উপদ্রুত উপাখ্যান কিংবা অবরোধের কলকব্জা- ‘রেহানা মরিয়ম নূর’

Published : 23 Nov 2021, 03:23 PM
Updated : 23 Nov 2021, 03:23 PM

'আমি দম নিতে পারছিনা' কিংবা দমে আপনার অধিকার নেই! 

'আজ এই পৃথিবীর অন্ধকারে মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস 

কেবলি শিথিল হ'য়ে যায়; তবু তুমি সেই শিথিলতা নও…'

(তবু- কবিতায় বলছেন জীবনানন্দ দাস।) 

আপনার খটকা লাগবে, তবু আপনি খিঁচ খাবেন! প্রশ্নের উৎপাতে নীল হবেন। রেহানা এমন কেন? 'রেহানা মরিয়ম নূর' আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ-এর নির্মাণ। তিনি এ চলচ্চিত্রের পরিচালক শুধু নন, লেখক এবং সম্পাদকও। এখানে রেহানা যেভাবে হাজির, গল্পের যে চলন, চিত্রভঙ্গি, তাতে রেহানা কেন এমন, এই প্রশ্নের আপাত কোনো র‌্যাশনাল বা কনটেক্সট আপনি পাবেন না। 

রেহানা কেমন? রেহানা উপদ্রুত, বিরোধপূর্ণ! চাপা-ক্ষ্যাপা-রূঢ়-একগুঁয়ে-তীর্যক, সহজ নয়। 'সহজ লোকের মত কে চলিতে পারে!… তাদের মতন ভাষা কথা কে বলিতে পারে আর।' পারে না। 

জীবনানন্দের এই আলাপের মতোই যেন রেহানা, 'সকল লোকের মাঝে বসে নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা?' কিন্তু ততক্ষণে আপনার চোখে শুধু ধাঁধা। যেন আপনিও রেহানার মতো অবরুদ্ধ! একে ফ্লোটিং ক্যামেরা, তার ওপর চেপে বসা টাইট ফ্রেম। কোথাও ব্রিদিং স্পেস নেই! তাই বড় বড় নিঃশ্বাসের চাপ, বিষণ্ণ শ্বাস-প্রশ্বাস, হঠাৎ দম মেরে আবার লাফিয়ে ওঠা জীবনের চাপাস্বর, যেন আপনি চড়ে বসেছেন এক রোলার কোস্টারে! 

সেই কোস্টার তীব্র গতিতে আপনাকে আছড়ে ফেলবে, দরজা বন্ধ করে দেবে আপনার নিঃশ্বাসের উপর, যখন আপনি দেখবেন ডক্টর রেহানার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লোকেরা। এই যে অবরোধ, এই যে আতংক, তখন হাসপাতালকে আপনার একটা চরিত্র মনে হবে, মনে হবে সমাজ! রেহানা কেন এমন, তার উত্তরটা এখানেই। যেটা সাদ বলেননি চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড কোনো ঘটনা বা আলাপ দিয়ে। বরং দর্শক আপনি, আমি, প্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজ এখানে সেই চরিত্র যে বা যারা রেহানার এমন হয়ে ওঠার কারণ! উপদ্রুত রেহানা। 

দ্বিতীয়বার সেই রোলার কোস্টার ধীর গতিতে আপনাকে নেবে আরেক তীব্রতায়। সেখানে আপনি আবার আছড়ে পড়বেন, ক্ষেপে উঠবেন। সংক্ষুব্ধ, দমবন্ধ আপনি, যখন দেখবেন এবার রেহানা নিজেই সেই সমাজ, সেই প্রতিষ্ঠান, যে তার ছোট্ট মেয়েটার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। অবরুদ্ধ করে তার সন্তান ইমুকে! উপদ্রুত ইমু!

অথবা এ চিন্তাও আপনাকে অ্যারেস্ট করতে পারে যে, রেহানা চায়না তার মেয়ে 'সরি' বলুক এমন সমাজ, এমন স্কুলকে। এখানেও মনে পড়ছে জীবনানন্দ- 'সন্তানের জন্ম দিতে দিতে যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়, / কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয় যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চ'লে / জন্ম দেবে- জন্ম দেবে ব'লে / তাদের হৃদয় আর মাথার মতন / আমার হৃদয় না কি? / তাহাদের মন আমার মনের মতো না কি? / তবু কেন এমন একাকী? তবু আমি এমন একাকী!' 

একাকী মানুষের মূল্যবোধ থাকে, কিন্তু বোধের মূল্য থাকে কি? 

 'অবরোধবাসিনী'র নতুন বয়ান কিংবা যখন গোটা সমাজ একটা হাসপাতাল! 

রেহানা মরিয়ম নূর একইসাথে নারীর গল্প, পুরুষের গল্প, সন্তানের গল্প। সম্পর্কের গল্প! এটা অথর ফিল্ম। রেগুলার পরিচালকের মতো নন এই সিনেমার নির্মাতা সাদ। কোলাবোরোটিভ ওয়ার্ক বটে, তবে সাদই এখানে মূল শিল্পী। যেমন করে আমরা একজন পেইন্টার বা নোভেল রাইটারকে দেখি এখানে সাদ তেমন। আমাদের নাড়া দিয়েছে, বাংলা সাহিত্যে এমন বেশকিছু চরিত্রের নাম বলা যাবে। কিন্তু বাংলা সিনেমায় বলা যাবে, এমন কয়টি আছে? সেই গুটিকয় চরিত্রের একটি এখন রেহানা। 

প্রশ্ন হচ্ছে, রেহানা যেন জীবন নয়, যাপন করছে কতোগুলো সম্পর্ক। তবে কি এসব সম্পর্কে জীবন নেই? রেহানার ভাই রনি যখন তাকে জিজ্ঞেস করে, শেষ কবে মেয়েটাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে গেছে তখন রেহানাকে কী মনে হয়- সংবেদনশীল? নানা সম্পর্কের অবিশ্রাম দৌড়ের মধ্যে রেহানা। সে ডাক্তার, শিক্ষক, সহকর্মী, বোন, নারী এবং সিঙ্গেল মা। এগুলো কি নিরেট সম্পর্ক, না ক্ষমতা সম্পর্কও বটে? এ সম্পর্ক শেষে গিয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে। এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কের কতগুলো ধারণা বা আদর্শিক ন্যারেটিভ আছে, কলকব্জা আছে। যেটাকে আলথুসের বলছেন আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস বা আইএসএ। যার প্রতিনিধি এখানে রেহানার সহকর্মী ডক্টর আরেফিন, যৌন নিপীড়নের অভিযোগ যাকে নিয়ে। রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাসও আছে যেটা আরএসএ। কলেজের নারী প্রিন্সিপাল হয়ে ওঠেন সেই আরএসএ-র প্রতিনিধি। ছাত্রী অ্যানি হয়ে উঠেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর রিরংসার মুখ। সবার সাথে সম্পর্কিত রেহানা, সহজ গল্প কিন্তু সহজ নয়। দর্শক হিসেবে আপনি এবং চরিত্র হিসেবে রেহানা কিংবা আমরা কেউই এমন 'আইএসএ'র বাইরে নই। কিন্তু রেহানা সম্পর্কগুলোর অস্বস্তি হাজির করে। আপনার মনে হবে আপনি নিজে হাসপাতালে কিংবা গোটা সমাজই একটা হাসপাতাল। হাসপাতাল ধারণা দেয় আরোগ্যের, কিন্তু আরোগ্য আসেনা, কারণ ভেতরে আবার কারাগার। যেন আমরা সবাই ফুকোর ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশনে, দ্য গ্রেট কনফাইনমেন্টে! এ যেন অন্য সময়ে বেগম রোকেয়ার 'অবরোধবাসিনী'র নতুন বয়ান। 

কলকব্জা বদলেছে, অবরোধ রয়ে গেছে! 

ধূসর নীল পান্ডুলিপি কিংবা প্যারাডাইম শিফট! 

যখন ছবিটির ট্রেলার এলো তখন দর্শক, আপনার সামনে যেন হাজির এক দমের গল্প। যেন পৃথিবীর বাইরে গিয়ে ভয়েজার থেকে তোলা পৃথিবীর সেই ছবি, কার্ল সেগান যা দেখে বলেছেন 'ধূসর নীল বিন্দু'। আর সেই 'ধূসর নীল বিন্দু' রেহানা মরিয়ম নূর যখন মুক্তি পেলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে, তখন দেখলেন আপনি নিজেই তার মধ্যে, তারই অংশ! দেখছেন ধূসর নীল পান্ডুলিপি, যার ভেতরে দ্বন্দ্ব-ক্লেদ-ক্লিষ্ট সব মুখ। মানুষের এক উপদ্রুত উপাখ্যান। আপনি বিব্রত!  

এই প্রথম বাংলা ভাষার কোনো সিনেমা যেন আপনাকে সন্ত্রস্ত করছে! যেমন হিচককের 'সাইকো' সন্ত্রস্ত করেছিল পাশ্চাত্যের দর্শককে সেই সত্তরের দশকে। কিংবা আর্থার পেন- এর ছবি 'বনি অ্যান্ড ক্লাইড' যার ট্যাগলাইন ছিল- 'they are young, they are in love, they kill people'। ছবির বিষয়-আলাপ-ভাষার এই যে বদল, এই যে নিউ ওয়েভ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট নির্মাতারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে কাজটি শুরু করেছেন আশির দশক থেকে বিপুল উদ্যমে, এই একুশ শতকের প্রথমভাগে এসে তরুণ নির্মাতা সাদ-এর চলচ্চিত্রটি হলো সেই ধারার- প্যারাডাইম শিফট। 

এই সিনেমার সাবটেক্সট হচ্ছে সাউন্ড। সাইলেন্সও এখানে আপনাকে সাফোকেট করে। তরুণ সাউন্ড ডিজাইনার শৈব তালুকদার এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন, লোকেশানে প্রডিউস করেছেন এমন দুধর্ষ শব্দ। ছবির অ্যাম্বিয়েন্স, একটা যেমন, পর্বতারোহী ওয়াসফিয়ার খবর যেন বার্তা দিচ্ছে রেহানার কঠিন সিদ্ধান্তের। আপনার মনে হবে ছবি জুড়ে সেঁটে দেয়া নীল ফিল্টার, আসলে শ্যুটই হয়েছে ওই কালার টেম্পারেচারে। লোকেশন লাইটকে কাজে লাগিয়ে, হ্যান্ড হেল্ডে আপনাকে নাড়িয়ে দেওয়া দৃশ্যের পর দৃশ্যে রেহানার জটিল-অস্থির মনঃস্তত্ত্বকে নির্মম চিত্রভঙ্গিতে হাজির করেছেন তরুণ সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন তামিজুল। তরুণ কালারিস্ট চিন্ময় রয় যে টোন টেনেছেন ছবি জুড়ে, তা একসময় কোথায় যেন আপনাকে বিবর্ণ করে। রঙও কখনো কখনো করে বিপন্ন! পরিচালক সাদ নিজেই বলেছেন, ছবির পেছনে রয়েছে তিন বছরের লম্বা জার্নি। এখানেই মেটার করে প্রস্তুতি, প্রোডাকশন ডিজাইন, যে দুরন্ত কাজটি করেছেন আলী আফজাল উজ্জ্বল। প্রি থেকে পোস্ট প্রোডাকশনের সকল ধাপ দেশেই করেছেন এই তেজী তরুণ দল। আর অভিনয় আপনার বিশ্বাসকে করবে তাড়িত, আপনি হয়ে উঠবেন তাদের কিংবা তারা আপনার প্রতিবেশী। ডক্টর আরেফিনের চরিত্রে সামি হাসান, রনির চরিত্রে ইয়াসির, অ্যানির চরিত্রে আফিয়া বর্ণ- এর অভিনয় দেখে মনে হবে এদের আপনি জানেন, মনে হবে না সিনেমায় এটি তাদের প্রথম কাজ। অবশ্য ততক্ষণে আপনার হৃদয়ে দখল নিয়েছে ইমু চরিত্রের ছোট্ট শিশু জাইমা। আর রেহানার নাম ভূমিকায় আজমেরি হক বাঁধন টেনে নিয়ে গেছে আপনাকে জোরালো, নিবিড়- তবে উচ্চকিত। দীর্ঘসময় একই লয়ে বাঁধা, তার আছে, তম্য নেই। ধারণা করি, এই অভিনয়রীতি সাদের ডিজাইন করা। বেশ কয়েক জায়গায় তার প্রোফাইল কাজেও লাগিয়েছেন তিনি। ক্রিটিক্যালি দেখলে, বাঁধন এখানে একমাত্র অভিনয়শিল্পী যার দীর্ঘ অডিও-ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু এই ছবির আগে তার কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ জানা যায় না। এখানেই বোঝা যায় কাস্টিং ডিরেক্টর ইয়াসির আল হক তার কাজটি ক্রিয়েটিভলি করেছেন।  অভিনয়ে এদের সবার বিকল্প পাওয়া যাবে, কিন্তু জাইমা, মানে ইমু, তার বিকল্প কঠিন। আর যেহেতু অথর ফিল্ম তাই এখানে মূল শিল্পী পরিচালক সাদ, যে দৃশ্যের বাইরে, কিন্তু তার হাতেই সব দৃশ্য, সব চরিত্রের প্রাণ। পান্ডুলিপি থেকে টান টান সম্পাদনার টেবিল, দেখা যায় এক সংবরণ-সবল নির্মাণ। তবু কথা থাকে, যেমন আছে জীবনানন্দে- 'আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ / পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু / দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত  ভাই বোন বন্ধু পরিজন প'ড়ে আছে / পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন / মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।' 

গভীর অসুখই তাই শেষ নয়, মানুষের হৃদয়ে তবু সংবেদন থাকে, সে সংবেদনের প্রতি কতোটা সংবেদনশীল রেহানা মরিয়ম নূর নির্মাতা সাদ? এখানে তিনি নিজেই কি তার পান্ডুলিপির মতো ধূসর? 

'কোনো বার্তা দিতে চাইনি' তবু বলছি 'ইনভেস্টিগেশন' 

সাদ দৃশ্য নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু থাকতে চান দৃশ্যের বাইরে। 'অ্যাটেনশন' তাকে বিচলিত করে। এমনই ধারণা দিলেন তিনি দেশের গণমাধ্যমের জন্য আয়োজিত প্রেস শো এবং প্রেস মিটে। সকল প্রশ্ন তখন পরিচালক সাদকে লক্ষ্য করে। ছবিজুড়ে রেহানার আচরণ কেন সিনিক্যাল, মেয়েকে কান ধরে উঠবস করানো, ঘরে ছুঁড়ে দরজা বন্ধ করে দেয়া, আটকে রাখা, এমন নিষ্ঠুরতা কী বার্তা দেয়? দর্শক, আপনিও যেমন হলে বসে নানা প্রশ্নের উৎপাতে, তেমনি সব প্রশ্নে সাদ বলছেন, 'আমি কোন বার্তা দিতে চাইনি'। বলছেন, এটি একটি 'ইনভেস্টিগেশান', 'এক্সামিনেশান'। 

এখানেই আমার সাদের সাথে মত-দ্বিমত-তর্ক। 

ইমেজ মানেই 'পলিটিক্স অব রিপ্রেজেন্টেশান'। কী রিপ্রেজেন্ট করছে এই সিনেমা? ছাত্রী অ্যানির সাথে অন্যায় দেখে হাঁসফাঁস করছে যে রেহানা, সেই রেহানা অ্যানির দ্বিধায় কেন চালাকিপূর্ণ অবস্থান নেবেন? বলবেন যে- তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষকে ডক্টর আরেফিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবেন, তবে 'উইটনেস' হিসেবে নয়!? তবে কী হিসেবে, ভিকটিম? অন্তত সাবটেক্সট তাই বলছে। তখন এটা কি যৌন সহিংসতার মতো ভয়াবহতাকে আলগা করে অন্য প্রশ্ন তৈরি করেনা? দ্বন্দ্বের অবজেক্টিভিটি, ফেয়ারনেস নিয়েই কি প্রশ্ন তৈরি হয় না? কোথাও কি তখন ব্যক্তিত্বের স্বেচ্ছাচার বা দ্বন্দ্ব সামনে চলে আসেনা? এটা কি ছবির 'অ্যাকিলিস হিল' নয়? মেয়েকে যখন রেহানা স্কুলের ফুটবল খেলা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে বলে, ছেলে-মেয়ের খেলা বলে আলাদা কিছু নেই। যিনি জেন্ডার নিয়ে এমন সেনসিটিভ, তিনিই আবার ওড়নায় সারাক্ষণ। মাথায় ওড়না কি জেন্ডারের প্রতীক নয়? এই কস্টিউম বা পোশাক কিসের 'সিগনিফায়ার'? কী বলবেন, কস্টিউমের দায়িত্বে থাকা রাবেয়া বশির নাবিলা ও পরিচালক সাদ? অবচেতনেও কি অস্বীকার করা যাবে যে একালে ধর্মযাপনও হাজির করে একটা রাজনীতি? যে পরিবার হাসপাতালে তাকে দেখতে আসে, জাহিদ চৌধুরী মিঠু ও অনি, অভিনয়ে তারা বেশ প্রাত্যহিক। এমনটাই হয়তো হাসপাতালে আমরা স্বজনদের করতে দেখি, রোগী দেখতে এসে জুড়ে দেয় নিজেদের নানা আলাপ। কিন্তু এখানে তারা যে আলাপ এবং তর্কে, তাতে জেন্ডার বিষয়ে 'সেনসিটিভ' রেহানাকে বিচ্ছিন্ন দেখা যায়। তার এই বিচ্ছিন্নতা, বিষণ্ণতা কিসের চিহ্ন?  

ছবির এই যে টেক্সট তার পলিটিক্যাল বয়ান কী দাঁড়ায়? কনটেন্টের চেয়ে ফর্ম এখানে বেশি বিষণ্ণ। কনটেন্ট রেহানার স্ববিরোধিতায় বিরোধপূর্ণ। ফর্ম তীব্রভাবে ধাবিত করে সেই বিরোধের আলো অন্ধকারে। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ হয়তো এটাই ইনভেস্টিগেট করতে চেয়েছেন। কিন্তু রেহানার সকল সময় কেন শূন্য? তার প্রার্থনা, তার ক্রমাগত মুখে পানি ছিটানো কখনই কেন তাকে প্রশান্ত করেনা? কোন পদ্ধতির ইনভেস্টিগেশান এ ধরনের চরিত্রের খোঁজ দেয় আমাদের? এটুকুতো জানা যে, সবকিছু পর্যবেক্ষণের ব্যাপারটা কোন তত্ত্ব নাও হতে পারে, কিন্তু একটা পদ্ধতি তো বটেই। আর তার পেছনে থাকে একটা দৃষ্টিভঙ্গি। সেই পদ্ধতি হয়ত আরও নানা পরীক্ষণের, নানা প্রশ্নের জন্মই দিতে পারে। সেই 'স্পেস' পরিচালক এখানে রেখেছেন। কিন্তু আমরা যখন কাম্যুর আউটসাইডার পড়ি তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কনটেক্সটে বুঝি যে, মারসো কেন এমন, কেন তার আবেগ বা প্রতিক্রিয়ার অভাব। কিন্তু রেহানা কেন এমন, সেটাও না হয় বুঝলাম সমাজের বিদ্যমান কনটেক্সটে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখাতে রেহানা যেন কোথাও গিয়ে হয়ে উঠছে কেবলই 'রিয়্যাক্টিভ'! সেটি কেনো? সে কি চায়নি তার মেয়ে এমন সমাজে বাড়ুক বা তার মতো হোক? কোন সে ভয়? সমাজের 'এথিকস' বা 'লিভিং' এসবের আর কোনো 'সার' নেই? এ তবে সেই বোধ? 'আলো অন্ধকারে যাই, মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে! সব কাজ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়, সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়, শুন্য মনে হয়, শুন্য মনে হয়!' এই তবে সংবেদ? এমন সংবেদে দর্শক আপনিও কি মূক? কিন্তু মূক হলেও কি মূল এড়ানো যাবে? শিল্পীর দায় নয় প্রশ্নের উত্তর দেয়া, বার্তা দেয়া, সে না হয় সমাজবিজ্ঞানের দায়। কিন্তু শিল্পী যখন বলেন, 'বার্তা' দিতে চাইনি তখন প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি সঠিক 'বার্তা'? যখন দেখছি প্রতিটি ইমেজ, অ্যাকশান, সংলাপ একেকটা বয়ান হয়ে উঠছে। করাণ এটি একটি 'ডিজাইনড রিয়ালিটি'। কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চরিত্রগুলোর ডিজাইন এমন? আর এমন একটি প্লট, শক্তিশালী চরিত্রের 'ইনভেস্টিগেশন'ইবা কতোটা হলো পলিটিক্যালি কারেক্ট? 

'কান' নিয়েছে চিলে কিংবা দেখি নাই 'চক্ষু মেলিয়া' 

আপনি কি রেহানা মরিয়ম নূর কান উৎসবে গেছে বলে দেখতে এতো উৎসাহী হলেন? বিশ্বজুড়ে আলোচিত মর্যাদাপূর্ণ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কান। সেখানে অফিসিয়াল সিলেকশনে প্রথমবারের মতো আঁ সার্তে রিগার্দ বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশের এই সিনেমা। সাধারণত বিশ্বজুড়ে যারা নতুন চিত্রভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছে তাদের ছবি নির্বাচিত হয় এই বিভাগে। এবছরের জুলাইতে হয়ে গেল সেই কান উৎসব। সে থেকে বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে রেহানা মরিয়ম নূর। আরও নানা গুরুত্বপূর্ণ ফেস্টিভ্যালে ছবিটি নির্বাচিত, আলোচিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। এই যে পাশ্চাত্যের ভালো বলা না বলায় আমাদের উত্তেজনার পারদ উঠানামা করে, এমন উপনিবেশী মন নিয়ে আমরা 'চক্ষু মেলিয়া' সত্যি কি কিছু দেখতে পারবো? পাশ্চাত্যেরও রাজনীতি থাকে সাউথ এশিয়ান ভিজ্যুয়াল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে। আপনি সে রাজনীতির বাইরে নন। এ হলো সংস্কৃতির বাজার রাজনীতি। আপনি ভোক্তা কিন্তু এ বাজারে আপনি চোখ মেলছেন না। চোখ না মেলেই বলছেন, কিচ্ছু হচ্ছে না এদেশে। যা হচ্ছে তাও কি দেখছেন? যদি না ভারত, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্স না বলে! এই যে পরিচালক সাদ এবং তার তরুণ বন্ধুরা বাংলাদেশের সিনেমাকে অফিসিয়ালি গ্লোবাল করে দিলো, ঘটালো এক প্যারাডাইম শিফট, এমন সাহসের পাশে দর্শক হিসেবে আপনি-আমি কতোটা দাঁড়াচ্ছি? বাংলাদেশের ভিজ্যুয়াল ইন্ডাস্ট্রি বা ক্রিয়েটিভ ইকোনমির যে মার্কেট এক লাখ কোটি টাকার হতে পারে, সেখানে একটা সিনেমায় পঞ্চাশ লাখ টাকা বিনিয়োগের লোক পাওয়া যায় না! এমন না পাওয়ার দেশে রেহানা মরিয়ম নূর প্রযোজনা করেছে সিঙ্গাপুর থেকে জেরিমি চুয়া আর দেশ থেকে আদনান হাবীব, রাজীব মহাজন, সাইদুল হক খন্দকার । নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে দাঁড়িয়েছে এহসানুল হক বাবু। বদলে দিয়েছে বাংলা সিনেমার ল্যান্ডস্কেপ। 

সিনেমা দুই অর্থেই শিল্প- আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি। বাজারেরও কলকজ্বা আছে। সবচেয়ে বড় কল হচ্ছে দর্শক, আপনি নিজে। আপনি সক্রিয় না থাকলে, আপনার সংস্কৃতির বাজার আপনি তৈরি না করলে, তখন আপনি অন্যের সংস্কৃতির বাজার হবেন। এখন যেমন আপনার বিনোদন মগজ ভারতের দখলে আর আপনার সন্তানের মগজ কোরিয়ার। সরকারতো আর এ নিয়ে ভাববে না, সে কেবল ইতিহাসকে শাসনের যন্ত্র করবে, কিন্তু সংস্কৃতির ইতিহাস নির্মাণে বিনিয়োগ করবে না। জহির রায়হান-আলমগীর কবির-আমজাদ হোসেনদের একটা সময় আমরা দেখেছি। কিন্তু আশির দশক থেকে আমাদের এখানে যারা স্বাধীন সিনেমা বানানোর লড়াইকে বিস্তৃত করেছেন সেই সালাউদ্দিন জাকী, মোর্শেদুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, তারেক মাসুদ, তৌকির আহমেদ কিংবা নতুন দিনের সিনেমা আর ওয়েব-এ নুরুল আলম আতিক, মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা, পিপলু আর খান, কামার আহমাদ সাইমন, মেজবাউর রহমান সুমন, শিহাব শাহীন, ওয়াহিদ তারেক। এমনকি এই সময়ের সুমিত, আশফাক নিপুণ, আবু শাহেদ ইমন, তানিম নূর, আদনান, শাওকী,  কৃষ্ণেন্দু, শঙ্খ, রবি- এমন আরও কয়েক নির্মাতা যেভাবে বাংলাদেশের গল্প হাজির করছেন দেশে ও বিদেশে, আপনি-আমি কতোটাইবা তার খোঁজ রাখি। খোঁজ রাখলে আঠারো কোটি লোকের দেশে প্রতিদিন অন্তত পাঁচ কোটি লোকতো নানাভাবে 'অপিনিয়ন' হাজির করছি। তাহলে তারা কিভাবে বলছি যে 'কিছুই হচ্ছে না'? একথা তুলছি এজন্য যে সৃষ্টিশীলতার যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে দর্শককেও যেতে হয়। আমরা দর্শকরা সেই যন্ত্রণা নিতে চাই না, তৈরি পেতে চাই সব। অথচ এই যে পাঁচ কোটি লোক যারা 'অপিনিয়ন' হাজির করছে তার পাঁচ লাখ লোকও যদি একটি সিনেমা দেখে আর তাতে নির্মাতা দল যদি গড়ে পঞ্চাশ টাকা করেও পায়, তাহলে আড়াই কোটি টাকা একটা সিনেমা আয় করতে পারে। আর এভাবে যদি জেগে ওঠা যায়, তাহলেই কেমন বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের সিনেমা, ভাবুন। বিনিয়োগ হতে পারে নতুন নতুন সিনেমায়, বদলে যেতে পারে শিল্পী, প্রযোজক, কলা-কুশলী আর কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের কাজ, যারা এখানেই বাজি রেখেছেন জীবন!  

তের শ নদীর দেশে এখন নাকি টিকে আছে প্রায় তিন শ নদী! বার শ সিনেমা হলের দেশে এখন টিকে আছে সত্তরটি! 

আপনার জল-হাওয়া-মগজ-সংস্কৃতি সবই কি এমন শুকিয়ে যেতে দেবেন? 

আপনি দরজা বন্ধ রাখবেন, দর্শক? আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ'রা কিন্তু বাংলাদেশের সিনেমার দরজা খোলার কথা বলছেন!