১-এর নির্বাচনী জনসভার সময় খালেদা জিয়ার জেলা পর্যায়ের সমাবেশগুলোতেই যে পরিমাণ জমায়েত হতো তা হয়েছে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে। তবে বিভাগীয় পর্যায়ের জমায়েত নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে সন্তুষ্টির ভাব পরিলক্ষিত হয়।

ঢাকা বিভাগের সমাবেশকে ঘিরে বিএনপির সমর্থকদের মাঝে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। শুধু তাই নয়, বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল কিছু বামপন্থী দাবিদার এর মাঝ দিয়ে নিপীড়িত, প্রাকৃতজনের গণজাগরণ দেখতে পান। বিএনপির সমর্থকদের সঙ্গে সঙ্গে তারাও এ সমাবেশের মধ্যে দিয়ে সরকারের পতন ঘটবে বলে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। বিএনপি ঘরানার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে মিসরের তাহরির স্কয়ার বা হেফাজতের দ্বিতীয় দফার শাপলা চত্বরের মতো কিছু ঘটাবার ডাক দেন।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বিএনপির অনেক নেতারই রয়েছে। তারা খুব ভালো করেই জানেন একটি রাজনৈতিক সভার মধ্য দিয়ে কোনো সরকারের পতন ঘটানো যায় না। জনসভা ওই অর্থে আন্দোলন নয় বরং আন্দোলনের প্রস্তুতি বা আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন তৈরি করার মাধ্যম।

এসব জানা সত্ত্বেও বাস্তব অবস্থা না বুঝিয়ে কর্মীদের সরকার পতনের অতি উৎসাহে বিএনপির নেতৃত্ব চুপ থাকার নীতি নেয়। কিন্তু এতে যে খুব অল্প সময়ের মাঝে দলের ওপর কর্মীদের হতাশা জন্ম নিতে পারে, ওই বিষয়টি তারা হয় বুঝে উঠতে পারেননি অথবা কর্মীদের উৎসাহের বিপরীতে তারা দাঁড়াবার সাহস পাননি।

কর্মীদের উৎসাহের সঙ্গে নেতারা অবশ্য পা ফেলতে পারছিলেন না। বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চাইলে সরকার তাদেরকে নানা শর্ত বেধে দিয়ে সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলে। বিএনপি নয়াপল্টন ছাড়া সমাবেশ করবে না এরকম একটা শক্ত অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে।

বিএনপির সমর্থকদের বাইরেও সাধারণ জনগণের অনেকের মাঝে এরকম ধারণা জন্মে যে, আর যাই হোক বিএনপি নয়াপল্টনেই সমাবেশ করার চেষ্টা করবে অথবা আপাতত সমাবেশ করবে না। কিন্তু দেখা গেল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেপ্তার হয়ে যাবার পর বিএনপির অন্য নেতারা সরকাররের দেয়া সব শর্ত মেনে ঢাকার এক প্রান্ত গোলাপবাগে সমাবেশ করতে রাজি হয়ে যায়।

এ ধরনের অবমাননাকর অবস্থায় সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত হলেও বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা বিপুল উৎসাহে ব্যাপক সংখ্যায় সমাবেশস্থলে আসেন। তারা এটা মনে করছিলেন যে, তাদের নেতারা একটা প্ল্যাটফরম খুঁজছেন, তাই কৌশলের অংশ হিসেবে সরকারের বেঁধে দেওয়া শর্ত মেনে গোলাপবাগে সমাবেশে রাজি হয়েছেন। তারাসহ বিএনপির শুভানুধ্যায়ীরা ধরেই নিয়েছিলেন, সামনে যেহেতু নির্বাচন, তাই এবার সমাবেশ থেকে সরকার পতনের লক্ষ্যে কঠোর কর্মসূচি আসতে যাচ্ছে। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে এ ধরনের কিছুই সমাবেশস্থল থেকে শোনা গেল না।

সমাবেশ উত্তর সময়ে বিএনপি পুলিশ প্রহরায় প্রশাসনের ঠিক করে দেওয়া পথে কয়েকটি পদযাত্রা করে তাদের দাবিকৃত আন্দোলনের আপাত পরিসমাপ্তি ঘটায়। লক্ষণীয় যে, কোনো একটি পদযাত্রা থেকেও পুলিশ কর্তৃক নির্ধারিত পথের বাইরে পদযাত্রা নিয়ে যাবার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়নি বা আইন ভঙ্গ করা হয়নি।

মহাত্মা গান্ধীর অহিংস কর্মসূচির সময়ও দেখা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ ব্রিটিশ সরকারের আইন ভেঙে গ্রেপ্তার হচ্ছেন, মার খাচ্ছেন। কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা সব সময় চেষ্টা করেছেন কোনো অবস্থাতেই যেন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে না হয়। নেতাকর্মীদের এ ধরনের আচরণে কারও কারও কাছে বিএনপিকে সরকার অনুগত বিরোধী দল বলে ভ্রম হতে পারে। (চলবে)