মুক্তিপত্র নিয়ে দু-ছত্র

ই-পাসপোর্ট করতে যেসব বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলোর সরস বর্ণনা করেছেন লেখক।

সায়ীদুল হক খানসায়ীদুল হক খান
Published : 17 Nov 2022, 02:35 PM
Updated : 17 Nov 2022, 02:35 PM

অর্থাৎ পাসপোর্ট, যার বাংলা: নিষ্কামপত্র, মুক্তিপত্র, ছাড়পত্র, প্রবেশাধিকার, খালাসপত্র। এদেশীয় বাস্তবতায় পাসপোর্টের বাংলা হিসেবে 'মুক্তিপত্র' শব্দটি জুতসই। কারণ, সমুদ্রগামী একটা জাহাজ বুড়িগঙ্গায় দাঁড় করিয়ে তার গায়ে থাপ্‌‌ড়িয়ে থাপ্‌ড়িয়ে খালাসী যদি হাঁকতে থাকে, ‘মাল্যেসিয়া-সিঙ্গাপুর-হংকং’- মুহূর্তে এই শহরে জ্যাম লেগে সমস্ত মানুষ সদরঘাট বেয়ে 'মুক্তির-মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান' হবে এবং সেই মুক্তির প্রথম সোপান হচ্ছে মুক্তিপত্র।

এই মুক্তিপত্র নবরূপায়ন করার প্রয়োজনে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কারও পরিচিত কেউ আছে কিনা, তা জেনে ও একজন পেয়ে, বুকে সাহস নিয়ে সরকারি ওয়েবসাইটে ঢুকে গেলাম। ওখানে অনেক বাংলা-ইংরেজির পর ই–পাসপোর্ট এর জন্য অনলাইন আবেদন সেরে মোবাইল ব্যাংক- এর মাধ্যমে ফি জমা দেবার মুহূর্ত থেকে 'স্পিকার' হওয়া শুরু। যথাপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করার পর জানাচ্ছে: Transaction failed! আবার একই পরিমাণ অর্থ প্রদানের পর জানাচ্ছে: Transaction OK. কিন্তু স্টেটমেন্ট যাচাই করে দেখা গেল: দু বার 'নিকাশ' হয়েছে!

সমস্ত কাগজ প্রিন্ট করে, দরকারি কাগজ জড়ো করে ও অ-দরকারি কাগজ সাথে রেখে, আগের রাত থেকে তোড়জোড় শুরু করে, পরদিন সুবহে-সাদেকে 'খায়রুন-মিনান্‌-নাওম' সমঝে... উবার ডেকে.... চললো 'স্পিকার' আগারগাঁও। নীলক্ষেত থেকে মিরপুর রোড বেয়ে তড়তড়িয়ে এগিয়ে, সংসদ-ভবনের সামনে যেয়েই যানজট ও জনজট। কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো.....ছুটে-তো-বাধে....বাধে-তো-ছুটে......হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে করে খেজুর-বাগানের খালেদ-মোশাররফ-গং-বধ্যভূমি পার হয়ে, বুলেটের বেগে- >আগারগাঁ ও জলহাওয়া ভবন দৃষ্ট হতেই উবার-ভাড়া পরিশোধের এন্তেজাম এবং মুহূর্তেই.... বহির্গমন অফিস ভবন!

মঞ্জিল-এ-মকসুদ অর্থাৎ আরাধ্য স্থান। তখন থেকে চিন্তা 'মকসুদ' পূর্ণ হতে কতক্ষণ লাগবে? এক ঘণ্টায় হবে তো? ফিরতি-উবার পাবো তো? দুপুরের ঘুমটা যদি মারা যায়, তবে পাসপোর্ট অফিস যেন রাতেও ঘুমাতে না পারে… ইত্যাদি দুশ্চিন্তা ও দূশ্‌-কামনা। অনেক ভিড়, হিজিবিজি ও হাবিজাবি এড়িয়ে প্রথম-অফিসে ঢোকার পথে 'জনগণের-বন্ধু' তথা পুলিশ-ভাইয়াকে জিগ্যেস করে জানলাম, যাকে খুঁজছি তিনি পাশের ভবনে বসেন, যেটা Main Office। এই main office- এ, সকল mane ধারীরা বসেন, যাদের একজন আমার উদ্দিষ্ট।

লিফট চেপে- নিরাপত্তাকর্মীদের আপত্তি মিটিয়ে যথাকক্ষে ঢুকে target সই করে এক টুকরা 'আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হউক'। পরিচয়-মধ্যস্ততাকারী মারফত উনি জেনেছিলেন আমরা একই জেলার লোক, বেরিয়ে এলো জেলা নয়, বিভাগ! চা-বিস্কিটে আপ্যায়নের সংশ্লিষ্ট কর্মীটি খুব অমায়িক ও ভদ্র, চা-পর্ব সংক্ষিপ্ত করার মুহূর্তে 'শান্তি-বর্ষিত-ব্যাক্তিটি' কাগজ-পত্র দেখে বললেন: 'NoC কোথায়'? ডেপুটি-স্পিকার! 'ওটা না হলে তো হবে না, নিয়ে আসুন'। মামলা চলে গেল লোয়ার-কোর্টে! অবসর প্রস্তুতিভোগা একজন ভ্যাগাবন্ড হিসেবে ‘NoC’ কেন লাগবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকারি নয়, সেই প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষকের কেন ‘NoC’ লাগে? সর্বোপরি পাসপোর্ট-নবায়নের ক্ষেত্রেইবা ‘NoC’ লাগাতে হবে কেন? বর্তমানের-মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট যখন করা হয়েছিল, তখনই তো ‘NoC’ নেয়া হয়েছিল! এনআইডি এবং পাসপোর্ট যেহেতু একই পরিচয়পত্র তাই পাসপোর্ট-অফিস কেন ‘NoC’ অর্থাৎ 'অনাপত্তিপত্র' চাইবে? পাসপোর্ট ব্যবহার হয়, দেশীয়-সীমান্ত পার হবার সময়, তাই বিপত্তি যদি ঘটে এবং যে কারণে ঘটতে পারে, সে কারণ এত্তো আগে তারা কিভাবে আঁচ করতে পারেন? আর যদি পারেনই, তবে 'স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিদেশ গমনের উপর নিষেধাজ্ঞা' কেন আরোপ করতে হয়? বিদেশগমনে আপত্তি এবং বিদেশগমনের মুক্তিপত্র পেতে আপত্তি, দুটি দুই বিষয় ও দুই ব্যবস্থা, তাই না? 

… ইত্যাদি কথা তোলার ফুরসৎ পাওয়াই হলো না। বিরক্তির রাশ টেনে, কেশে হাত বুলিয়ে, পা-বাড়িয়ে করিডোরে নেমেই দেখি, যে গেইট দিয়ে ফ্লোরস্থ হয়েছিলাম, সেটা চেইন-মুড়িয়ে তালাবন্ধ। লে হালুয়া! নিরাপত্তা কর্মীদের একজন ভিন্ন দিকের গেইট দেখিয়ে বল্লেন, ওই গেইট দিয়ে সিঁড়ি ধরে, লিফট টিপুন। লিফট বাদ দিয়ে সিঁড়ি ধরে নামতে দেখি, এক কোণায় ছোট একটি জনজট, অন্য কোণায় বেশ কিছু কুরসি-কেদারা: প্রবীণ-নিবাস ও আঞ্জুমানে-মফিদুল-ইসলামে যাবার অপেক্ষায় চিৎ-কাত-উপুর হয়ে শুয়ে-বসে আছে। এলাকাটি আলোকিত নয়, পরিষ্কার তো নয়ই, তাই করিডোরের অন্য পাশে যেয়ে, সেদিককার সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। জীবনের সব ক্ষেত্রেই উপরে ওঠা কঠিন তা জানি, কিন্তু নিচে নামাও যে কঠিন তা বুঝলাম। ফিরতি উবার বাহকের বাড়ি বাগেরহাট, ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়, বিয়ে করেননি, সংসার দেখতে হয়। কদ্দুর লিখাপড়া? 'নন-মেট্রিক', সাবলীল ও সপ্রতিভ। কম সময়ে ও খরচে নামিয়ে, Rating নিয়ে চলে গেলেন।

বিকেলে নিজস্ব দপ্তরে যেয়ে, ‘NoC’-র জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ করে, মহাদপ্তরের মহাঋষিদের আস্তানায় পাঠিয়ে, পরেরদিন 'অনাপত্তিপত্র' তথা ‘NoC’ হস্তগত!  আবার আগারগাঁও…উবার...লিফট....সেই কক্ষ...সেই চা-ওয়ালা, যিনি চিনতে পারলেন এবং সেই mane যিনি চিনতে পারলেন না। সংক্ষিপ্ততম ভূমিকা শুনে, উনি খসখস লিখে-কেটে-লিখে সেই চা-ওয়ালাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন পাশের ভবনে, সেইসাথে 'আপনার চার ঘণ্টা সময় বাঁচিয়ে দিলাম, তবে আরও ঘণ্টা খানেক লাগতে পারে, ওই যে, ওর সাথে যান'।

চা-ভাই নিয়ে গেলেন পাশের ভবনের ৩০৫ নং কক্ষে, যেখানে তুলনামুলকভাবে ছোট mane বসেন, যিনি খুবই পেশাদারী হয়ে উঠছেন, মাথা ঠাণ্ডা, পরিষ্কার ও মৃদুভাষী। খুব কঠিন দ্বারবান হেদিয়ে চা-ভাই ৩০৫ নং কক্ষের ভেতরে গেলেন এবং একটু পরে ফটো-তোলা, আঙুল-দেয়া ও চক্ষুষ্মান হবার অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে এলেন। এই ফ্লোরটি খুব জনাকীর্ণ, যেখানকার এক অংশ সরকারি-কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত এবং অন্য অংশ সম্ভবত অ-সরকারিদের। নিজে সরকারি না হয়েও, সরকারি অংশে স্থান পেয়ে, ফটো-বুথের দ্বারবান থেকে সিরিয়াল (৫৭) নিয়ে, 'ওখানে বসুন, ডাকা হবে'। এখন কত নম্বর সিরিয়াল চলছে? '৪৭'। মানে দশজন পর আমার ডাক আসবে। অনুমান করলাম, প্রতিজন ৫ মিনিট হিসেবে ৫০ মিনিট, আচ্ছা না হয় ৬০ মিনিট পর, আমার ডাক উঠবে। কিন্তু ‘আসে আর যায় কত চৈতালি বেলা, এ জীবনে শুধু মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা...', অর্থাৎ ওই দরজা দিয়ে লোকজন ঢুকছে-বেরুচ্ছে কিন্তু কোনও ডাক উঠছে না ৪৮, ৪৯, ৫০.....। কিস্‌সু শুনছি না, তবে হচ্ছেটা কি? খোঁজ নিয়ে জানলাম ৫৪ চলছ। ৫৭ একটু পরেই। বাহ্‌ কি নীরবে, 'আমার তরী ভিড়ছে তোমার তীরে'। আনুমানিক সময়ে দোরগোড়ায় যেয়ে দেখি অন্য একজনও ৫৭ লিখা দেখাচ্ছেন এবং তার সঙ্গী আমাকে বোঝাচ্ছেন 'আপনি ৬৭'! একটু বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই উনি বললেন, 'রাগ করছেন' এবং তারপর কিছুটা নির্দেশের সুরে 'না, রাগ করবেন না'। অদূরে ৫৫ নিয়েও দুজন হাজির হয়েছেন। পাশের মিনি-দ্বারবানকে দেখাতেই উনি বললেন, 'দুজনেই ঠিক, অসুবিধা নাই, হয়ে যাবে'। ওই ৫৭, তার সঙ্গীর খোঁচা খেয়ে ঢুঁকে গেলেন, আমি ভাবছি '৬৯, ‘৭১ এগুলি গেল কোথায়? 'কোথা চেঙ্গিস, গজনীমামুদ, কোথায় কালাপাহাড়...'?

সে যাক। ৫৭ নিয়ে ৩০১ নম্বর ঘরে ঢুকে দেখি দু জন টেকনিশিয়ান দুটি কম্পুটার, বাইনাকুলার আকৃতির একটি জিনিস, টোকেন-বক্স এর মতো একটা বাক্স, বেশ কিছু কাগজপত্র ও কলম, পাশে দুএকজন দাঁড়িয়ে ও একজন সামনাসামনি বসে। যিনি বসে আছেন তার ফটো তোলা হচ্ছে। শেষ হলে আমি এগিয়ে যেয়ে কাগজপত্র জমা দেবার পর, চোখ-বুলিয়ে উনি বললেন: 'উহু, গণ্ডগোল আছে, আচ্ছা দাঁড়ান আমি স্যারের সাথে কথা বলে আসি'। ফেরত এসে, আবার চোখ বুলিয়ে: 'উহু, আরও গণ্ডগোল, স্যারের সাথে'... এবার আমিও পিছুপিছু। ফিরে এসে, 'শুনুন সাদা সার্ট কিন্তু চলবে না'। বললাম, গেঞ্জি পরে তুলি? দেখিতো গেঞ্জি, 'উহু এই ধরনের গেঞ্জিতে চলবে না'। নিরুপায় হয়ে জিগ্যেস করলাম, তাহলে কি করতে পারি? 'অন্যদিন আসুন'। ইত্যকার বাক্যালাপে উনার পেছনের জন, যিনি সম্ভবত সিনিয়র, আমাকে ডেকে নিলেন, যদিও 'প্রধানমন্ত্রী দফতরের একজন ভিআইপি'-কে সেবা দেবার জন্য উনি উৎকণ্ঠিত ও উৎকর্ণ হয়ে আছেন এবং পরিবেশটা বেশ ত্রাসিত করে রেখেছেন। এর মাঝেই ‘সাদা সার্ট চলবে না’, কথাটা গজরাচ্ছে এবং আমার ভেতরে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে এবং মনেও হলো, যখন অপেক্ষমাণ ছিলাম, তখন একজনকে জনসমক্ষে রং-বদল করতে দেখেছিলামও বটে!

 সিনিয়রটি তুলনায় কম 'ছিদ্রভূক', কাগজে চোখ বুলিয়ে উহু, “সাদা-সার্ট তো চলবে না’। বাইরে বেরিয়ে দেখুন কারও কাছ থেকে রঙিন জামা অথবা কালো কোট ধার করে পরে আসতে পারুন কিনা!“ আমি হতভম্ব এবং ‘স্পিকার’!

রুম থেকে হুইপড্‌ হয়ে বের হয়ে কোট পরিহিত একজনকে পাকড়াও করে, তার কাছে ঘটনা খুলে বলার সাথে সাথে উনি অক্লেশে কোট খুলতে খুলতে বললেন, 'কিন্তু এ কোট তো আপনার হবে না'। আমি লাগিয়ে দেখলাম দিব্বি চলে, বুকপকেটের কাছে অনেক ধরনের কোটপিন লাগানো। ফেরত এসে চেয়ার পুনর্দখল করে বসার পর: 'উহু, পিনগুলি খুলে ফেলুন'। আবার, বাইরে যেয়ে যার কোট তাকে খুঁজে বের করে, ভাই আপনার পিনগুলি খুলে রাখুন। পিন-হীন অবস্থায় ভেতরে যেয়ে বসার পর উনি কিবোর্ডে যখন বিভিন্ন কুটুর-মুটুর করছেন, তখন হঠাৎ দেখি আমাদের নীলক্ষেতীয় এক সহকর্মী কোট পরে ঘুরছেন। ‘এই মিয়া, তুমি এয়্যহানে কি কর?’ 'ফটো-ফাটো তুল্লাম', স্যার।’ ‘কাজ শেষ?’ 'জেয়াজ্ঞে'। ‘খুলে ফেল, খুলে ফেল’ অর্থাৎ তোমার গা থেকে কোট খুলে ফেল। সেটা নিয়ে নিজের গায়ে চাপিয়ে, আগের জনকে আগেরটা ফেরত ও ধন্যবাদ জানিয়ে, টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করে আবার চেয়ারে। 'বসুন, আচ্ছা টাকা যে জমা দিয়েছেন তার প্রমাণ কোথায়'? ‘এই যে confirmation letter’ 'আরে নাহ্‌, reciept কোথায় অর্থাৎ টাকা পেয়েছি সে প্রমাণ নয়, টাকা দিয়েছেন সে প্রমাণ কোথায়'? ‘মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়েছি, এই যে দেখুন।’ 'Statement কোথায়?' অর্থাৎ প্রিন্ট-আউট কোথায়? স্পিকার! 'বাইরের থেকে প্রিন্ট করে নিয়ে আসুন'। এই বাইরে মানে অফিস চত্বরের বাইরে যে মূল রাস্তা তার অন্য পাশে যে দোকানের মেলা সেখানকার কোথাও। ইতিমধ্যে জুটিয়ে নেয়া সঙ্গিসহ রাস্তা পার হয়ে ওপাশে যাবার কসরত করতে করতে হঠাৎ একটি 'কাটা' দেখে 'বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে' সেই কাটার ফাটা ধরে ওপাশে যেয়ে স্তূপীকৃত খোয়া মারিয়ে ও হড়কিয়ে একটি দোকান পেয়ে গেলাম: মোবাইল ব্যাংকিংয়ের! নিজের অ্যাকাউন্টে ঢোকার জন্য চেষ্টা করতেই দেখি, ইন্টারনেট খুবই দুব্বল, 'আসি আসি করে তুমি আর আসো না'। বহুত দোয়া, অনেক অভিশাপ এবং কিছুটা কৌতুক নিয়ে গুঁতাগুঁতি চালিয়ে যাবার পর নেট-আপু পর্দা সরিয়ে বেরুনো মাত্রই ঝাঁপিয়ে পরে নিজের statement সঙ্গীর হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে সেখান থেকে দোকানের কম্পুটার বেয়ে প্রিন্টার থেকে দু কপি ছাপিয়ে ২০ টাকাতে দফা-র রফা। আবার ফিরতি পথে, খোয়া, চড়াই, রাস্তা, কাটা, ফাটা, টুটা ও ঠুঁটো- VIP! যথা ফ্লোরে, যথাকক্ষে, যথা ব্যাক্তির সন্মুখে... যথাসম্ভব হাসি ফুটিয়ে ও ক্যাবলা ভাব ধরে ক্বিব্‌লা-মুখী হয়ে দাঁড়িয়ে,'বসুন', বসলাম: 'সোজা হয়ে বসুন, বুক টান, মুখ সোজা, ঘাড় নামান, চোখ মেলুন ও (কাঁদতে থাকুন)। কুট্টুস্‌। হয়ে গেছে, 'এবার এই টা চোখে লাগিয়ে ভেতরের লাল বিন্দুর দিকে চেয়ে থাকুন', হয়ে গেছে। 'এবার সই করুন'। হুম্‌। 'এবার প্রথমে ডানহাতের চার-আঙ্গুল, বাঁহাতের চার-আঙুল, দুইহাতের দুই বুড়োআঙুল...একটু চেপে রাখুন'। হুম্‌। এত্তগুলি 'উহু' আর অত্তগুলি 'হুম্‌' শোনার পর আমি তখন 'স্পিকারের বাবা'। আবেদনপত্রের উপর স্কেল বসিয়ে ফড়াৎ করে একটা অংশ ছিঁড়ে হস্তান্তর হবার পর তাতে চোখ বুলিয়ে দেখি, নবায়িত মুক্তিপত্র ফেরত দেবার 'সম্ভাব্য' তারিখ ও 'ফটু'। 'ধরিয়ে দিন' আবেদনের পর 'ধরা-পড়েছে' ঘোষণায় যে-'ভাবের' প্রতিচ্ছবি থাকে, আমার ফটু-তে সেই ভাব দীর্ঘদিন থেকে যাবে এবং ইমিগ্রেশন পার হতে যেয়ে 'ফটু' দেখে পুলিশ নিশ্চয়ই বলে উঠবে- 'আরে, আপনাকেই তো খুঁজছে বাংলাদেশ'! সঙ্কুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসচালিত বাহনে সবান্ধব ফেরার পথের বাহকটি খুবই street-wise, ঘুপচি চেনে, ঘুগু বুঝে এবং ফাঁদ এড়ানোর কৌশল জানে। আমাদেরকে দ্রুত নীলক্ষেতে দে-নামিয়ে, পাওনা নিয়ে চলে গেলেন। কেন যে নীলক্ষেতের বাইরে বেরুতে হয়!

কদিন পর শুরু হলো পুলিশি তদন্তের চক্কর ও ভয়ডর। চক্করের প্রথম ঘুল্লায় 'যোগাযোগ-বিভ্রাট' অর্থাৎ তদন্তকারী ফোন করে আমাকে না পেয়ে আমার এক সহকর্মীর (যার ফোন-নম্বর আবেদনপত্রে দেয়া ছিল) কাছে বক্তব্য ব্যক্ত করে, উনার ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছেন। সেই নম্বরে ফোন করে 'চরণ পাই পাই পাই রে...' অবস্থা, অবশেষে পেলাম ও সন্দর্শনে, স্থায়ী বনাম বর্তমান, নিজস্ব বনাম সরকারি 'ইত্যাদি ইত্যাদি, প্রভৃতি ও আরও অনেক কিছু'। 'তদন্ত' শব্দের সাথে দন্ত সংযুক্ত এবং তদন্তকারীর দাঁতগুলি একটু দেখে ও বাকিটা অনুমান করার প্রক্রিয়ায়, 'মুশ্‌কিল আহ্‌ সান' এক জীববিজ্ঞানী বললেন: 'কাগজটা আমাকে দিন, দেখ্‌ছি'। ভাবলাম, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখবেন, তাকিয়ে দেখি মোবাইল দিয়ে উনি কী দেখছেন এবং তারপর কুট্টুস করে একটা 'ফটু' তুলে, ফটাস করে কাগজটা আমাকে ফেরত দিয়ে, চটাস্‌ করে পুলিশকে বিদেয় করলেন। আমকে বললেন: 'এবার নাকে তেল দিয়ে ঘুমান'। এই সহকর্মীদের উপস্থিতির এক আড্ডায় দুদিন আগে ‘Gel’ নিয়ে বিস্তর ‘হিহি হিহি’ হয়েছিল বটে, তাই তেলের সাথে ঘুমের সম্পর্ক জিজ্ঞেস করার সাহস আর হলো না, হয়তো বলে বসতো: 'অল্‌ রাইট, তেল বাদ দিয়ে Gel দিয়ে ঘুমান এবং Feel Free'! তবে, তেলের সাথে ঘুমের সম্পর্ক জানার আগ্রহটা জিঁইয়েই রাখলাম, কারণ আবার যখন পাসপোর্ট নবায়ন করতে হবে, তখন প্রসঙ্গ তো উঠবেই। ইতিমধ্যে, ঢাকা-মুমিন্সিং...এসবি...ডিবি এবং who is who? জীববিজ্ঞানী সহকর্মীটি মাঝেসাঝেই ‘অনলাইন স্ট্যাটাস’ দেখে আমাকে জানাচ্ছেন: দন্ত-গুটানো হয়েছে, তদন্ত শেষ, ছাপা হচ্ছে, বাঁধাই হবে, এসএমএস পাঠাবে, ফিংগারস ক্রস করুন অর্থাৎ পাসপোর্ট-অফিসের বিভিন্ন কামরায় দেবার জন্য যে অঙ্গুলগুলি তুলেছিলেন সেগুলি এবার নামিয়ে নিন, এই যেমন, '৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয়-আরোরা, পাকিস্তানি-নিয়াজিকে বলেছিলেন, 'আব্‌দুল্লাহ্‌, হাতিয়ার ডাল্‌ দো'। ছানাপোনা ঘষা শিক্ষকদের মসীলিপ্ত আঙুল ছাড়া অন্য কোনও হাতিয়ার  থাকেও না অবশ্য!

(অবশেষে) পাইলাম- উহাকে পাইলাম! অর্থাৎ এসএমএস পাইলাম। পরদিন ছুটলাম। অনেক মানুষ রোদ মাথায় নিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘুপ্‌চি দিয়ে চুপটি করে… এক বড়-সাহেবের দপ্তরে যেয়ে দেখি… সেখানেও ম্যালা উমেদার… প্রায় লাইন... সাহেবের পিএস-কে নিজের প্রয়োজন বলায়, উনি একটা নাম লিখে কাগজ ভাঁজ করে দিয়ে বললেন: 'কাউকে না দেখিয়ে এই কাগজ নিয়ে দোতলার দুইনম্বর জানালায় দেখান'। পিএস একজন ভদ্রলোক, বুদ্ধিমান এবং সক্রিয়। সে যাক। দোতলায় নেমে দেখি, গেইট বন্ধ। অর্থাৎ তিন তলা থেকে দোতলায় যাবার উপায় নেই। লে হালুয়া! এক তলায় নেমে লিফট্‌বয়কে জিগ্যেস করে জানা গেল, এই ভবন থেকে বের হয়ে অন্য ভুবন দিয়ে দোতলায় ল্যান্ড করতে হয়। গেলাম...অনেক মানুষ...মেয়ে-মর্দ...অনেক ভিড়। একটু পর পর টোকেন-নাম্বার ডাকা হচ্ছে। আমি 'দুনম্বরি'তে কাগজ জমা দিয়ে খিড়কি-র সামনে অপেক্ষায়। খানিক পর নাম ডাকা হলো। সই করে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে ছাপ বসিয়ে ধপাস-খাওয়া একটা ছোট্ট পুস্তিকা-কে আমার দিকে এগুতে দেখলাম। আহা! অহো! ওহো! হালার-পো-হালা, 'এসো এসো আমার বুকে এসো, আমার বুকে...'। পাসপোর্ট তথা মুক্তিপত্র হাত বেয়ে আমার বুকে, মুক্তি...মুক্তিপত্র।

ফেরার পথে অনেক কিছুর সাথে মনে এলো, ই-পাসপোর্ট ও অনলাইন আবেদন করেছি শুনে এক সমাজবিজ্ঞানী সেই শুরুতেই ফুঁকেছিলেন, 'আপনার ভোগান্তি অ-সী-ম’। তা-ই হলোও বটে। তেজগাঁও-এয়ারপোর্টে হেলিকপ্টারের উঠানাম দেখতে দেখতে…আচ্ছা, এটা তো নভেম্বর মাস, আর কদিন পর-ই ১৬ ডিসেম্বর…। আচ্ছা, বিজয় মানে কী… আমার কাছে বিজয়ের অর্থ তখন কী ছিল… এখন-ই বা কী? আসলে, কোনও মুক্তি-ই যুদ্ধ ছাড়া মেলে না, অথচ ম্যালা দিন যুদ্ধ হয় না- সেই অর্ধশতাব্দী আগে একটা হয়েছিল বটে, তবে সেটা অতীতের সংবৃত্তি, ভবিষ্যতের সংস্থিতি নয়।

উপরে যা লিখলাম তা সবই সত্য, একটু কৌতুক রয়েছে। কৌতুকাংশ বাদ দিলে, যে সত্যের মুখোমুখি হতে হয়, তা-নিয়ে দু'এক কথা, শুনুন। পাসপোর্ট একটি পরিচায়ক যা নিজস্ব-ভৌগলিক সীমার বাইরে যেতে হলে প্রয়োজন হয়। এনআইডি নামক পরিচায়ক যাকে দেয়া হয়েছে, তাকে পাসপোর্ট দিতে কোনও অসুবিধা হবার যুক্তি নেই। দেশের বাইরে এনআইডি এখনও প্রযুক্ত হয়নি, তাই পাসপোর্ট দরকার হয়। তবুও পাসপোর্ট পেতে যেয়ে যে হাঙ্গামা ও হুজ্জতি পোহাতে হচ্ছে এবং অনেকেরই হয়, তা বিরক্তির, বিভ্রান্তির ও বিবমিষার- এগুলি দূর-হতে অবশ্য অনেক সময় লাগবে। তবে, বেশ কিছু ভোগান্তি এখনই কমানো সম্ভব।

এক চতুর্থাংশ ভোগান্তি কমতে লাগবে ২৫-৩০ বছর, এক তৃতীয়াংশ কমতে লাগবে কিছু ব্যবস্থাগ্রহণ, এক-অর্ধাংশ কমতে লাগবে কিছু প্রশিক্ষণ দান, বাকী অংশ কমতে লাগবে মানসিকতার পরিবর্তন। মগবাজার পাসপোর্ট অফিসের কথা অনেকেরই মনে আছে নিশ্চয় এবং সেইসাথে একটি নাম: কাজী বাহাউদ্দিন। এই লিখা যদি বর্তমান 'কাজী'দের চোখে পরে, তবে বিনা-পয়সায় কিছু পন্থা বলতে ইচ্ছুক রইলাম। অবশ্য, সেগুলি নেবার জন্য নীলক্ষেতে আসতে হবে এবং সাথে নিয়ে আসতে হবে:

১. আবেদনপত্রের মূল কপি ও সংযোজন এবং তার উপর কলমে-লিখা বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন নির্দেশ 

২. ভয়েস-রেকর্ডার, কম্পিউটার ও কাগজ-কলম

৩. জমা দেয়া দু-দফা টাকার, এক-দফা ফেরত, এবং

৪. তক্ক না করে, দক্ষ হবার মানসিকতা।

সেই '৭১ সালে, উর্দু-জবানের এক প্রশ্ন ছিল: ‘মুক্তি কিধার? ইধার কোঁই মুক্তি-ফুক্তি হ্যায়?’ অর্থাৎ পাকিস্তানি সৈনিকরা গ্রামে-গঞ্জে বেয়নেট খুঁচিয়ে জানতে চাইতো 'এখানে কোনও মুক্তিফৌজ আছে কি না'? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ওরা মুক্তি খুঁজতো মৃত্যুর জন্য, ৫০ বছর পর আমাদের মুক্তি খুঁজতে হয় বাঁচার জন্য। কিন্তু নিম্ন-গাঙ্গেয় বাস্তবতার একদিক হচ্ছে, মৃত্যু অথবা জন্ম কোনওটাই এখানে সহজে মেলে না, মৃত্যুর-ফাঁকে সিসিইউ, আইসিইউ…..আর জন্মের-আগে এমআর, কনডম! অন্যদিকের বাস্তবতা হচ্ছে, জন্মাবধি আমাদেরকে শেখানো হয়েছে 'জীবন-খুব-কঠিন’। তাই জীবন পাবার জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে… কঠিনতম-তে পৌঁছে, কিছুটা উদাস ও বাকিটা হতাশ কণ্ঠে: Life is file!