নিজেদের দোষটাও দেখি

সঙ্গীতা ইমামসঙ্গীতা ইমাম
Published : 29 April 2021, 09:44 AM
Updated : 29 April 2021, 09:44 AM

করোনা মাহামারীর ভয়ানক দিনগুলো শেষ হয়ে যায়নি। গত বছরের শেষ দিকে তার মাত্রা কিছুটা কমেছিল বটে, কিন্তু এ কথা তো চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন যে, সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ হতে এখনও ঢের সময় বাকি। তার আগ পর্যন্ত সতর্কতাই আমাদের বাঁচাতে পারে এই কোভিড-১৯ ভাইরাস থেকে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ এর টিকাদান কর্মসূচি চলছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। বর্তমানে মজুদ সংকট ও সরবরাহ অনিশ্চয়তার কারণে প্রথম ডোজের টিকা কার্যক্রম স্থগিত থাকলেও, অচিরেই এ সংকট কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে রাশিয়ার টিকা স্পুৎনিক এবং চীনের টিকা ব্যবহারের জরুরী অনুমোদন দেওয়ার মধ্য দিয়েই।

কিন্তু টিকা নিলেও যে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মানতে হবে, এ কথা তো টিকা প্রদানের প্রথম দিন থেকেই জানানো হয়েছে। গণমাধ্যমের সংবাদ-ফিচার বা সরকারি নানা বিজ্ঞাপনে বারবার জানানো হচ্ছে, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় টিকা নেবার পরও মাস্ক পরিধানসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কিন্তু সেই বিধান আমরা মানছি কই?

করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় বাংলাদেশে গত ১৪ এপ্রিল থেকে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। গত ১৪ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউনের চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বেড়ে ৫ মে পর্যন্ত কার্যকর হবার ঘোষণাও আমরা গণমাধ্যম মারফত জানতে পেরেছি। কিন্তু এরইমধ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে শপিং মল ও অন্যান্য দোকানপাটসহ সব ধরনের মার্কেট। খোলা থাকবে সকাল ১০ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির দাবির প্রেক্ষিতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও ৫ মে পর্যন্ত সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে গণমাধ্যমগুলো।

আইসিডিডিআর,বি'র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, ডিসেম্বর মাস থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং আইইডিসিআরের সঙ্গে মিলে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়ান্টের ওপর যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল, তাতে দেখা গেছে, পয়লা জানুয়ারি থেকে ২৪ মার্চে পর্যন্ত ১৬ হাজার ২৬৫টি নমুনা পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যে দুই হাজার ৭৫১টি নমুনা পজিটিভ চিহ্নিত হয়। আইসিডিডিআর,বি জানায় ৬ই জানুয়ারি প্রথম ইউকে ভ্যারিয়ান্ট শনাক্ত হয় এবং মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই ভ্যারিয়ান্টটি বাংলাদেশে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে দেখা যায় যে, অন্য যে সব ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশে, তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়ান্টটি সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

গণমাধ্যম ও গবেষকদের সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শনাক্তকৃত করোনাভাইরাসের ধরন 'বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট' এতটাই শক্তিশালী যে এতে আক্রান্ত ব্যক্তি তিন-চারদিন সময়ও পান না চিকিৎসার জন্য। কলকাতার বন্ধু-স্বজনদের ভয়ার্ত কণ্ঠে যখন শুনি, সারাদিন বাড়ির পাশ দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে লাশবাহী গাড়ির যাতায়াতে মানসিক বিপর্যস্ততার কথা, তখন মনে হয় আমরা তো ভালোই আছি। কিন্তু কতদিন আমরা ভালো থাকতে পারব? যদিও ২৬ এপ্রিল থেকে দু সপ্তাহের জন্য ভারতের সঙ্গে যাত্রী চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশে প্রতিদিনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গত বছরের চেয়ে আমাদের সচেতনতা যেনো আরও কমেছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসটি শক্তিশালী হচ্ছে কিন্তু আমরা যেনো গা-ই করছি না বিষয়টিতে। সরকার লকডাউন দিচ্ছে বটে কিন্তু তার শর্তাবলীতে এত শিথিলতা যে, গতবারের 'সাধারণ ছুটি'ও এর চেয়ে কার্যকর ছিল। আকারে-প্রকারে যেমনই হোক, এ লকডাউনের একটি প্রচ্ছন্ন সুফল কিন্তু আছে। গত ২৪ এপ্রিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশব্যাপী চলা লকডাউনের কারণে এক সপ্তাহে রোগী কমেছে ২৫ শতাংশ। প্রতিবেদনটিতে একটি আশা জাগানিয়া সংবাদ দিয়েছিলেন কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ। তিনি বলেছিলেন, "ঢিলেঢালা লকডাউনের মধ্যেও সংক্রমণের এ নিম্নগতি, পুরোপুরি মেনে চললে অবস্থার আরও উন্নতি হতো"।

কিন্তু পুরোপুরি মেনে চলা তো অনেক পরের কথা, আংশিকভাবে মেনে চলতেও যেন আমাদের কত বাধা! দেশজুড়ে লকডাউন দেবার পর অনেকেই শ্রমজীবী মানুষদের কথা বিবেচনায় নেবার কথা বলেছিলেন। সে বিবেচনা থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে কল-কারখানাগুলো লকডাউনের আওতামুক্ত রাখা হয়েছিল।

কিন্তু গত দু তিনদিন ধরে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই শপিং মল ও বিপণী বিতানগুলোতে যারা গাদাগাদি করে কেনাকাটা করলেন, তারা কি জীভন বাজি রেখে জীবন বাঁচানোর সামগ্রী কিনতে গিয়েছিলেন? অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, করোনা পরিস্থিতি যা-ই হোক, রোজার ঈদ তো আমাদের করতেই হবে! মানুষ মরছে তাতে কি, নতুন কাপড় পরে আনন্দ করবো না কেন! আমার পরিবারের তো কেউ আর মারা যায়নি! এবারের ঈদে শপিং না করলে যেন সমাজে আমাদের নাক কাটা যাবে। ভাবখানা এমন যেন মরলে মরবো কিন্তু ঈদ শপিং করেই মরব।

এ দায়িত্বজ্ঞানহীন জনগোষ্ঠী কিন্তু খেটে-খাওয়া শ্রমিক-জনতা বা নিম্নআয়ের মানুষেরা নন; এ হচ্ছে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাদের বিবেচনাবোধ তাদের পরিধেয় মাস্কের মতোই কপালে বা থুতনিতে থাকে।

প্রিয় পাঠক, আমার কথাগুলো শুনতে হয়ত আপনাদের খারাপ লাগতে পারে; কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, চারপাশের অবস্থা দেখে কি এমনটাই মনে হচ্ছে না? জানি বলবেন দোকানপাট না খুললে ব্যবসায়ি বা কর্মচারীরা চলবেন কী করে? যে বিত্তবান মানুষেরা ঈদের জামা কিনতে যাচ্ছেন, তারা আলমারি আরো উপচে পড়ার ব্যবস্থা না করে একটা প্রণোদনা ফান্ড গড়ে তুলুন। কাপড় বা আনুষঙ্গিক জিনিস কেনার বাজেটের টাকাটা সে তহবিলে দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন কম সামর্থ্যের বা সামর্থ্যহীন মানুষের দিকে। আপনার পরিচিত যে মানুষটির চাকরি নেই বা ব্যবসা বন্ধ তাদের পরিবারগুলোকেও তো সাহায্য করতে পারি আমরা। স্বচ্ছল মানুষেরা একটি দুটি পরিবারের দায়িত্ব নিলেই কিন্তু এ বিপদ থেকে আমরা অনায়াসে উদ্ধার পেতে পারি।

পাশের দেশ ভারতের দিকে একবার তাকান। সংক্রমণ যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে কোথায় যাব আমরা? যতই হাজার বেডের করোনা হাসপাতাল হোক না কেন, সংক্রমণ তো লাখের কোঠায়। রোগী নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে চক্কর খাওয়া, অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে কাতরে কাতরে মরার দৃশ্য দেখেও কি আমাদের হুঁশ হবে না? একবারও মনে হয় না নিজেকে একটু সামলে রাখলে পরিবার, সমাজ আর এই দেশটা বাঁচতে পারে। এই সময়টা পার করতে পারলে সুস্থ সময়ে পরিবারের সকলকে নিয়ে হাসতে পারব আনন্দ করতে পারব। নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার হাট যাদের পক্ষে সম্ভব অনলাইনে করা। অতিরিক্ত খরচ করা থেকেও বিরত থাকতে হবে এই সময়টা। মনে রাখতে হবে আমার অহেতুক খরচের টাকাটা একটা পরিবারের মুখে দু বেলা খাবার তুলে দিতে পারে।

আসুন আমরা সকলে অভাবে থাকা মানুষের সাহায্যে নিজেদের ঈদের খরচের টাকাটুকু তুলে দিই। সন্তানদের শিখাই যে, সবাই মিলেই বাঁচতে হয়। আর করোনা সংক্রমণ রোধে ঘরে থাকি। অপ্রয়োজনে বাইরে বেরিয়ে নিজের, পরিবারের,  সমাজ তথা দেশের করোনা পরিস্থিতিকে আরো সংকটে না ফেলি। বাঁচলে আগামীতে সবাই মিলে ঈদ-পূজা-পার্বণ সব আনন্দ করা যাবে।