শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন ও গণমানসিকতা

ঘরে, রাস্তায়, গণপরিবহনে তো বটেই স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নারীর জন্য হয়রানির উন্মুক্ত ক্ষেত্র।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 March 2024, 06:46 PM
Updated : 19 March 2024, 06:46 PM

সমস্যা তো শুধু বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে নয়, আসল সমস্যা তো আমাদের মনোগঠনে। নারীর প্রতি আমাদের আচরণ কী রকম হবে, এটা বেশিরভাগ মানুষই জানে না। আমাদের গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা, মন-মানসিকতা, আমাদের পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের যথার্থ মানুষ হবার পাঠ দেয় না। আমরা একইসঙ্গে কাম-লালসা নিয়ে বড় হই। আবার ‘পৌরুষ’ ও ‘ক্ষমতা’ প্রয়োগের চেষ্টা করি। যে মেয়েটি ‘আমার’ হতে চায় না, তার ওপর ব্যাটাগিরি, ক্ষমতা চাপিয়ে দেই। আর মেয়েদের যে শুধু ‘আমার’ বানাতে চাই, তাও নয়, আমরা চাই একটি মেয়ে হবে কেবল ভোগের বস্তু। আমি যখন চাইব, যেভাবে চাইব, সে পুতুলের মতো ভূমিকা পালন করবে। সবকিছুতে কেবল সায় দেবে। এর বাইরে গেলেই বিচিত্র কায়দায় হয়রানি, দেখে নেবার হুমকি। সারাক্ষণ অপমান-অপদস্থ করা।

মেয়েদেরকে মানুষ হিসেবে দেখার শিক্ষা বা মানসিকতা আমাদের মধ্যে নেই। একটা মেয়ে যে আলাদা একটা মানবিক সত্তা, তার ইচ্ছে-অনিচ্ছে, পছন্দ আছে, মর্যাদা আছে, সম্মান আছে— সেটা আমরা ভুলে যাই। মেয়ে হলেই আমরা তার ওপর জোর-জবরদস্তি করি, নিজের ভালোলাগাকে, ইচ্ছেকে মেনে নিতে বাধ্য করতে চাই! আমাদের সামাজিকীকরণে এখানেই একটা মস্ত গলদ। আর এখান থেকেই আসে নারীদের হয়রানি, অশ্রদ্ধা করার মানসিকতা।

নারীকে মানুষ হিসেবে না দেখে কেবল নারী বা ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখার মানসিকতার কারণে তারা সবখানে হয়রানির শিকার হয়। ঘরে, রাস্তায়, গণপরিবহনে তো বটেই স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নারীর জন্য হয়রানির উন্মুক্ত ক্ষেত্র। কখনও আত্মীয়-পরিজন, কখনও বন্ধু-সহপাঠী, কখনও শিক্ষক— সবাই চরম কাম-লালসা নিয়ে, নারীকে টার্গেট করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়, হুমকির শিকার হয়, এমনকি ধর্ষিতও হয়। আইন-বিচার দিয়ে কয়জনকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, যদি মন-মানসিকতা না পাল্টায়?

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একের পর এক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। মাদ্রাসা, স্কুল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়— সবখানে। কখনও শিক্ষক কখনও সহপাঠীদের দ্বারা নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার হচ্ছে না। সব ঘটনার খবর আমরা জানতেও পারি না। হাতে-গোনা দু-চারটি ঘটনা প্রকাশিত হয়। তাই নিয়ে আমরা কিছু মানুষ ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হই। কয়েকদিন গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। তারপর সব ঠান্ডা হয়ে যায়। আমরা নতুন একটি ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

শিক্ষাঙ্গনে যৌন নির্যাতন, হয়রানি, বুলিংয়ের মতো অপরাধমূলক ঘটনাগুলোর ব্যাপারে অধিকাংশ ভুক্তভোগীই মুখ খোলেন না। আমাদের বানানো সমাজে ‘লোকলজ্জা’র ভয়। আরও বড় ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার ভয়। এমন অনেক রকম ভয় তাদের চুপ থাকতে বাধ্য করে। যারা সাহস করে অভিযোগ জানান, তারাও খুব সহজে সমাধান পান না। সমাজে যে নৈতিক স্খলন ঘটছে দিনের পর দিন, এর বহির্প্রকাশ ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানিসহ একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনার মাধ্যমে। এসব ঘটনা প্রতিকারের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি আছে, সেটিও কার্যকর নয়। অন্যদিকে ভুক্তভোগীর সুরক্ষা নেই। কেউ অভিযোগ করার পর নিপীড়নের মাত্রা বরং আরও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সমাজে মেয়েদের নিয়ে শঙ্কা ও উদ্বেগ বাড়ছে।

সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার হয়রানির অভিযোগ গুরুত্বই দেয়নি প্রক্টর অফিস। নিজের বিভাগও অভিযোগের দায় সেরেছে শুধু সুপারিশ করে। তাই অভিযোগ করার পর নানা রকম নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে তাকে। নিপীড়নের বিষয়টি জানিয়ে আরও বেশি মানসিক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে অবন্তিকাকে। পর্যায়ক্রমে চরম হতাশায় নিমজ্জিত অবন্তিকা আত্মহননের পথ বেছে নেন। অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় তার সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে এই দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

এর আগে ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির দায়ে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই শিক্ষার্থী প্রথমে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। এরপর তিনি প্রকাশ্যে মুখ খোলেন শিক্ষক সাজন সাহার বিরুদ্ধে। এর আগে তার অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ওই বিভাগেরই এক নারী শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। ওই অধ্যাপকের অফিসকক্ষে তালা দিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়া পর্যন্ত সব অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ফলে ওই শিক্ষককে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

গত মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন আবাসিক হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে কৌশলে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ছাত্ররাজনীতিতে নেতার পদধারী এক শিক্ষার্থী এবং তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন পুরুষ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত শিক্ষকের বরখাস্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একই স্কুলের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনে। সে ঘটনায় ওই শিক্ষককে ক্লাস থেকে প্রত্যাহার করা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আলীম ‘বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরুষতান্ত্রিক ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের কৌশল’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২০০ ছাত্রীর সাক্ষাৎকার নেন। গবেষণার ফলে বলা হয়, ৫৬ শতাংশ নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়। ১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষক। ১০ শতাংশ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানি। নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছিলেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি ৫ শতাংশ সেলে। ৯০ শতাংশ জানান, ন্যায় বিচার না পাওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি।

উল্লিখিত পরিসংখ্যান আমাদের শঙ্কিত করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি মেয়েরা নিরাপদ না হয়, তাহলে সে কোথায় যাবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেবল সার্টিফিকেট বিক্রির দোকান নয়, এটা একজন শিক্ষার্থীর মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের স্থান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই তারা ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বুঝতে শেখে। নীতি-নৈতিকতার পাঠ নেয়। নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করে জীবনকে কীভাবে সুন্দরভাবে পরিচালিত করা যায়, সেই জ্ঞান লাভ করে। সেখানে যদি সহপাঠীর দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানকে আমরা কীভাবে সম্মান জানাব? সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হচ্ছে একজন শিক্ষকের যৌন হয়রানিকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। আমরা যুগ যুগ ধরে জেনে এসেছি ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার!’ একজন শিক্ষকের পরিচয় শুধু একজন শিক্ষক। কোনো শিক্ষক যদি তার শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি করে, তবে তাকে কোনোভাবেই আর 'শিক্ষক' বলা যায় না! তার পরিচয় শুধু একজন যৌন নিপীড়ক! একজন ঘৃণ্য অপরাধী। তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনা না গেলে এই সমাজ কোনোদিনই শুদ্ধ হবে না!

কোনো ঘটনায় যখন একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, শুরুতেই যদি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা হলে অনেক ঘটনার প্রতিকার সহজ হয়। যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, এটা অপরাধ। অপরাধের বিচার করা, অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা সামাজিক ন্যায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হয়রানির বিরুদ্ধে মুখ খোলা একজন নারীর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ আমাদের যে আইন-বিধি-নীতি রয়েছে, এগুলোতে ভুক্তভোগীর পর্যাপ্ত সুরক্ষা নেই। আমরা দেখছি, যখন একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ দিচ্ছেন, তখন তার প্রতি দ্বিগুণ নিপীড়ন শুরু হয়। সেটি সামাজিক, মানসিক, এমনকি শারীরিকও হয়ে থাকে। এ জন্য নারীকে অনেক রকম যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নীরবে সহ্য করতে হয়।

কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিকারের পথগুলো সবই প্রায় বন্ধ। যৌন নির্যাতনের বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, কখনো-বা বিচারহীনতার কারণে এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। একজন যখন অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, আরেকজন একই ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্রে মানসিক জোর পায়। মনে করে, এতে তার কোনো শাস্তি হবে না। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, হয়রানিকারী অপরাধীরা সব সময় কোনো না কোনো মহল থেকে সমর্থন লাভ করে। ‘তাকে ফাঁসানো হয়েছে’— এমন একটা কথা বলে এই বক্তব্যের পক্ষে সহানুভূতিশীল ও সমর্থক কিছু ব্যক্তিকে পেয়ে যায়। তাদের জোরে এই অপরাধী ব্যক্তি আরও বেশি হম্বি-তম্বি করে। আর ‘সামাজিক কলঙ্ক’ ও সন্দিগ্ধ প্রতিবেশীর কটাক্ষ এড়াতে ভুক্তভোগীরা গুটিয়ে যায়। এই ধারা চলছে তো চলছেই।

প্রশ্ন হলো এই ধারা আর কতদিন চলবে? কতদিন চলতে দেওয়া হবে? এই অচলায়তন এখনই ভাঙ্গা দরকার। আজ ক্ষমতার জোরে, ক্ষমতায় টিকে থাকার লোভে সব কিছু উপেক্ষা করলে এক সময় বিচারহীনতার এই ‘সর্বগ্রাসী পাপ’ পুরো সমাজকে গ্রাস করবে। আর পাপ কখনো বাপকেও ছেড়ে কথা কয় না!