কোভিড-১৯ এর অভিঘাত এবং এসএমই ব্যবসা

লীনা দিলরুবা
Published : 4 June 2021, 06:35 PM
Updated : 4 June 2021, 06:35 PM

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে এসএমএই ব্যবসার কর্মপরিধি বিস্তৃত হয়েছে। সরকারের শিল্পনীতি ২০১৬ এর আলোকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের সার্কুলার অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানে সম্পদের পরিমাণ, কর্মরত লোকবল এবং বার্ষিক টার্নওভার এর ভিত্তিতে শিল্প, সেবা এবং ব্যবসা খাতে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি এন্টারপ্রাইজের ভিত্তিতে এসএমইর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে। এ সংজ্ঞার আওতায় এসএমইতে নানা বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করে এটিকে একটি ফলপ্রসূ পর্যায়ে নিয়ে যেতে সরকারী এবং বেসরকারী তরফে কার্যক্রম অব্যাহত আছে।   

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলো বা জনপ্রিয় ভাষায় যাকে এসএমই বলে তারা দীর্ঘকাল ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। করের ভিত্তি সম্প্রসারিত করে অর্থনীতিকে বেগবান করতে বিশ্বব্যাপী এসএমই সামনের সারিতে এখন। প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায়িক কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করার মাধ্যমে স্বল্প মূলধনে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় বলে শ্রমঘন এ শিল্পগুলো ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়। কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপানের মতো ভারত এবং বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এসএমই কার্যক্রমের উত্থানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে ইতিমধ্যে প্রমাণিত। চীনের দ্রুত উন্নয়নের পেছনে এসএমইর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে যেখানে মোট ব্যবসায়িক উদ্যোগের বেশিরভাগই এসএমই। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন এসএমই ব্যবসা মোট দেশজ উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি অংশে অবদান রাখছে। এসএমই ব্যবসাগুলো পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক মন্দার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। 

সমাজের নানা স্তরে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে দেশের বিভিন্ন ধরনের এসএমই ব্যবসার বড় ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রায় সকল দেশেই শতকরা ৯০ ভাগ এসএমই কর্সংস্থানের হার উন্নয়নে অবদান রাখছে। প্রকৃতপক্ষে বড় বড় শিল্পে যখন চাকুরিচ্যুতি বাড়ে ও কর্মসংস্থান কমে যায় তখন এসএমই উদ্যোগগুলো নতুন চাকুরি সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানের উন্নতি চলমান রাখে। কোভিড-১৯ এর অভিঘাতে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী এসএমই ব্যবসা হুমকির মুখে পড়েছে। গতবছর টানা লকডাউনে কার্যত অচল ছিল সব ব্যবসাই। এ সময়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। 

এরপর যতদিন গিয়েছে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোকে মাথা তুলে দাঁড়াতে কমই দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা তাদের লড়াই চালিয়ে যেতে পেরেছে, আবার পারেনি। কেউ কেউ হেরে গেছেন চিরতরে; ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়ে দুর্ভাগ্য মেনে নেওয়া ছাড়া তাদের কোনও উপায় ছিল না। কেউ নতুন পুঁজি ঢুকিয়ে ব্যবসাকে সচল রেখেছেন। নতুনভাবে কেনাবেচা করে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছেন তারা। ২০২০ সালের মার্চ থেকে যে দুর্যোগ শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের মে-র শেষেও ফুরোয়নি সেটি। প্রকৃতভাবে ব্যবসায়ীদের জীবনে এ টানাপড়েনের যেন কোন শেষ নেই। 

২০২০ এর দুর্যোগকালীন মুহূর্তে এপ্রিলের প্রথম দিকে এসএমই ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০ (বিশ) হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা ঘোষণা কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যদিও এখন পর্যন্ত খুব বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠান এই সুবিধার আওতায় আসতে পারেনি। তবে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য এ প্রণোদনা প্যাকেজের সীমা চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রলম্বিত থাকার কারণে যারা এখনো সুবিধাটি পাননি তারা ব্যবসার চলতি মূলধন পেতে স্বল্প সুদের এ ঋণ সুবিধা এখনও গ্রহণ করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, ২০২০ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সুবিধাও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো পেতে পারে। 

সম্ভাবনাময় কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় সহায়ক জামানত একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের অর্থনীতিতে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ব্যবসায় জামানতবিহীন ঋণের বিপরীতে ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধা প্রদানের কারণ মূলত এ-খাতে প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকলেও কেবল সহায়ক জামানতের অভাবে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদেরকে ঋণ দিতে অনীহা দেখায়। সরকার ঘোষিত ২০ (বিশ) হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তার আওতায় কেবল কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ব্যবসায় চলতি মূলধনের বিপরীতে এ ক্রেডিট গ্যারান্টি সুবিধা দেওয়া হয়। কোনও একক উদ্যোক্তার জন্য সর্বোচ্চ ৮০ (আশি) শতাংশ পর্যন্ত গ্যারান্টি কভারেজ দেওয়া হচ্ছে। এ প্রণোদনা প্যাকেজগুলো ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে এসএমই খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশব্যাপী এডিবি, জাইকা ইত্যাদি তহবিল থেকে পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে এসএমই ব্যবসায় অর্থায়ন করছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে স্বল্পসুদের এ আর্থিক সহায়তাগুলো ব্যবসার জন্য কতোটা সুবিধা দিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের কথাও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের জন্য হেল্প ডেস্ক স্থাপন করে সেখানে তাদের ঋণ সহায়তার কাজ তদারকি করছে। নারীদের জন্য স্বল্পসুদে সহজ কিস্তিতে জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা নারীদের ব্যবসাবান্ধব করেছে।  

কোভিড-১৯ এর কারণে বেকারি, ফার্নিচার, নির্মাণ ব্যবসা, গৃহায়ণ, কসমেটিক এ- টয়লেট্রিজ, হস্তশিল্প, স্টেশনারি পণ্য শিল্প, ফুল উৎপাদন, খেলনা তৈরি, সিনেমা হল, কাপড় ও জুতার ব্যবসা, ক্রোকারিজ, ফটোগ্রাফি, জুয়েলারি, টেইলরিং, বুটিকস, নার্সারি, বিউটিপার্লার, মোটরগাড়ি বিক্রি এবং চলাচল, পর্যটন ইত্যাদি সেক্টর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার আইটি, মুদি, চিকিৎসা সরঞ্জাম, স্বাস্থ্যসেবা এই সেক্টরগুলো ভালো ব্যবসা করেছে। 

অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর কারণে এসএমই ব্যবসায় কিছু ইতিবাচক দিকও যুক্ত হয়েছে। এ সময়ে ই-কমার্স এবং পণ্য ও সেবার অনলাইন লেনদেনে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে এসএমইতে পরিবর্তনশীল ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে। অনেকে বিপণনের পুরোনো পদ্ধতি ছেড়ে নতুনভাবে অনলাইনে পণ্য বিপণন করছেন। বস্তুত প্রযুক্তির অগ্রগতি করোনা-পরিস্থিতিতে এসএমইতে ক্রয় ও বিক্রয়ের প্রক্রিয়াকে সহজতর করার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন ও বিপণনের ব্যয়হ্রাসের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের সহায়তাও করেছে। দেশে এখন নানা ধরনের ই কমার্স প্লাটফর্ম রয়েছে যা কোভিড-১৯ পরিস্থিতির আগে এতোটা সক্রিয় ছিল না।  

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে অর্থনীতির সব খাতে প্রভাব পড়লেও আর কোনওখাতে এত ক্ষতি হয়নি- যা এসএমই খাতে হয়েছে। এ দুঃসময় হয়ত একদিন শেষ হবে, তখন এসএমই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে, ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হবে এবং বুঝিয়ে দেবে যারা টিকে থাকে তারা শেষপর্যন্ত সফল হয়।