‘বধ্যভূমিতে একদিন’

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 18 Feb 2021, 11:21 AM
Updated : 18 Feb 2021, 11:21 AM

স্থান-কাল-পাত্র। কালকে কিছুক্ষণের জন্যে দৃশ্যমান করে স্থান ও পাত্র উভয়েই মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যায়। কালের স্বতঃপরিবর্তনশীল তিনটি বিভাগ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। অতীতাশ্রয়ী হওয়াটা ব্যক্তি ও জাতির জন্যে কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু উজান-অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যেহেতু ভবিষ্যতের ভাটির পানে প্রবাহিত হয়ে চলে বর্তমান, সেহেতু অতীতকে ভালভাবে জেনে, তার গায়ে উপযুক্ত ট্যাগ লাগিয়ে সংরক্ষণ করে নেবার পরই শুধু অতীতকে পিছনে ফেলে সামনে অগ্রসর হওয়া চলে।

মানুষ একটি সংঘাতপ্রবণ প্রাইমেট। অতীতেও তারা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, বর্তমানেও যুদ্ধ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এটা ঠিক যে সিংহাবলোকনে দেখলে মনে হবে, যুদ্ধই মানব-জাতি নির্মাণ করেছে, কিন্তু কীটাবলোকনে দেখলে স্বীকার করতেই হবে যে মানব জাতির জন্যে যুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর কোনো স্বখাত-সলিল আর হতে পারে না। প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হতো, উলুখাগড়া জনগণের উপর তার প্রভাব হয়তো পড়ত না খুব একটা। কিন্তু আধুনিক যুগে 'কান টানলে মাথা আসে'-র মতো যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যুদ্ধাপরাধ – খুন হয় নিরপরাধ মানুষ, শিশু, ধর্ষিতা হয় নারী। যুদ্ধের কারণে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ, শিশুমৃত্যু। যত আধুনিক হচ্ছে মানুষ, যুদ্ধাপরাধও হয়ে উঠছে তত অবশ্যম্ভাবী, সর্বব্যাপী, বীভৎস, যন্ত্রণাদায়ক।

যুদ্ধাপরাধের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনন্য – এত অল্প কালে, এত বেশি পাত্র এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধের শিকার হয়নি সম্ভবত, কোনো স্থানে, কোনো কালে। বাংলাদেশের সব জায়গায় যুদ্ধ হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশের এমন এক ইঞ্চি মাটিও হয়তো নেই, যেখানে যুদ্ধাপরাধ হয়নি। আমরা যারা 'বাংলাদেশ' নামক স্থানের উত্তরাধিকারী এবং সত্ত্বাধিকারী, তাদেরকে এই রাষ্ট্রের জন্মযুদ্ধের ইতিহাস যেমন জানতে হবে, তেমনি জানতে হবে, এখানে সংঘঠিত যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস, যাতে এই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হতে না পারে।

'বধ্যভূমিতে একদিন'। সেই আশি সাল থেকে, প্রায় চল্লিশ বছর ধরে মনে মনে পরিকল্পনা করে এবং চার বছর ধরে শুটিং করে কিছুটা সরকারি অনুদানে এবং অনেকটাই নিজের অর্থায়নে দুই ঘণ্টার এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন কাওসার চৌধুরী। নতুন কেউ নন তিনি, পুরনো চাল, অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে ভাতে বেড়েছেন। কুড়ি বছর আগে তিনি অন্য একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন: 'সেই রাতের কথা বলতে এসেছি'। সেখানে একটি মাত্র বিভৎস, ভয়াবহ রাতের বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি। 'বধ্যভূমিতে এক দিন' ছবিতে শত শত অসহনীয় রাত ও দিনের কথা আছে।

এই ছবিটির নাম হতে পারত: 'সেই কালের কথা বলতে এসেছি!' কী ভয়াবহ, বীভৎস, গা শিউরে ওঠা ছিল সেই কাল! অতীত হয়নি সেই কাল, কারণ অতীতের সঙ্গে বোঝাপড়া যতদিন শেষ না হয়, অতীত ততদিন বর্তমানকে তাড়িয়ে বেড়ায় লোকবিশ্বাসের অতৃপ্ত আত্মার মতো। অতীতের প্রতি সুবিচার করার একমাত্র উপায়, অতীতের মুখোমুখি হওয়া, অতীতের ভুল স্বীকার করা। যত কষ্টই হোক, অতীতকে উপেক্ষা করা চলে না কখনই – ভুক্তভোগী এবং অপরাধী উভয়ের ক্ষেত্রেই এটা সমান সত্য। ইতিহাস থেকে ব্যক্তি ও জাতিকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে, কারণ তা না করলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে। কোন স্থানে, কোন পাত্র, কখন কী করেছিল, তার নৈর্ব্যক্তিক অনুপুঙ্খ বিবরণই ইতিহাস।

এই ছবির বিষয় যুদ্ধাপরাধ, কিন্তু কী আশ্চর্য, এক ফোঁটা রক্ত নেই এই ছবিতে। এমন একটি ছবিতে রক্ত দেখানো লোভ সামলানো সহজ ছিল না পরিচালকের পক্ষে। দুই উপায়ে এখানে দেহের ও মনের রক্তক্ষরণ দেখানো হয়েছে। প্রথমত আছে ভুক্তভোগী পাত্রদের স্মৃতিচারণ, যেগুলো 'রক্তাক্ত' বললেও কম বলা হয়। দ্বিতীয়ত, ছবির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রক্তের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে রক্তগোলাপের পাপড়ি। এক নৌকায় বসে বুড়িগঙ্গা নদীর জলে এই পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানিদের নৃশংসতার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী কবি নির্মলেন্দু গুণ। পরিচালক নিজে এবং মুক্তিযোদ্ধারা বীরাঙ্গনাদের পায়ে অর্ঘ্য দিয়েছেন লাল গোলাপ। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা গোলাপ-পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে। শুধু গোলাপ ক্রয় খাতেই খরচ হয়েছে লাখ সাতেক টাকা, এক ট্রাক গোলাপ কেনা হয়েছিল শুধু রায়েরবাজার বধ্যভূমির জন্যে – বললেন চলচ্চিত্র নির্মাণ-দলের এক কর্মী লিটন।

'নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হয়ে হইল না শেষ!' প্যানোরামা, ফেড ইন, ফেড আউট, লং, মিডিয়াম এবং ক্লোজ শট, গীত ও সঙ্গীতের সমানুপাতিক ব্যবহারের কারণে কারিগরী দিক থেকে ছবিটির নির্মিতির কোনো প্রকার ঘাটতি চোখে পড়ে না। কিন্তু নির্মাণের সর্বোচ্চ মানের মুন্সিয়ানা সত্ত্বেও একবিংশ শতকের অস্থির, অসহিষ্ণু দর্শককে দীর্ঘ দুইটি ঘণ্টা নিজের আসনে বসিয়ে রাখা ছেলের হাতের মোয়া নয়। কোন যাদুবলে এই অসাধ্য সাধন করেছেন কাওসার চৌধুরী?

ছবির নির্মাণ পদ্ধতি অতি সরল। যে সকল স্থানে যুদ্ধাপরাধ সংঘঠিত হয়েছিল, কাওসার চৌধুরীর ক্যামেরা সেই সকল স্থানে গিয়ে যুদ্ধাপরাধের শিকার, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া পাত্রদের মুখোমুখি হয়েছে। 'ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো!' ভুক্তভোগীদের মনের কথাগুলো জমে আছে দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে। কেউ তাদের কাছে কখনও কিছু জানতে চায়নি। সেই কালের ইতিহাস, কীভাবে দিনের পর দিন হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা– ভুক্তভোগীরা অবলীলায়, অতি স্বাভাবিকভাবে বলে গেছেন। 'কিছুই বলতে হয়নি আমাকে।' বলেন কাওসার চৌধুরী। 'সাধারণত ছবি কথা বলে। অথচ দেখুন, ছবি নয়, পাত্রদের মুখের কথাই এই ছবির প্রাণভোমরা। দর্শককে তত্ত্বকথা বলতে চাইনি, শেখাতে চাইনি কিছু। যা কিছু বলার, যা কিছু শেখাবার, স্মরণ করিয়ে দেবার, সব করেছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের ধ্বংসাবশেষ, এই ভুক্তভোগীরা।'

৭১ সালে সৈয়দপুর স্টেশনের নিকটবর্তী শহরে ও গ্রামে একদিন মাইকিং করে বলা হলো, রাজাকারের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে যারা ভারতে যাবার চিন্তা করছেন, তাদের জন্যে একটি ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে পাকিস্তান সরকার। সরকারের মিথ্যা প্রচারণায় বিশ্বাস করে হাজারখানেক হিন্দু মাড়োয়ারি নারী-পুরুষ-শিশু উঠে বসে সেই ট্রেনে, সৈয়দপুর স্টেশনে। ধীরে ধীরে চলতে থাকে ট্রেন এবং এসে দাঁড়ায় একটি ব্রিজের ওপর। তারপরই শুরু হয় হত্যাকাণ্ড। কিরিচের এক কোপে মাথা উড়িয়ে দেয়া, শিশুদের শরীরকে আড়াআড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলা, দুধের বাচ্চাদের আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে বেয়োনেটে গেঁথে ফেলা ইত্যাদি রাজাকারদের নৃশংসতার কয়েকটি মাত্র উদাহরণ।

প্রতিটি কম্পার্টমেন্টের দরজায় উদ্যত রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে ছিল একজন। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয় বলে ভাগ্যক্রমে পালিয়ে বাঁচতে পারে মাত্র চব্বিশ জন। 'তোর বৌদি আর বাচ্চাদের ছেড়ে আমি যেতে পারব না ভাই। আমাদের মরতেই হবে। তুই পালাতে চেষ্টা কর। তুই বাঁচলে আমাদের বংশে বাতি দেবার জন্যে কেউ একজন অন্তত থাকবে।' বড়ভাইয়ের মুখে শোনা শেষ কথা ক'টির স্মৃতিচারণ করে বেঁচে যাওয়াদের একজন, তপন কুমার দাস, কাল্টু। পারিবারিক বন্ধন ও বংশরক্ষার এমন ভয়ঙ্কর-সুন্দর চিত্র সাহিত্যিকের কল্পনায় নয়, অতি কঠিন বাস্তবেই শুধু সম্ভব। যুদ্ধের নয় মাস পরে ব্রিজের নিচ থেকে মাথার চুল, বিনুনীর ফিতা ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন তারা। ব্রিজের নিচ থেকে ৪০ বস্তা হাঁড়গোড়-মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। পাঠক! শুনতে, পড়তে কত সহজ লাগে, কয়েক ঘণ্টায় হাজার মানুষকে কচুকাটা করা হলো একটি ব্রিজের ওপর, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির নিচে। কিন্তু একজন ভুক্তভোগীই শুধু জানে, অভিজ্ঞতাটা কতটা ভয়ানক! এমন একটি দুঃস্বপ্ন ভুক্তভোগীকে তাড়িয়ে বেড়াবে মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত।

একজন বলে গেলেন আর ক্যামেরা সেটা ধারণ করল – এ ছবির চিত্রায়ন কিন্তু অতটা সরল নয়। নির্মাণের পিছনে দীর্ঘদিনের সুচিন্তিত গবেষণা রয়েছে। সতর্ক একজন গবেষকের মতো কাওসার চৌধুরী সব তথ্য কমপক্ষে দুদিক থেকে যাচাই করেছেন। সৈয়দপুরের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সাক্ষী দিয়েছেন একাধিক জন। একজনের মুখের কথা শেষ হতেই বলতে শুরু করেন অন্য এক ভুক্তভোগী। ঢাকা থেকে সৈয়দপুরে গিয়ে ক্যামেরার মুখোমুখি হয়েছেন বিহারী সম্প্রদায়ের দুজন সদস্য। তাদের বক্তব্য, বাঙালি রাজাকার, বিহারী সম্প্রদায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী, তৎকালীন প্রশাসন সবাই এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে সমভাবে দায়ী। এখনও যদি কোনো অপরাধীকে জীবিত খুঁজে পাওয়া যায়, তবে তাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে – বললেন বিহারি নেতারা। এভাবে ক্রসচেক নয়, ত্রিপল চেক হয়েছে বেশিরভাগ তথ্য ও ঘটনা। কাওসার চৌধুরী এই ছবিটি সত্যের চিত্র, প্রামাণ্য তথ্যের চিত্র।

'জয়বাংলা', 'আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ' বলে বিহারিরা এগিয়ে আসছিল আমাদের পাড়ার দিকে। কাছে আসতেই তাদের শ্লোগান পালটে গেলো: 'নারায়ে তাকবির', 'আল্লাহু আকবর', 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'। আমার বড় ভাই বাদল, চট্টগ্রাম কলেজে পড়ত, ছাত্রলীগ করত। ওর মাথাটা কিরিচের এক কোপে কেটে রক্ত ঢেলে দিল তারা আমার মায়ের মাথার উপর। আমার মেঝ ভাইকে বাঁচানোর জন্যে আমি তাকে জড়িয়ে ধরে লুকিয়েছিলাম, খাটের তলায়। পেট্রোলের আগুনে জ্বলে গেলো আমার শরীরের বাম দিক। অজ্ঞান হয়ে গেলাম। ভাইকে কখন টেনে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে আমি জানিও না।'

'গত ছেচল্লিশ বছর এই পোড়া শরীর নিয়া আছি। আমার সমবয়সীরা কী সুন্দর সংসার কইরতেছে। আমারও তো একটা বিয়া অইতে পাইরতো, কোল জুড়ে বাইচ্চাকাইচ্চা থাকতে পাইরতো। জীবনে আমি কী পাইলাম? আমারটাও তো শরীর। আমারও মনে কি ইচ্ছা থাইকতে পারে না?' চিরকুমারী খুকুরানীর প্রশ্নের কী জবাব দেবেন আপনি? কী বলবেন, যখন আপনি জানবেন, গত ছেছল্লিশ বছর ধরে কুষ্টিয়ার বীরাঙ্গনা বিধবাদের একঘরে করে রাখা হয়েছে? পুকুর থেকে তাদের পানি তুলতে দেওয়া হয় না, দোকানে বাজার করা মানা তাদের। 'সব হারাইছি আমি, ইজ্জত দিছি, দুঃখ কপালে আছিল, কী কইরবো! তবু বলি দেশের মানুষ ভালো থাক!' মাথা নীচু করে বলেন এক বীরাঙ্গনা লাইলী বেগম। মাথা উঁচু করে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটুকুও নেই, সাহস করতে পারেননি গত প্রায় পাঁচ দশক। নিজের বাড়িতে সাক্ষাৎকার দেবার সাহস তাদের হয়নি। সাক্ষাৎকার দিতে তাদের আসতে হয়েছে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার বাসস্থানে। ভাবা যায়, এসব ঘটছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই? এতে কি প্রমাণ হয়, স্বাধীনতাবিরোধীরা এখনও কী পরিমাণ সক্রিয়? ১৬ ডিসেম্বরের পর এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন: 'জং জারি রহেগা!' আমাদের জন্যে যুদ্ধ শেষ হয়েছে ৪৬ বছর আগে। ওদের দিক থেকে যুদ্ধ এখনও চলমান। কাল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় না থাক, দেখবেন, ওরা সশস্ত্রে হাজির হবে।

'বাপের সামনে মেয়েকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করেছে রাজাকারেরা। কিছু করার উপায় ছিল না কারও, চোখ বন্ধ করে রাখা ছাড়া। বললেন চট্টগ্রামের মিরের সরাইয়ের এক প্রত্যক্ষদর্শী। আনোয়ারার এক জেলে-বধু রাশনা বালা জলদাসী বিয়ের একমাস পরেই পাকিস্তানি হানাদারদের ব্রাশফায়ারে চোখের সামনে নিজের স্বামীকে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখেছেন নিজের চোখের সামনে। 'হাসিনা মামণির কাছে আঁই কিছু ন চাই। আঁরা অশিক্ষিত, গরীব মানুষ, কথা কইত ন জানি। জীবনত কিছু ন পাই!' তঅ কইরদে (তবুও বলছি), 'আঁরা যে বাঁচি আছি, হাজার শোকর।'

'দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা। কারোর দানে কেনা নয়!', 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি' পরিচিত দেশাত্মবোধক গানগুলোর সফল ও উপযুক্ত ব্যবহার হয়েছে এ ছবিতে। এর একেকটি সিকোয়েন্স দিয়ে একেকটি পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব। 'মুক্তির মন্দির সোপানতলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে!' এ ছবি দেখে দর্শক, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হোন কিংবা বিপক্ষে, এমনকি স্বয়ং যুদ্ধাপরাধীও যদি তিনি হয়ে থাকেন, অশ্রুভারাক্রান্ত না হয়ে পারবেন না। তার মনে নিশ্চয়ই এ প্রশ্নের উদয় হবে: রক্তমাংসের একজন মানুষ কীভাবে আরেকজন নিরাপরাধ মানুষকে এত নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে, শ্রেফ সে অন্য ধর্মের, অন্য দলের, অন্য মতাদর্শের অনুসারী বলে? জীবন্ত অবস্থায় বুক চিয়ে হৃদপিণ্ড বের করে আনা, গায়ের চামড়া তুলে নিয়ে মাছ কাটার মতো মানুষের শরীরকে খণ্ডবিখণ্ড করে পাতকূয়ার মধ্যে ফেলে দেওয়া, ব্লাস্ট ফার্নেসে জীবন্ত মানুষকে জ্বালিয়ে দেওয়া, বস্তায় ভরে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া – এই সব অপরাধ সংঘঠিত করেছে একাত্তরের রাজাকার, আলবদর আল শামস এবং তাদের দোসর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ, তিনি এই অমানুষ যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকজনকে শাস্তির আওতায় আনতে পেরেছেন। 'শ্যাহের বেডি ছাড়া আর কেউ ফারত?' আমাকে একবার জিগ্যেস করেছিল এক রিকশাওয়ালা, পুরান ঢাকায়। আফশোসের বিষয়, যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই বহাল তবিয়তে রয়েছে বিদেশে, লন্ডনে, আমেরিকায়। তাদের বাপের ভাগ্য যে বাঙালির মন নরম, শেখ হাসিনা একজন মা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ ইসরাইল নয় যে আইখম্যানের মতো পলাতক গণখুনীকে বিদেশ থেকে হাইজ্যাক করে এনে শাস্তি কার্যকর করাবে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে, দেশে কিংবা বিদেশে।

বলা হয়ে থাকে যে একটি ছবি হাজার কথার চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু কথা ঠিকঠাকমতো শক্তিশালী হলে ছবিও যে আর অপরিহার্য থাকে না, এই সত্যটি বুঝতে হলে 'বধ্যভূমিতে একদিন' শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্রটি অন্তত একবার দেখতে হবে। আমার মতো একাধিক বার দেখলে তো কথাই নেই। মুক্তিযুদ্ধকে নিছক 'গণ্ডগোলের বছর' বলে যারা পার পেতে চান, তাদেরকে দুবার ভাবতে ভাবতে বাধ্য করবে এই প্রামাণ্যচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসংগ্রহের গুরুদায়িত্ব দশকের পর দশক ধরে স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছেন যে অল্প কয়েকজন, কাওসার চৌধুরী তাদের অন্যতম। সামান্য একটা রিভিউ লিখে বা 'ধন্যবাদ কাওসার ভাই!' বলে আমরা তার ঋণশোধ করতে পারব – এই দুঃসাহস যেন আমরা মনে পোষণ না করি। এ অনেক বড় একটা কাজ এবং এমন একটা ছবি করতে পারলে যে কোনো নির্মাতা নিজেকে ধন্য মনে করবে, তা তিনি যে কোনো দেশেরই হোন না কেন।

মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে দুই দিনব্যাপী প্রদর্শনী হয়েছে ছবিটির। দর্শকদের মধ্যে অন্য অনেকের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল, যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক, একাধিক বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক সেনাকর্মকর্তা। দশম শ্রেণির ছাত্রী মৃত্তিকা ছবিটি দেখে বলেছে: 'মুক্তিযুদ্ধের তথ্য তো আমরা পাঠ্যবই থেকেই পাই। কিন্তু তথ্যই তো সব নয়। মুক্তিযুদ্ধের আবেগটা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। এই ছবি আমার মনে সেই আবেগ সঞ্চারিত করেছে।'

মুক্তিযুদ্ধের আবেগ-জারিত এই মৃত্তিকা মা – এই তো আমার আগামী দিনের বাংলাদেশ! মৃত্তিকার কথার সূত্র ধরে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বললেন: 'আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, একাত্তর নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমরা আবেগাক্রান্ত হই। এই কারণেই একাত্তরের সঠিক ইতিহাস লেখা আমাদের পক্ষে দুরূহ। নতুন প্রজন্মের জন্যে আমরা শুধু তথ্যসংগ্রহ করে যেতে পারি এবং কাওসার চৌধুরী সেই কাজটিই করছেন, সঠিকভাবে।'

কাওসার চৌধুরী এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। মুক্তিযুদ্ধসহ সব ধরনের তথ্য তো ছড়িয়ে আছে সব জায়গায়। দুনিয়ার সব তথ্যই নতুন প্রজন্ম খুঁজে পায়, শুধু মুক্তিযুদ্ধের তথ্যই সে পায় না? কেন আমাকেই সব তথ্য খুঁজে নিয়ে তার সামনে উপস্থাপন করতে হবে? আমি মুক্তিযুদ্ধও করব, আবার পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে তথ্যও জোগাড় করে যাব? সব দায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের, নতুন প্রজন্মের কি কোনো দায় নেই? যে বাংলাদেশের সুবিধা তারা ভোগ করছে, তার জন্মের ইতিহাসটুকু কেন তারা কষ্ট করে খুঁজে নেবে না?'

এই ছবিটা দেখতে আপনার কষ্ট হবে – এটা সত্য। কষ্ট জীবনেরই অংশ। এই মাটির কাছে, দেশের কাছে আপনার ঋণ আছে। আপনি এই দেশে জন্ম নিয়েছেন, সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করছেন। আপনাকে জন্ম দিতে মায়ের কতটা কষ্ট হয়েছে, সেটা একবার জানতে-শুনতেও চাইবেন না, মিলনায়তনের আরামকেদারায় বসে আপনার মনে সামান্য কষ্ট হচ্ছে বলে – এতটা নিষ্ঠুর আপনি কীভাবে হতে পারেন?

ছেচল্লিশ বছর পর একটি মৃত্যুকূপ খননের খবর পেয়ে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন কাওসার চৌধুরী। কূপ থেকে উঠে আসছিল হাড়গোড়, মাথার খুলি। কূপের পাশে দাঁড়িয়ে বর্তমান প্রজন্মের এক সাংবাদিক বললেন: 'যুদ্ধাপরাধীদের মনে কিন্তু বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। একাত্তরের কৃত অপরাধের জন্যে গত পাঁচ দশকে একবারও ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি অভিযুক্ত দলগুলো কিংবা পাকিস্তানের শাসকেরা। যুদ্ধাপরাধের কথা স্বীকারই করে না তারা। 'আরেকবার যদি ওরা সুযোগ পায়, তবে বাঙালির মৃতদেহ তারা আর কোনো কূপে ফেলবে না। পঞ্চাশ-একশ বছর পর যাতে ওদের অপরাধের কোনো প্রমাণ খুঁজে না পাওয়া যায়, সে লক্ষ্যে মৃতদেহ পুড়িয়ে তারা ছাই করে দেবে, অ্যাসিডে গলিয়ে ফেলবে, যেমনটা করেছে আল শামসের গুণ্ডারা, ১৯৭১ সালে!'

দ্বিতীয়বার যদি আমরা ভুল করি, তবে সে ভুলের মাশুল দেওয়া অনেক কঠিন হবে – এটাই আমার মতে কাওসার চৌধুরীর 'বধ্যভূমিতে একদিন' ছবির প্রথম শিক্ষা। দ্বিতীয় শিক্ষা: 'সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন, বাট আনজাস্টিফাইড সাইলেন্স ইস ফেইক গোল্ড!' কথা যেখানে বলতে হবে, সেখানে চুপ করে থাকা দায়িত্বে অবহেলার সামিল। কাওসার চৌধুরী নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনি চুপ করে থাকলেই ওরা চুপ করে থাকবে না, চুপ করে নেই। সামাজিক-অসামাজিক সব গণমাধ্যমে ওরা সতত সক্রিয়, রাজনীতি-অর্থনীতি সব সেক্টরে সমান সক্রিয়।

ছবিটির বহুল প্রচার প্রয়োজন। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগুলোতে এ ছবির অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। এ এমন এক ছবি যার আলোচনা বাঙালি জাতির জীবনকালে শেষ হবে না। 'শেষ নাহি যে শেষ কথাটি বলবে!' একটি স্বরচিত কবিতা দিয়ে অগত্যা শেষ করি। কবিতার নাম 'নতুন কাসুন্দি'। ২০১০ সালে জাপানে বসে লেখা। প্রাসঙ্গিক বলেই এখানে উদ্ধৃত করলাম 'কথাকলি' (প্রকাশকাল ২০১৩) থেকে।

সে এমন এক সময়ের কথা

যখন দেশে পাকিস্তান নেই, কিন্তু ওরা আছে।

একদিন সেফটি ট্যাংক খুঁড়তে বেরিয়ে এলো

নতুন এক কাসুন্দি।

তড়িঘড়ি চাপা দেয়া হাঁড়গোর,

এখানে ওখানে ভাঙা শাঁখা, কাচের চুরি

সিঁদুর অবশ্য মুছে গিয়েছিল মরার আগেই।

কামলারা ভয়ে কোদাল-ঝুড়ি ফেলে

উঠে আসে। সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা

ঝুঁকে পড়ে গর্তের ওপর।

'কারা ধরে এনেছিল তোমাদের?

ও দিদি, কী নাম ছিল আপনার?

কাউকে চিনতে পেরেছিলে মাসী?'

পাগল! জীবিত নারীর সাক্ষ্যই গ্রাহ্য হয় না!

সবিতা রায় আর কবিতা সাহারা অবশ্য

ভয়েও বলতো না: নির্মম অত্যাচারের পর

কারা তাদের জ্যান্ত মাটিচাপা দিয়েছিল!

তোমরা যারা কবিতাদের স্মৃতিটুকুও

চাপা দিতে চাও, দিতেই পারো,

কিন্তু দোহাই, শুধু বলো না:

'অনেকদিনতো হলো,

এবার ওদের ক্ষমা করো!'