তপ্ত নগরে গাছ কেটে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’

ঢাকার তাপ কমাতে সিটি করপোরেশন যখন দুই লাখ বৃক্ষরোপণের ঘোষণা দেয়, তখন ভেবেছিলাম সাতমসজিদ সড়কে বৃক্ষহত্যা বন্ধ হবে। কিন্তু হয়নি। কেন গাছ কাটছে এবং এই গাছ কাটার কোনো লিখিত অনুমোদন এখন পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেননি।

পাভেল পার্থপাভেল পার্থ
Published : 10 May 2023, 02:15 PM
Updated : 10 May 2023, 02:15 PM

সিটি করপোরেশন বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। ঢাকার ব্যস্ততম মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে তিনটি প্রবীণ বট-পাকুড় গাছের জীবন বাঁচিয়েছে সংস্থাটি। গাছ তিনটি না কেটে সড়ক সম্প্রসারণ করেছে এবং গাছের গোড়া বাঁধাই করারও উদ্যোগ নিয়েছে। খুব কাছেই এই গাছগুলোর সহোদরেরা খুন হয়েছিল ২০১৫ সালে। আর এখন সাত মসজিদ রোডে গাছ কেটে যা করেছে, তাতে সিটি করপোরেশনকে তো ধিক্কার না দিয়ে উপায় নেই।

২০১৫ সালে গাছ কাটার যে ঘটনাটি বললাম, সেটি ঘটানো হয়েছিল মোহাম্মদপুর থেকে বসিলা নতুন সড়কপথ উন্নয়নের সময়। বাজারের কোনায় জড়াজড়ি করে ছিল সেই প্রবীণ বট-পাকুড়। এখানে নাকি এক বুড়িরথান ছিল। পৌষমাসে মানুষ তেল-সিঁদুর মাখাত গাছের গায়। ভাগলপুরের প্রবীণ জেলেদের কাছে গল্প শুনেছি, কৈশোরে তারা এখানে হরিয়ালের ছানা খুঁজতে আসতেন। বিহারের ভাগলপুর নয়, এই ভাগলপুর গ্রামটি রাজধানী ঢাকার হাজারিবাগের এক ময়লাস্তূপের ঘিঞ্জি বস্তি। উন্মত্ত শহরের মাস্তানিতে খুন হয়েছে বুড়িগঙ্গা । হরিয়ালেরা কোথায় নিখোঁজ হয়েছে কেউ জানে না। করাত আর মেশিনের কোপে বিপন্ন শহরের স্মৃতি নিয়ে মরেছিল সেই প্রবীণ দুই বৃক্ষ সহোদর।

ভাগলপুরে যখন এই গাছেদের স্মৃতি শুনছিলাম, ভেসে ওঠেছিল ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত রায়েরবাজারের কথা। মানুষ কী গাছ কিংবা হরিয়াল কত নিদারুণভাবে স্মৃতি হয়ে যায়। কিংবা বিস্মৃতি। ক্রমাগত তপ্ত হয়ে ওঠা দূষিত বায়ুর এই নগরে আমরা বুঝতে পারছি গাছগুলো আমাদের কত দরকার ছিল। কিন্তু আমরা তো ঢাকায় গাছের শেষচিহ্নটুকুও রাখতে পারছি না। ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়কে সড়ক-বিভাজক সম্প্রসারণের জন্য ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকেই গাছ কাটা শুরু হয়। প্রতিরাতে ট্রাকে করে হারিয়ে যায় নিহত গাছগুলোর নিথর শরীর। গাছ হত্যা করে সাতমসজিদ সড়কে সিটি করপোরেশন বসাতে থাকে বালুভর্তি লোহা আর কংক্রিটের বিভাজক।

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয় ‘সাতমসজিদ গাছ রক্ষা আন্দোলন’। সিটি করপোরেশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে লেখাটি শুরু হলেও সাতমসজিদ সড়কে বৃক্ষহত্যার কারণে সেই ধন্যবাদ কী আর জারি রাখা সম্ভব? নগরবাসীর কাছ থেকে সবুজের অধিকার কেড়ে নেয়া কিংবা রাতের বেলায় ঘুমিয়ে থাকা গাছেদের কুপিয়ে হত্যা করা অন্যায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বৃক্ষ বাঁচাতে নগরবাসীর প্রতিবাদকে গুরুত্ব দিতে হবে। সিটি করপোরেশনকে নগরের বৃক্ষ, মানুষ, পাখি কী জলাভূমি সবার ভরসাস্থল হয়ে ওঠার রাজনৈতিক অঙ্গীকার করতে হবে। সড়ক বিভাজক সম্প্রসারণের নামে বৃক্ষ ও উন্নয়নের মাঝে কোনো ‘বিভাজন’ তৈরি না করে, পরিবেশের সঙ্গে কোনো বিরূপ বৈরিতা উসকে না দিয়ে পুরো বিষয়টির পরিবেশবান্ধব ফায়সালা জরুরি।

কাটা গাছ, প্রতিবাদী তরুণ ও নাগরিক প্রতিক্রিয়া

সাতমসজিদ সড়কে যখন গাছ কাটা শুরু করে বিষয়টি প্রথম আমলে আনেন কিছু প্রতিবাদী তরুণ শিল্পী, আলোকচিত্রী, লেখক, গবেষক, পরিবেশপ্রেমী ও সংস্কৃতিকর্মী। তাদের আহবানে যুক্ত হতে থাকেন বহু ব্যক্তি এবং পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। গড়ে ওঠে আমাদের ‘সাতমসজিদ গাছ রক্ষা আন্দোলন’ নামের নাগরিক মঞ্চ। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আবাহনী মাঠের বিপরীত সড়কে ওই মঞ্চের ব্যানারে বহু মানুষ প্রতিবাদী সমাবেশ ও মানববন্ধনে গাছ কাটা বন্ধ এবং কাটা গাছের স্থানে দেশীয় প্রজাতির গাছ রোপনের দাবি জানান। ৩ ফেব্রুয়ারি ‘জলপুতুল পাপেটস’ ফেলনা পুনঃব্যবহার্য জিনিস দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে গাছ-পাপেটের কর্মশালা আয়োজন করে। শিশু, কিশোর, তরুণ, প্রৌঢ়, প্রবীণ নানা বয়েসী নানা লিঙ্গ শ্রেণি পেশার মানুষের যুক্ততা বাড়তে থাকে গাছ সুরক্ষার দাবিতে। এরপর বেশ কিছুদিন গাছ কাটার কাজ বন্ধ রাখে ঠিকাদার।

‘সৌন্দর্যবর্ধন’, মে দিবসের রাত এবং একটি কার্যনির্দেশপত্র

নিদারুণভাবে মে দিবসের রাতে ২৫ বছরের এক তরতাজা বটগাছকে করাতের কোপে ভেকু মেশিনের জবরদস্তিতে হত্যা করা হয়। লম্বালম্বি সাতমসজিদ সড়কের দুই মাথায় দুই দৃশ্য। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে তিন সহোদরকে বাঁচালো সিটি করপোরেশন, একই সড়কের আরেকপ্রান্তে আবাহনী মাঠের সামনে খুন হলো বটের আরেক সহোদর। নতুন ভোটার হওয়া তরুণ কিছু ছেলে-মেয়ে গাছটিকে বাঁচাতে সারারাত রাস্তায় উদভ্রান্ত হয়েছিল। গাছ রক্ষার ও লাগানোর উপদেশ দিয়ে রাষ্ট্র কেন গাছ কাটছে এই প্রশ্নের উত্তর এই নতুন ভোটারদের দিতে পারেনি। একজন মাঝবয়েসী ট্রাফিক পুলিশের চোখে জল গড়িয়ে পড়েছিল, কারণ রাস্তার এই গাছগুলোর জন্যই নাকি তারা কিছু ছায়া পেতেন। ফুটপাতের একজন প্রবীণ দোকানি চিৎকার করে উঠেছিলেন, গ্যারেজে রিকশা জমা দিতে যাওয়া কয়েকজন রিকশাচালক মুখ হা করে দাঁড়িয়েছিলেন।

মে দিবসের সেই অসহ্য রাত সাতমসজিদ সড়কে জাগিয়ে দিয়েছিল জগদীশ চন্দ্র বসুর সেই অবিস্মরণীয় বার্তা, ‘গাছেরও প্রাণ আছে’। পরেরদিন ২ মে রাত দশটায় গাছ কাটা বন্ধ করে দ্রুত কাটা গাছের স্থানে দেশীয় প্রজাতির গাছের চারা রোপণের দাবি জানিয়ে আমরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদী সমাবেশ করি। পরদিন আবারো প্রতিবাদী সমাবেশ ও গাছ রক্ষার দাবিতে পোস্টার লাগানো হয়।

সিটি করপোরেশন কেন গাছ কাটছে এবং এই গাছ কাটার কোনো লিখিত অনুমোদন এখনো পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেননি। কোনো পাবলিক পরিসরের গাছ কাটতে হলে অবশ্যই পরিবেশ, বনবিভাগ, বৃক্ষবিশেষজ্ঞ কিংবা উদ্যানতত্ত্ববিদসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এমনকি ঝড়ে, রোগে, আঘাতপ্রাপ্ত বা বয়স্ক হয়ে কোনো গাছ দুর্বল ও ভঙ্গুর হলে তা কাটবার ক্ষেত্রেও অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। ঢাকা নগরীতে সড়ক, বিভাজক, উদ্যান কিংবা কোনো পাবলিক পরিসরের গাছ ভেঙে পড়লে বা কোনো গাছ ঝুঁকির কারণ হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞর অনুমোদনসাপেক্ষে এটি নিরাপদে সরিয়ে ফেলার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।

সাতমসজিদ সড়কবিভাজকে গাছহত্যার নিদারুণ প্রকল্পটিকেই সিটি করপোরেশন ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ হিসেবে দেখছে। গাছ কাটায় নিয়োজিতরা দক্ষিণ সিটি করপোরশেনের সঙ্গে তাদের একটি কার্যনির্দেশপত্র (স্মারক নং - ৪৬.২০৭.০১৪.০৯.০০.২২২.২০২২, তারিখ-২৮/৯/২০২২) সরবরাহ করেছেন। নির্দেশপত্রে ‘UCCL - Business Objects-Anika Enterprise (JV)  নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩০/৯/২০২২ থেকে ৩০/৬/২০২৩ মেয়াদকালের একটি কাজের বিষয় উল্লেখ আছে। কার্যনির্দেশপত্র অনুযায়ী কাজটির নাম, দপূর্ত-৫০: Development of different infrastructure including beautification of Island, Footpath, Road Median and Construction of public urinal under Dhaka South City Coprporation’ । কাজটির চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৬২ লাখ ৩২ হাজার ৮১২ টাকা। কার্যনির্দেশপত্রে কোথাও গাছ কাটার কথা উল্লেখ নেই। তারপরও সব মিলিয়ে এই সড়কের প্রায় কয়েক শত নানাবয়েসী নানা প্রজাতির ছোট বড় সুস্থ, সবল, পরিণত ও সতেজ গাছ কাটা হয়েছে।

প্রতিবাদী শিশু-তরুণেরা অগ্রজদের নিয়ে গাছে গাছে হাতে লেখা পোস্টার টানায় ‘গাছ কাটা নিষেধ, আদেশক্রমে নগরবাসী’। ৬ মে সন্ধ্যায় মানববন্ধন শেষে নগরের তিনপ্রজন্ম মিলে সড়ক বিভাজকের কাটা গাছের স্থানে নিম, জারুল, হরিতকী ও কামিনী গাছের চারা রোপণ করি। একজন তরুণ শিল্পী ও কিউরেটরের সমন্বয়ে গাছ সুরক্ষার এই লড়াইয়ে সংহতি জানাতে থাকেন দেশের নানা অঞ্চলের বহু মানুষ।

দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে? 

কার্যনিদেশপত্রে উল্লেখ আছে, যদি কাজ করার সময় কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটে তার দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ঠিকাদারের উপর বর্তাবে। কিন্তু একা ঠিকাদার কেন এর দায় নিবে? এর পরিকল্পনাকারী এবং অনুমোদনকারীরা কেন এর দায় নেবে না? ‘দুর্ঘটনা’ বলতে কী বোঝায় তা এখানে স্পষ্ট না হলেও নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে নানামুখী দুর্ঘটনা তো ঘটেছেই। প্রথমত গাছেদের জীবনে এটি এক নির্দয় দুর্ঘটনা। বিশেষ করে রাতের বেলায় যখন গাছ ঘুমিয়ে থাকে কিংবা গাছের ভিন্ন শ্বসনচক্র চলে, তখন তাদের কাটা হয়েছে। গাছেদের ওপর আশ্রয় করে বেঁচে থাকা পাখি-পতঙ্গ ও প্রাণীদের আশ্রয়হীন ও খাদ্যহীন হয়ে পড়া তাদের জীবনের জন্য করুণ দুর্ঘটনা। আর বারবার মানা করা সত্ত্বেও গাছগুলো যে কাটা হলো এটি তো নগরের বহু শিশু-তরুণ-প্রবীণের মনে গভীর মানসিক যন্ত্রণা তৈরি করেছে। কেবল শারীরিক বা অর্থনৈতিক নয়; মানসিক এবং পরিবেশগত দুর্ঘটনাওতো দুর্ঘটনা। এসব কী বিবেচনা করবে না আমাদের নগর কর্তৃপক্ষ? তাহলে আমরা কীভাবে এক সবুজ মমতাময় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবো?  

তপ্ত নগর, অস্বীকৃতি নথি, ঠিকাদারের দুঃসাহস 

আমাদের গাছ রক্ষার আন্দোলনের সময়কালে উত্তপ্ত ঢাকা নগরের তাপ কমাতে সিটি করপোরেশন যখন দুই লাখ বৃক্ষরোপণের ঘোষণা দেয়, ভেবেছিলাম সাতমসজিদ সড়কের গাছকাটা বন্ধ হবে। কিন্তু হয়নি। প্রতিদিন কমতে থাকা সবুজবলয়ের এই নগরে গাছ লাগানোর চাইতে গাছ রক্ষা করাই এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২’এর তফশিলে ৫৭টি সংরক্ষিত বৃক্ষ তালিকায় বট-পাকুড় আছে। সড়কবিভাজকের নানাবয়েসী ১৫টি বট এবং ৮টি অশ্বত্থ গাছ কাটা হয়েছে। উল্লিখিত আইনটির ২৩নং ধারা অনুযায়ীও সড়কের স্মৃতিময় এই বৃক্ষগুলো সংরক্ষণ করার কথা। ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠক ‘বৃক্ষসংরক্ষণ আইন ২০১৬’ নীতিগতভাবে অনুমোদন করে। জাতিসংঘের আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২ এবং ২০২১ সালে গ্লাসগো সম্মেলনে গৃহীত বিশ্বের বৃক্ষ ও বন সুরক্ষা নীতি স্বাক্ষর করেও বাংলাদেশ বৃক্ষ রক্ষায় বৈশ্বিক অঙ্গীকার করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বহুবার বৃক্ষরোপণ এবং বৃক্ষ সুরক্ষায় জোর দিয়েছেন। সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’। 

এমনকি সিটি করপোরেশনের কার্যনির্দেশপত্রেও গাছ কাটার বিষয়টি উল্লেখ নেই? নাকি বৃক্ষ সুরক্ষায় রাষ্ট্রের সংবিধান, আইন, নীতি ও অঙ্গীকারকে ‘সম্মান জানানোর জন্যই’ গাছ কাটার কথা ‘গোপন করা হয়েছে’? তাহলে কী সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার ‘আনিকা এন্টারপ্রাইজ’ গায়ের জোরে রাষ্ট্রের সকল নথি, অঙ্গীকার এবং নগরবাসীর দাবিকে উপেক্ষা করে এই নৃশংস বৃক্ষহত্যা করেছে? ঠিকাদার কোন দর্পে কোন দুঃসাহসে ধানমন্ডি সড়ক বিভাজককে বৃক্ষশূন্য করলো? এর দায়ভার কে নেবে? অবিলম্বে সাতমসজিদ সড়কের গাছ কাটা বিষয়ের নিরপেক্ষ নাগরিক তদন্ত দরকার। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচার ও শাস্তির আওতায় আনাও জরুরি।

গাছ কাটা নিয়ে সিটি করপোরেশনের ‘দায়সারা’ ব্যাখা 

জানুয়ারি থেকে সাতমসজিদ সড়ক বিভাজকে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও চার মাস ধরে গাছ কাটা নিয়ে সিটি করপোরেশন পাবলিক পরিসরে কোনো কথা বলেনি। বা কোনো পাবলিক বার্তাও দেয়নি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতি রাতেই রাত জেগে গাছ পাহারা শুরু করে তরুণরা, তরুণদের সঙ্গ দিতে ধানমন্ডিবাসীদের অনেকেই রাত জাগছেন সড়কে। ৮ মে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন শেষে আমরা নগরভবনে যাই দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ‘সাতমসজিদ সড়ক গাছ রক্ষা আন্দোলনের’ দাবি সংবলিত চিঠি দিতে। মেয়র মহোদয় না থাকায় তাঁর সহকারী একান্ত সচিব চিঠিটি গ্রহণ করেন। এরপর এই প্রথম গণমাধ্যমে সিটি করপোরেশন সাতমসজিদ সড়কে গাছ কাটা বিষয়ে কথা বলেন। ৮ মে প্রকাশিত সংবাদভাষ্য থেকে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন স্বীকার করেছেন জিগাতলা থেকে স্টারকাবাব পর্যন্ত সড়ক বিভাজকের সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তবে সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনা বিভাগ এ বিষয়ে অবগত নয়, তারা জানায় কাজটি করেছে প্রকৌশল বিভাগ।

কেবল গাছ কাটা নয়, সড়কের বহু ক্রসিং বন্ধ করে দেয়ায় তৈরি হওয়া নতুন ভোগান্তি বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) গণমাধ্যমকে জানান, সিটি কর্পোরেশন তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী গণমাধ্যমকে জানান, ...ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর বাসরুট প্রকল্পে বাসগুলো নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য রাস্তার উভয়পাশে সমান প্রশস্ততা রাখতে গিয়ে নিরূপায় হয়ে সড়ক বিভাজক রাস্তার মাঝামাঝি রাখতে গিয়ে গাছগুলো কাটতে হয়েছে। একইসঙ্গে তিনি জানান, ...সাতমসজিদ সড়কবিভাজক তিন ফুট প্রশস্ত, এর মধ্যে দেয়াল করে মাটি ভরাটের কাজ করতে হচ্ছে, তাই গাছগুলো রাখার সুযোগ ছিল না।

সিটি করপোরেশনের গাছ কাটার ব্যাখাটি দায়সারা গোছের এবং এতে প্রমাণিত হয় গাছের প্রতি এই প্রতিষ্ঠান সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল নয়। কারণ বৃক্ষবিশেষজ্ঞ কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো মতামত ও অনুমোদন ছাড়া এসব গাছ কাটা হয়েছে। সড়কবিভাজক বিষয়ে আলাদা নীতিমালা না থাকলেও সিটি করপোরেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘সড়ক খনন নীতিমালা’ আছে। ওই নীতির ১.৭.২ ধারায় বলা হয়েছে, খননকালে যদি ফুটপাত, সারফেস ড্রেন, রোড ডিভাইডার, গাছ এবং অপরাপর সংস্থার সুবিধাদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বরাবর ক্ষতিপূরণের বিল পরিশোধ করতে হবে। যৌথ পরিমাপের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণের বিল নির্ধারিত হবে। সিটি করপোরেশন নগরের ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ করেতে চেয়েছে এবং কার্যনির্দেশপত্রে গাছকাটার বিষয়টি উল্লেখ না থাকার পরেও সড়কবিভাজক খননের কারণে গাছ কাটা হয়েছে। সিটি করপোরেশন কী এখন ঠিকাদারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করবে?

জনগণের নগর, গাছের সিদ্ধান্ত নগরবাসীর 

সাতমসজিদ সড়কে বট, বড়ই, অশ্বত্থ, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিরিষ, জারুল, নিম, কাঠবাদাম গাছগুলো ছিল। বৃক্ষ নয়, বেশকিছু তৃণগুল্ম ও লতাঝোপও ছিল। পাখি, পতঙ্গ, সরীসৃপ দেখা যেত বর্ষাকালে। বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বর্ষায় বটের লাল-কমলা ফল খেতে ভিড় জমাতো কিছু পাখি। গাছ গুলো কেটে নেয়ার পর কিছু বিধ্বস্ত পাখির বাসাও দেখা গিয়েছিল। গাছগুলো ইউক্যালিপটাস, ম্যাঞ্জিয়াম কিংবা একাশিয়ার মতো আগ্রাসী প্রজাতির ছিল না। সড়ক ও নাগরিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল না। নিহত এই গাছগুলোই এতদিন এই সড়ক ও এলাকার সৌন্দর্যবর্ধন করেছে। এসব গাছের পরিবেশগত অবদান এই প্রকল্পের মোট বাজেটের চেয়ে শতগুণ বেশি। গাছ রেখেই সড়ক বিভাজক সম্প্রসারণ করা সম্ভব ছিল।

আমাদের প্রতিবাদের চারমাস পর গাছ কাটা বিষয়ে ব্যাখা দিয়ে সিটি কর্পোরেশন সড়কবিভাজকে আবার নতুন করে গাছ লাগানোর কথাও বলেছেন গণমাধ্যমে। ‘উন্নতমানের দ্রুত বর্ধনশীল গাছ’ লাগানোর অঙ্গীকার করে সিটি করপোরেশন জানায়, গাছ লাগালে গাছে ফুল দেখা যাবে এবং পাখিও বসবে। আমাদের এই গাছ লাগানোর দাবিটি মেনে নেয়ায় সিটি করপোরেশনকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই দেশীয় প্রজাতি হত্যা করে কোনো ‘উন্নতমানের দ্রুত বর্ধনশীল আগ্রাসী’ গাছ লাগাতে চাই না। কাটা গাছের স্থানে বৈচিত্র্যময় দেশীয় প্রজাতি দ্রুত রোপণের দাবি করেছি আমরা। সড়ক বিভাজকে সিমেন্ট, বালু ও কংক্রিট দিয়ে যেভাবে দমবন্ধ স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে তা কোনোভাবেই দেশীয় বৃক্ষপ্রজাতির জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ এতে গাছের কেন্দ্রীয় ও শাখামূলের বিস্তার রুদ্ধ হবে। এভাবে ঝড়ের সময় বা তীব্র বাতাসে গাছ উপড়ে যেতে পারে। সিডর, বুলবুল ও ফণীর সময় উপকূল অঞ্চলে মূলের প্রাকৃতিক বিস্তার রুদ্ধ হয়ে বিপুল বৃক্ষ উপড়ে ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি হয়েছিল।

সিটি করপোরেশনের কাছে দাবি নার্সারি থেকে সহজে কিনে আনা কোনো বাগানবিলাসের ডাল, আগ্রাসী প্রজাতির চারা, আমদানি করা বনসাই কিংবা কয়েকটি ফুলের গাছ লাগিয়ে আবার এই নগর বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশ করবেন না। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, নিম, কদবেল, আমলকি, গোলাচি, বট, কাঠবাদাম, শিরিষ, টগর, তুলসি, ল্যান্টানা, কাঠমালতি, হাস্নাহেনা, বেলী এই রকমের দেশীয় প্রজাতিকে নির্বাচন করা জরুরি। ঋতুভিত্তিক ফুলের প্রস্ফুটনকাল, পরাগরেণু ও এলার্জি সংক্রান্ত সমস্যা, গাছের প্রজাতি বৈচিত্র্য, উচ্চতা এবং পত্র-বিটপ-মূলের বিন্যাস, পাখি-বন্যপ্রাণী ও পতঙ্গ উপযোগিতা, ছায়াপ্রদানকারী এবং প্রাকৃতিকভাবে মশা নিবারণী এমন বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে গাছের বৈচিত্র্যকে নির্বাচন করা জরুরি। তা না হলে কেবল যে কোনোভাবে কোনো তথাকথিত দ্রুতবর্ধনশীল আগ্রাসী প্রজাতি বা কোনো কেবলমাত্র শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগালে তা পাখি ও পতঙ্গের জন্য উপযোগী হবে না। এমনকি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের এই অঞ্চলে এলার্জিনিত সমস্যা তৈরি করতে পারে। ঋতুভিত্তিক প্রস্ফুটনকালকে গুরুত্ব দিলে বছরব্যাপী সড়কজুড়ে বর্ণময় ফুলের বিভা থাকবে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ...গাছকাটার বিষয়টি তাকেও ব্যক্তিগতভাবে কষ্ট দিয়েছে। অবশ্যই প্রধান প্রকৌশলীর কষ্ট লাগার কথা। কারণ প্রতিটি সংবেদনশীল এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার কলিজাই এই নির্মম বৃক্ষহত্যায় ছলকে ওঠেছে। শিশু, তরুণ থেকে প্রবীণ কত মানুষ প্রতিদিন এই সড়কে যাতায়াত করে। সবার একই প্রশ্ন ‘গাছ গুলো কেন কাটা হচ্ছে?’ এমনকি সড়কবিভাজক নির্মাণকাজে আসা শ্রমিকেরাও বিষণ্ন ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন কারণ তাদের গাছ কাটার কথা বলা হয়নি, রাস্তা ঠিক করার কথা বলা হয়েছিল। ৯ মে রাতে ভেকু মেশিন নিয়ে মালিক আর গাছ কাটবেন না বলে চলে গেছেন। জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। সাতমসজিদ সড়কের গাছ রক্ষার আন্দোলনে সামিল হওয়া বেশিরভাগ তরুণই নতুন ভোটার। এদের বিচারবিবেচনায় এই নিদারুণ বৃক্ষহত্যা এক জীবন্ত প্রশ্ন হয়ে থাকবে। বর্ষাকালও আসন্ন। দেশব্যাপী বাংলাদেশ বৃক্ষরোপণের উৎসবে মাতবে। আসন্ন পরিবেশ দিবসের আগে কী আমরা সাতমসজিদ সড়ককে আমাদের আস্থা, অঙ্গীকার আর দায়িত্বশীলতার সবুজ বলয়ের বীজ বুনতে পারবো?