Published : 14 Oct 2021, 08:13 PM
শহীদ মিনারে ইচ্ছে করেই 'শেষ' দেখাটা এড়িয়ে গেছি। স্যালুট দিয়ে আমার অশ্রুসজল মুখটা আড়াল করে চলে আসার সময় মনের কোণে আপনার হাসিমাখা যে মুখটা আঁকা আছে পরম মমতায় সেটা লুকিয়ে আনতে পেরেছি। বিষাদের বিউগলে ঝর্ণাধারার মতো বেজে ওঠা কান্নার মূর্ছনা থেকে হাসিমাখা মুখটা লুকিয়ে আনা জরুরী ছিল। স্যার, আপনি বলতেন, 'যত বেশি হাসবে তত বেশি বাঁচবে।' নিজের বাসায় ইজি চেয়ারে বসে শেষ বিশ্রাম নেওয়ার সময়, শেষযাত্রার খানিক আগে দেখা হলে বলতাম, 'স্যার আপনার সময়ে আমরা বেঁচেছিলাম। এখন থেকে জীবিত না থাকলেও আপনি খুব বেশি বেঁচে ছিলেন, থাকবেনও।
ইজিচেয়ারে বিশ্রামের সময় কী বিয়োগান্তক নাটকের শেষদৃশ্যের মতো নিজের প্রাণপাখিটাকে নিজেই আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন? এ দৃশ্যকল্পও কি আপনার কল্পনা প্রসূত? সেই সময়ে কি মনে পড়েছিল পাখি নিয়ে মানুষের অজস্র দর্শনের একটি-
যতদূরে গেলে আর ফিরে আসা যায় না/তারচেয়ে বেশিদূরে মেলে দিয়ে পাখা/সুখ পাখি যায়, দূর অজানায়…
ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে যাবার পর তাদের বিয়ে ও বিবিধ কারণে যৌথ পরিবার ভাঙার গল্পনির্ভর এক নাটকে আপনার সেই সংলাপ, 'ভালোবাসার রেজিস্টার্ড বুক থেকে আমার নামটা কেটে দিও'- আজ উল্টো হয়ে গেল। ভালোবাসার রেজিস্টার্ড বুকে কান্নার জল দিয়ে আপনার নাম লিখতে আমার মতো অনেকেই গিয়েছিলেন শহীদ মিনারে। মন ছাড়া জলের কুচকাওয়াজ কারো নেতৃত্ব মানে না।
আপনি শুধু মনের নেতৃত্বে বাস করতে চেয়েছিলেন। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করার পর আর্থিক ও বাড়তি নাগরিক সুবিধার জন্য অনেকের মতো আপনিও সেখানে থেকে যেতে পারতেন। হয়তো আপনার সন্তানদের জন্ম হতো 'উন্নত বিশ্বে'। যুক্তরাষ্ট্র আপনাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। আপনি চাইতেন আপনার সন্তানদের জন্ম হোক স্বাধীন বাংলাদেশে। স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা নিয়ে প্রথম নাটক আপনিই লিখেছিলেন। শহীদ মিনারে অগণিত মানুষ তাই এসেছিল আপনাকে 'স্যালুট' জানাতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়েছিলেন। সম্পর্কের রসায়ন নিয়েও সম্ভবত আপনার মানবিক 'পড়ালেখা' ছিল। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং নাটকের জগতে আপনি ছিলেন 'প্রিয়' মানুষদের একজন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে দেখেছিলাম প্রথম ক্লাসেই ছাত্ররা আপনার 'নাম' দিয়েছে 'কসিরুদ্দিন'। বাংলাদেশ টেলিভিশনে আপনার অভিনীত একটা ধারাবাহিক নাটক তখন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, আপনি সেই নাটকে 'কসিরুদ্দিন' চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। একাধিক বিয়ে করা কসিরুদ্দিন সম্পর্কে বলেছিলেন, সম্পর্কের রসায়নটাই আসল। মানুষ নাকি নিয়ন্ত্রিত হয় রসায়নে। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের 'অয়োময়' নাটকে আপনি জমিদারের পাখা টানার মতো এক নির্যাতিত চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। জমিদার (এ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর) সম্পর্কে আপনার কথা ছিল একটাই, 'সে আমার ভাই'। কিন্তু জমিদার কি স্বীকার করতো সেকথা? সম্পর্কের রসায়ন হয়তো এমনই। সময় ও স্বার্থের জন্য সবকিছু বদলায়। মানুষই সম্পর্ক গড়ে আবার মানুষই সেটা ভাঙ্গে।
শুধু সম্পর্ক না, সৃষ্টিশীল প্রতিষ্ঠানও এর বাইরে নয়। ভাঙে রাজনৈতিক দল,গানের দল বা ব্যান্ড কিংবা মঞ্চ নাটকের গ্রুপ। হয়তো বিশ্লেষণ এই, 'দ্বন্দ্বেই বিকাশ' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে ১৯৬৫ সালের পরেই আপনি লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৮ সালের কোন একদিন আপনার 'ব্যাচেলর' বাসাতেই জন্ম হয়েছিল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের জগতে অবিস্মরণীয় এক নাম নাগরিক। এই নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের হয়েই আপনি প্রথম 'প্রফেশনাল মঞ্চ' নাটকে অভিনয় করেছিলেন। যদিও নটর ডেম কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক ফাদার গাঙ্গুলীর নির্দেশনায় আপনি যে নাটকে প্রথম অভিনয় করেন তার নাম ছিল, 'ভাড়াটে চাই'। আতাউর রহমানের নির্দেশনায় নাগরিকের হয়ে আপনি প্রথম যে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছিলেন তার নাম, 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দুই তুমুল আলোচিত নাটক 'দেওয়ান গাজীর কিসসা' কিংবা 'নুরুলদীনের সারা জীবন'সহ 'অচলায়তন' এবং 'বাকিটা ইতিহাস' নাটকে আপনি অভিনয় করেছেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে রাজনৈতিক দল বা মিউজিক্যাল ব্যান্ড দলের মতো নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ও ভেঙে যায়। আপনার নেতৃত্বে গঠিত হয় 'নাগরিক নাট্যাঙ্গন'। ১৯৮৩ সালে লেখা টেলিভিশন নাটক 'গৃহবাসী'কে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের জন্য প্রথম মঞ্চ নাটকে রূপান্তর করেন। এরপর নাগরিক নাট্যাঙ্গনের জন্য আপনি জনতার রঙ্গশালা, খোলস ও জোয়ার নাটকের নির্দেশনা দেন। এই তিন মঞ্চ নাটকও সমান জনপ্রিয়।
প্রথম সন্তানের মতো প্রথম লেখা নাটকের সুখস্মৃতিও আপনাকে আজীবন দোলা দিয়েছে। সেই নাটকের নাম 'অনেকদিনের একদিন'। ১৯৬৮ সালে আবদুল্লাহ আল মামুন টেলিভিশনে নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন। টেলিভিশন, রেডিও এবং মঞ্চের বাইরে আপনি উদীচীর জন্যও নাটক লিখেছিলেন। এই নাটকের নাম 'বিবাহ উৎসব'। বাংলাদেশটা ছিল আপনার কাছে সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম। জড়িয়ে ছিলেন এই বাংলার সৃষ্টিলগ্নের অসামান্য কিছু সৃষ্টিকর্মের সাথে।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছিল স্বাধীনতার উদ্দীপনা নিয়ে লেখা নাটক 'আবার আসিব ফিরে'। এই নাটকের পর রেডিও টেলিভিশনে পাকিস্তানি জান্তারা সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন দেশে ফেরেন, সেদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছিল আপনার লেখা নাটক, 'বাংলা আমার বাংলা'। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিও প্রচারিত হয়েছিল আপনার লেখা নাটক 'মারা একশত মালঞ্চের'। এমন সৃষ্টির সাথে জড়িয়ে থাকার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হন নি, ফিরে এসেছেন বাংলাদেশেই। ব্যক্তি জীবনের সব সুখকে বিসর্জন দিয়েছিলেন বাংলাদেশটাকে নাটকের স্বর্গরাজ্য বানাবেন বলে।
নাটক ভালোবাসার এই নিরন্তর চেষ্টার শুরুটা করেছিলেন নিজ পরিবার থেকেই। আপনি নিজে এবং আপনার স্ত্রী লাকি ইনাম সার্বক্ষণিক নাটকের সাথেই ছিলেন। দুই কন্য হৃদি হক এবং প্রৈতি হককে রেখেছিলেন নাটকের বলয়ে। তারাও কখনো বিদেশমুখী হননি। দুই জামাতা লিটু আনাম এবং সাজু খাদেমও নাটকের সাথেই আছেন। ৬০টি নাটক লিখেছেন টেলিভিশনের জন্য। মঞ্চের বাইরে রেডিওর জন্য নাটক লিখেছেন আরও কিছু। নাট্যজন হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদকও।
মনে যা ধারণ করতেন, মুখে সেটাই বলতেন। আপনার 'অন্তরে বাহিরে' কোন ফারাক ছিল না। নাটকের জন্য কোন ধরনের চাতুরি কিংবা রাজনীতির সাথে জড়িত হননি। নাটক বা বিজ্ঞাপন নির্ভর কোন বাণিজ্যের সাথে জড়াননি। মুক্তিযুদ্ধের জন্য আপনার অন্তরটা যেমন উম্মুখ ছিল, স্বাধীন দেশে আপনি সেই অন্তরের বাগানটাকেই বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। মুখের কোণে এক চিলতে হাসি জমিয়ে রেখে বলতেন, 'মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে এদেশে আর কোন বড় সম্পদ নেই।' বিভাজন এবং বেদনার সবগুলো ক্ষত ঢেকে রেখে হাসিটা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সবখানে। আমার বিশ্বাস ইজি চেয়ারে বিশ্রাম নেওয়ার সেই শেষ সময়েও আপনার মুখে সেই চেনা হাসিটাই লেগেছিল।
আপনাকে স্যালুট করে শহীদ মিনার থেকে ফিরে আসার সময় ভাবলাম তুমুল কোন বৃষ্টি নামুক,আকাশ ভাঙুক অভিমান। বৃষ্টি এলো না। পৃথিবীর চিরদুঃখী মানুষের একজন, যিনি হাসির জন্য বিখ্যাত,সেই চার্লি চ্যাপলিন বৃষ্টিতে ভিজতেন, হাঁটতেন এবং কান্না করতেন। বৃষ্টিতে সুন্দরভাবে কান্না লুকোনো যায়। এক জল আরেক জলের প্রবাহ রুখে দিতে পারে। স্যার আপনি অগণিত মানুষের কান্না দেখে গেলেন না।
স্যার আপনি বেঁচে ছিলেন তুমুলভাবে, বেঁচে থাকবেন মুক্তিযুদ্ধের সব অনুপ্রেরণায়, আপনার চিরপরিচিত হাসিতে কিংবা স্বজনদের স্মরণের কান্নার জলে।
আপনাকে স্যালুট একারণে যে আপনি কখনো জলদস্যুর কাছে জলের কুচকাওয়াজকে বর্গা দেননি। স্যার নিজের জীবন উৎসর্গের এই কাঁটা বিছানো পথে কী নিজেকে আপনার খুব একা মনে হতো? হয়তো কখনোই এই প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে না। স্মরণের বন্দরে আমাদের কান্নার জলে নোঙর করা থাকুক আপনার নাটকের জাহাজ।