বৈষম্য কমানোর বাজেট চাই

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 6 June 2022, 03:57 PM
Updated : 6 June 2022, 03:57 PM

জাতীয় , সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট পেশ করা হবে ৯ জুন, বৃহস্পতিবার। এবারের বাজেটের আকার হবে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বছর বছর বাজেটের আকার বাড়লেও জনপ্রত্যাশার সত্যিকার প্রতিফলন বাজেটে কতটুকু ঘটে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ ও আলোচনার সুযোগ আছে। আগামী বছরের শেষ দিকে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই এবারের বাজেট জনতুষ্টিমূলক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বাজেটে কী হবে- তা ঠিক হয়েই আছে। তারপরও একেবারে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি থেকে বাজেট নিয়ে কিছু কথা এখানে বলা হচ্ছে। 

বাজেট প্রত্যেক সরকারের একটি নিয়মিত বাৎসরিক কার্যক্রম। প্রতি বছর ব্যতিক্রমহীনভাবেই বাজেট পেশ করা হয়। বাজেট কারো কারো কাছে শুধু কিছু হিসাব-নিকাশের ব্যাপার। কারো কাছে বা বাজেট হলো সরকারের পথ চলার নির্দেশিকা-দলিল। সরকারের সারা বছরের কর্মপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের অর্থের জোগানের উৎস এবং উপায় সম্পর্কে ছক এঁকে দেওয়া হয় বাজেটে। বাজেট পেশের আগে পরে এটা নিয়ে যতটা আগ্রহ- কৌতূহল দেখা যায়, বাকি সময়ে তা থাকে না।

সাধারণ মানুষ বাজেটের নানা পরিসংখ্যান বা সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। বাজেট যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাও অনেকের কাছে অজানা। যারা খেটে খাওয়া মানুষ, প্রতিদিন কাজ না করলে যাদের মুখে আহার জোটে না তাদের কাছে লাখ লাখ কোটি টাকার বয়ান-বিবরণ বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে না।

বাজেট যারা তৈরি করেন, পেশ করেন- তারা মনে করেন সেরা বাজেটই তারা জাতিকে উপহার দিয়েছেন। কিন্তু যারা ক্ষমতার বাইরে তারা বাজেটকে বরাবরই 'গরিব মারার' হাতিয়ার বলেই মনে করেন। বাজেট ঘোষণার আগেই 'গরিব মারার বাজেট মানি না' ব্যানার নিয়ে মিছিল করা এক সময় রেওয়াজ হয়েছিল। এখন তা কমে এলেও বাজেট নিয়ে ভিন্ন উপায়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয় না। 

বাজেটের হিসাব-নিকাশ না বুঝলেও সাধারণ মানুষ তার অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বুঝেছে যে বাজেট মানে জিনিসপত্রের দাম বাড়া। এমনিতেই আমাদের দেশে বাজার ব্যবস্থা এতোটাই 'মুক্ত' বা 'স্বাধীন' যে, তার ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পণ্য মূল্য নির্ধারণের কোনো ব্যাকারণ না মেনে মুনাফালোভী ব্যবসায়ী, মজুতদার এবং সিন্ডিকেট খেয়ালখুশি মতো দাম বাড়িয়ে ক্রেতা-ভোক্তাদের পকেট কেটে নিজেদের পেট মোটা করে থাকেন। কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন নিয়ে চলে ভেল্কিবাজি। উৎপাদক কৃষক ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হলেও পাইকার, মধ্যস্বত্ত্বভোগী এবং চাঁদাবাজদের কারণে ভোক্তাদের পকেট ঠিকই কাটা যায়। আমদানি পণ্য, শিল্প পণ্যের দামও কোনো বাধাধরা নিয়ম মেনে চলে না।

অনিয়ন্ত্রিত বাজার বাজেটের পর আরেক দফা চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাজেটে কর, ভ্যাট, নানা ধরনের শুল্ক আরোপ যেমন করা হয়, তেমনি ছাড়ও দেওয়া হয়। দাম যেসব পণ্যের কমার কথা, সেগুলো কমে না। কিন্তু যেগুলো বাড়ার কথা সেগুলো ঠিকই বাড়ে। আমাদের দেশে যৌক্তিক কারণে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে, সেটা আর কমে না। তাই বাজেট মানে সাধারণ মানুষের কাছে মূল্যবৃদ্ধির আতঙ্ক। নতুন বাজেট পেশের পর ব্যতিক্রমী প্রতিক্রিয়া হবে বলে মনে হয় না। তবে সরকারের উচিত হবে বাজেটের কারণে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির যে চক্র তাদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। সব ক্ষেত্রেই  স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হওয়া উচিত।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। এ বছর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল যে বাজেট পেশ করবেন, তার আকার ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিশাল উল্লম্ফন!  এত লাখ কোটি টাকার হিসাব সাধারণ মানুষের মাথার ওপর দিয়ে যায়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে বহুদূর এগিয়েছে। ৫০ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৬৬ গুণ। এই সময়কালে অসম্ভবকেই আমরা সম্ভব করেছি। ১৯৭১ সালে দেশে জনসংখ্যা ছিল সাত-সাড়ে সাত কোটি। অথচ তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল। এখন দ্বিগুণের বেশি মানুষের খাদ্য উৎপাদন দেশেই সম্ভব হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই হয়েছে প্রভুত উন্নতি। কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলায় 'মঙ্গা' বলে যে দুর্যোগ ছিল, এখন তা অতীতের বিষয়।

তবে এটাও ঠিক, এগিয়ে যাওয়ার চিত্র যেমন চোখে পড়ে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়াটাও স্পষ্টতই দৃশ্যমান। কিছু ক্ষেত্রে আমরা সংখ্যায় এগিয়ে গুণ-মানে পিছিয়ে পড়ছি। দুর্নীতি-অনিয়মের বৃত্তে বন্দি হয়ে আমরা এক ধরনের খাবি খাচ্ছি। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাসের মরণ থাবায় বিশ্বব্যাপী যে অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। করোনাভাইরাস নামের এই বৈশ্বিক মহামারি বাংলাদেশের মানুষের কাছেও অভিশাপ হিসেবেই এসেছে। করোনার কারণে প্রায় সবক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, ৬২ শতাংশ মানুষ করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনার নানামুখী উদ্যোগে বেশ সুফল পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু করোনার অভিঘাতে কমপক্ষে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ আবার দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে।

করোনাকাল একেবারে শেষ হওয়ার আগেই সামনে এসেছে নতুন দুর্যোগ- ইউক্রেইন যুদ্ধ। রাশিয়া আক্রমণ করেছে ইউক্রেইনকে। ইউক্রেইন রাশিয়ার তুলনায় শক্তিসামর্থ্যে দুর্বল হলেও হার মানছে না সহজে। কয়েক মাস ধরা যুদ্ধের প্রভাব ওই দুই দেশের মধ্যেই সীমিত নেই। সারা বিশ্বজুড়েই এর ধাক্কা লাগছে। যুদ্ধের কারণে যুক্তিসঙ্গত কারণেও পণ্য মূল্য বাড়ছে, আবার যুদ্ধের অজুহাতেও দাম বাড়ছে। আমাদের দেশে সব জিনিসপত্রের দাম উর্ধ্বমুখী।  অসংখ্য মানুষের এখন  চলছে চরম কষ্টের সময়। মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ছে। কর্মহীনও হচ্ছে । আয়-রোজগার না থাকলে মানুষ কীভাবে ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিজয়ী হবে? বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনে যখন সীমাহীন দুর্দিন, তখন  যে বাজেট ঘোষণা হবে, তাতে মানুষের কষ্ট লাঘবের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন।

সাধারণ মানুষ চায়, সরকার এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করুক যাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অচলায়তন তৈরি হয়েছে তা দূর করতে না পারলে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। স্বাস্থ্যখাতে যেসব ত্রুটি-দুর্বলতা, অনিয়ম, সমন্বয়হীনতা দেখা যায় সেগুলো কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয় সব কিছু করতে হবে। স্বাস্থ্য গবেষণায় বরাদ্দ বাড়িয়ে রোগ প্রতিরোধের উপায় উদ্ভাবনে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নয়নে সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

শিক্ষা ক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে। কেবল প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা ছাত্র সংখ্যা বাড়লেই হবে না। শিক্ষার গুণগত মানের দিকেও সমান নজর দিতে হবে। শিক্ষা গবেষণায় উৎসাহী করে তোলার জন্য অর্থের বরাদ্দ থাকতে হবে। আমাদের দেশের মেধাবী তরুণরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাদের দেশে রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।

যোগাযোগব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নই সব নয়। মানুষ কীভাবে অধিকতর মানবিক হয়ে উঠতে পারে তার দিকে মনোযোগী হতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, কর্মক্ষম সব মানুষের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় এনে সহায়তা দেওয়া ভালো কিন্তু মানুষকে সাহায্য-নির্ভর না করে উপার্জনের উপায় করে দিতে হবে। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে নিশ্চয়ই সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। তবে সরকারের সুদৃষ্টি শুধু বড়দের দিকে থাকলে হবে না। ছোট এবং মাঝারি উদ্যোক্তাদের দিকেও সহায়তার হাত বাড়াতে হবে। ৭৫ লাখের মতো এসএমই উদ্যোক্তাকে সহজ শর্তে ঋণের আওতায় আনলে উপকার পাওয়া যাবে। বড়রা ঋণ নিয়ে ঘি খাওয়ার চেষ্টা করলেও ছোটরা ঋণের টাকার সদ্ব্যবহার করে থাকেন। তাই সরকারের প্রণোদনার সুষম বণ্টন হতে হবে। তেলা মাথায় তেল দেওয়ার নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। 

মানুষ দেখতে চায়, কাজীর গরু কেতাবে নয়, গোয়ালেও থাকুক। কেবল কাগুজে হিসাব মানুষকে চাঙা করতে পারে না। হাতেনাতে ফল পেলেই মানুষ উৎসাহিত হয়। কত লাখ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা হলো, সেটা সাধারণ মানুষের কাছে বড় বিষয় নয়। বড় প্রকল্প মানে বড় দুর্নীতি – এই ধারণা যে অসত্য সেটা কিন্তু প্রমাণ হয়নি। তাই বাজেটে মোটা অঙ্কের বরাদ্দ থাকলেই হবে না। দুর্নীতি-অপচয় বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থাও থাকতে হবে। কিছু মানুষের আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার সিস্টেম বদলাতে হবে। দরিদ্র মানুষের বিপন্নতা বাড়িয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দেশে সামাজিক স্থিতি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে । সামাজিক অস্থিরতা উন্নয়নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই প্রতিকারের ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। 

সাধারণ মানুষ দেখতে চায়, তার প্রতিদিনের জীবন যাপনে বাজেট কী উপকারে আসছে। মানুষ কাজ চায়, নিরাপদ জীবন চায়। আয় ব্যয়ের সঙ্গতি চায়। বৈষম্যের শিকার হতে চায় না। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই, সন্তানদের শিক্ষা, সবার মুখে আহার জোগানের মতো একটি কাজ, রোগবালাইয়ে চিকিৎসার সুযোগ পেলেই সাধারণ মানুষ পরম সুখ অনুভব করবে। মানুষ কথা অনেক শুনেছে। অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এবার কাজে সবকিছুর প্রমাণ পেলেই তারা স্বস্তি অনুভব করবে। নতুন বাজেট সাধারণ মানুষকে কতটুকু স্বস্তি দেয়– দেখার বিষয় সেটাই।

আশার কথা এটাই যে, একসময় বাজেট পেশের আগে আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রীরা সাহায্যের আশায় ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিদেশে দাতাদের দুয়ারে ধরনা দিতেন। এখন অবস্থা বদলেছে। এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। দেশে একদিকে ধনী বাড়ছে, একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরিবও। ধনী গরিবের বৈষম্য কমাতে আগামী বাজেট কোনো ভূমিকা রাখবে কি?