প্রশান্তপাড়ে বঙ্গবন্ধুর দ্যুতি

আজ সিডনি, মেলবোর্নসহ বড় বড় শহরে বাংলাদেশিদের মুখর জীবন দেখলে মনে হয় না আমরা নবীন জাতি। কিংবা আমাদের বয়স মাত্র ৫০ বছর। সদর্পে উঠে আসা এই জাতির ভিত্তিভূমি তৈরি করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 15 August 2022, 12:44 PM
Updated : 15 August 2022, 12:44 PM

প্রশান্ত পাড়ে বসবাস আমাদের। প্যাসিফিক ওসানের নাম প্রশান্ত দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি কখনো এদেশে আসেননি। একইভাবে বঙ্গবন্ধুও বাংলাদেশিদের পদভারে মুখরিত এদেশে আসেননি কখনো। তাতে কী? এ দুই বাঙালি শ্রেষ্ঠই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। আজ সিডনি, মেলবোর্নসহ বড় বড় শহরে বাংলাদেশিদের মুখর জীবন দেখলে মনে হয় না আমরা নবীন জাতি। কিংবা আমাদের বয়স মাত্র ৫০ বছর। সদর্পে উঠে আসা এই জাতির ভিত্তিভূমি তৈরি করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার জীবন ও সংগ্রামের দিকে ফিরে তাকালেই বোঝা যায় বাঙালিকে একটি স্বাধীন দেশ, এক নতুন পরিচয় দেওয়ার জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তিনি।

আমাদের বেশিরভাগ মানুষই এই ঋণ স্বীকার করেন। তারা কোন দল করেন বা রাজনীতি আদৌ করেন কিনা তা বড় বিষয় না। বড় কথা সবাই মিলেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবনত থাকতে চান। কিন্তু এই সবাই-এর ভেতর একটা ছোট ফাঁক আছে। একদল বাংলাদেশি নামে পরিচিত পাকিস্তানপ্রেমীরা এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। তারা ভুলে যায় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানোই আমাদের কর্তব্য। বঙ্গবন্ধুর কল্যাণে সবুজ পাসপোর্ট নতুন দেশ আর নতুন উৎসাহ এখন দানা বেঁধেছে।

যখন আমরা আগে তাদের বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিতাম এদের বেশিরভাগই চিনতে পারত না। ভাবত ভারতের কোনো অংশ। ওই কুয়াশা কেটে গিয়েছে। এমন সব এলাকা এখানে আছে যাতে সগর্বে মাথা তুলে বিরাজ করছে মিনি বাংলাদেশ। সম্প্রতি এখানকার জনপ্রিয় টিভি এবিসি চ্যানেলে আমার একমাত্র সন্তান অর্ক নির্মিত আট সিরিজের ফুড শো শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের খাবার ও বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা লেকেম্বাকে কেন্দ্র করে। মিনি বাংলাদেশের এই গর্ব আনন্দ আর উৎসাহের মূল বীজ নিহিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্নে।

এদেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক শুরু থেকেই নিবিড়। অস্ট্রেলিয়া প্রথম শ্বেতাঙ্গ দেশ যারা আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল। এদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত যিনি আমাদের দেশে গিয়েছিলেন তিনি বাংলা জানতেন। বাংলা জানার কারণে তার যোগাযোগ ছিল নিখুঁত। এদেশের মান্যবর নেতা গফ হুইটলাম প্রথম তেমন এক অতিথি যিনি বাংলাদেশ সফর করে পশ্চিমা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। দেবেন না-ইবা কেন?

আমি পিটারকে চিনি কর্মসূত্রে। খাঁটি অজি পিটার যখন জেনেছিল আমি বাংলাদেশি, এক অপার্থিব আনন্দে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সেদিন। জেনেছিলাম, তার বড় ভাই ছিলেন জর্জ হ্যারিসনের দলে। বাংলাদেশ কনসার্টের সাথে সম্পৃক্ত পরিবারের সন্তান পিটার আমাকে পাইয়ে দিয়েছিল একটি ক্যাসেট। জানিয়েছিল সিডনির বেলমেইন এলাকার কোনো দোকানে এই ছবিগুলো সযত্নে জমা আছে। পিটার বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনটিকেও মনে রেখেছে। ও-ই আমাকে জানিয়েছিল পরদিন অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া খবরের কাগজগুলো হতভম্ব আর বিষণ্ন খবরে জানিয়েছিল, এমন নেতাকেও কেউ হত্যা করতে পারে তা-ও নিজের দেশের সেনাবাহিনীর কিছু লোক এটা ভাবা মুশকিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে মানুষটি বিমর্ষ থাকতেন, তার হত্যাকাণ্ডে উল্লাসিত এক কর্মচারীকে বাটা কোম্পানি থেকে বহিষ্কার করা বাটার সিইও ছিলেন ডাচ অস্ট্রেলিয়ান ওডারল্যান্ড। একমাত্র বিদেশি বীর প্রতীক ওডারল্যান্ড এই হত্যাকাণ্ডের পর নিজ দেশে ফিরে আর কখনো আসেননি বাংলাদেশ। এমনকি সংবধর্না নিতেও আসেননি তিনি। মাত্র একবার টেলিফোনে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। বহু চেষ্টার পর ওই যোগাযোগে তার পত্নী আমাকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর তিনি আমাদের ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ। কথাই বলতে চান না কারও সাথে। তারপরও তাকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড যে কত বিদেশির মনে এমন প্রভাব ফেলেছে, আমরা তার খবর রাখিনি। আমাদের দেশে হয় স্তাবকতার উল্লাস নয়তো নিন্দার বাইরে কিছু থাকে না। পঁচাত্তরের পর থেকে ক্রমাগত বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা আর মিথ্যাচারে তিনি হয়তো ঢাকা পড়ে যাননি কিন্তু ঝাপসা হতে শুরু করেছিলেন। এখন চলছে বঙ্গবন্ধু স্রোত। কিন্তু যে কাজগুলো করলে আমাদের নেতা সারা দুনিয়ায় তার পরিচয় নিয়ে উদ্ভাসিত হবেন, যা যা করলে তিনি আজীবন ওই জায়গায় থাকবেন তার নমুনা এখনো দেখি না। অথচ সেই কবে তিনি জাতিসংঘে তার ভাষণে, ‘মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস এবং মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতার’ ওপর প্রত্যয় ব্যক্ত করে। তিনি বলেন, “আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি, কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি...জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।”

আমার এক বন্ধুর স্ত্রীর পরিবারের গল্প জানি। যার পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন। ওই ভাষা সৈনিকের পত্নী এসেছিলেন এদেশে। আমার সাথে তার কোনোকালে দেখা না হলেও সিডনি ভ্রমণকালে লেখা তার ডায়েরি পড়েছি আমি। একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ ডায়েরির প্রতিটি পাতায় জ্বলজ্বল করছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভদ্রমহিলা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যে কাজটি করেছিলেন আসলেই তা সত্য। আমরা কেউই হয়তো এদেশে আসতে পারতাম না। আর পারলেও আমাদের দেশ থাকত অপরের দেশ। গর্ব করে বলার মতো কতকিছুই থাকত না আমাদের। কেবল একটি মাত্র মানুষ এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে গিয়েছেন। আজ দেশে যারা বুঝে না বুঝে তাকে নিয়ে শোকের নামে মাতম করে বা অস্বীকারের নামে পাপ করে তাদের কারও ধারণা নাই কেমন এবং কতটা শক্তি রাখতেন এই দীর্ঘদেহী বাঙালি।

তখন বাংলাদেশকে তেমন করে কেউ চিনত না, জানত না। তার পরিচয় টিকবে কি টিকবে না এ নিয়ে চলছিল তর্ক। আমেরিকা, চীনসহ শক্তিধর দেশগুলোর অনেকেই গুজব আর তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আত্মতৃপ্তিতে মগ্ন। তখন শুধু মানুষের ভালোবাসা আর নিজের শক্তির ওপর ভর করে এই মানুষটি আমাদের পরিচয় করাতেন বিদেশের সাথে। যে কারণে তার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর সুদূর প্রশান্তপাড়েও শোকের ছায়া নেমেছিল। আর্কাইভ থেকে তখনকার পত্রিকাগুলো খুলে দেখে অবাক হয়েছি, যে দেশের কোনো কোনো শহরে একজন বাঙালি ও বাস করত না সেদেশের মিডিয়া ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল ওই হত্যাকাণ্ড। স্তব্ধ হয়ে বলেছিল, এটাও সম্ভব?

বঙ্গবন্ধুর মতো বাঙালি আমাদের ভূখণ্ডে ও ইতিহাসে আর জন্মায়নি। তাকে মাতম বা দূরে সরিয়ে রাখলে আমাদের কোনো লাভ হবে না। দেশে-বিদেশে সব তর্ক সব রাজনীতির ওপরে তার অবস্থান। তিনিই আমাদের পিতা, আমাদের বন্ধু, আমাদের বঙ্গবন্ধু।