২০২০: আমরা স্তব্ধ ছিলাম না

আনিকা নাওয়ার
Published : 31 Dec 2020, 11:47 AM
Updated : 31 Dec 2020, 11:47 AM

কি একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেল ২০২০ সালের পৃথিবী! কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে হুট করেই ঘরে আটকে পড়লো মানুষ। প্রথমে আমরাও, মানে আবৃত্তি ও কবিতা যাদের ধ্যানজ্ঞান, থমকে গিয়েছিলাম। এমন পরিস্থিতিতে তো দেখিনি আগে, কেউ- কখনোই! 

বিশেষ করে মননশীলতার বাইরে আমরা যারা নানা ধরনের শিল্প চর্চা ও শিল্প মাধ্যমের সাথে জড়িত, এ সংক্রান্ত আড্ডা ও চিন্তায় যাদের দিন কাটে, তাদের মানসিক জগৎ হয়ে উঠতে থাকলো সঙ্কীর্ণ। 

তবে এই অনেক হারানোর বছরে আমরাও ঘুরে দাঁড়ালাম একটু অন্যভাবে। আমরা কয়েকজনা এক হয়ে শিল্পবোধ সম্পন্ন মানুষের মন চাঙা রাখতে, সাহস জোগাতেই কবিতাপ্রেমীদের নিয়ে যাত্রা শুরু হলো আবৃত্তি অনলাইনের।    

সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো কবিতা। কবিতা হল কবির উপলব্ধিজাত এক বিশেষ শিল্পভাবনা কবিতা কবির সৌন্দর্য ভাবনার বহির্প্রকাশ বা কবির বাস্তবতাবোধের উন্মোচন ঘটায়।

কবির ভেতরকার আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধি ও নিজস্ব চিন্তা ভাবনাকে সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলেন একজন আবৃত্তি শিল্পী। কবিতাকে আশ্রয় করে অনুশীলনের গভীর স্পর্শে অবয়ব মেলে ধরে আবৃত্তি। কবি তার বিশেষ আবেগ, চিত্রকল্প এবং গল্পের পরিস্ফূটন ঘটান কবিতার মাধ্যমে। আর আবৃত্তিকার কণ্ঠের সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনায় যথাযথ আবেগ, প্রমিত উচ্চারণের দ্যোতনায় রাঙিয়ে তোলেন প্রতিটি শব্দকে। শ্রোতাকে করে রাখেন শব্দের মায়াজালে আচ্ছন্ন। আবৃত্তি হচ্ছে শিল্পীর স্মৃতির ধারাবাহিক সবাক চিত্র। শিল্পী যে কাজ করেন রং দিয়ে, কবি সে কাজ করেন শব্দ দিয়ে,আবৃত্তি শিল্পী সে কাজ করেন কণ্ঠস্বর দিয়ে।  মনে করা যাক কবিতা যদি হয় দেহ, আবৃত্তি হল তার প্রাণ। 

প্রাচীনকাল হতে আবৃত্তিচর্চা হয়ে আসছে। বাংলা অঞ্চলে আধুনিক আবৃত্তি চর্চার সূচনা হয় মূলত রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। তবে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর ঢাকা বেতারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আবৃত্তি প্রচলন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে গণসংগীত ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি কবিতা আবৃত্তিও বিশেষ প্রাধান্য পেতে থাকে। ধীরে ধীরে আবৃত্তি জায়গা করে নেয় সবার মনে। তার সাথে সাথে আবৃত্তির জীবনদানকারী আবৃত্তিশিল্পীরা ও জায়গা পায় সাহিত্য মহলে। আবৃত্তিশিল্পী তার অন্তর উৎসারিত শক্তির বলে,স্বরবৈচিত্র্যে কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন, যা কবিতা প্রেমী ও শ্রোতার কাছে পৌঁছে যায়। আবৃত্তি হলো কবিতার শ্রেষ্ঠ প্রচার মাধ্যম। যারা আবৃত্তি করে তাদের দুর্ধর্ষ ধনী এবং কণ্ঠের জাদুতে চেনা কবিতার লাইনগুলো অন্য এক আবেগ ভালোবাসা নিয়ে আমাদের মনকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে।

বর্তমান সময়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে শোনা যাচ্ছে অসুস্থতার শ্লোগান। অভিমানী পৃথিবী আজ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আমাদের লালন করতে করতে।  এ বিপর্যস্ত  জনজীবনে বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় অদৃশ্য এক শত্রুর কলতান। পৃথিবীর ইতিহাস যেন নতুনভাবে রূপ নিল এ করোনাকালে। সব পেশার মানুষকে যেন গৃহবন্দি করে রেখেছে এ করোনাভাইরাস। 

গোটা পৃথিবী স্তব্ধ হলেও আমরা স্তব্ধ নই। অনলাইন নির্ভর এই ভূমণ্ডলে কিছুই থেমে থাকার নয়। কবি- সাহিত্যিক- সংস্কৃতিবিদদের মধ্যকার ভালোবাসা কোনো শক্তি-ই  আটকাতে পারবে না। 

তাই আমরা যারা কবিতা পছন্দ করি, কবিতার গভীরতা, আবেগ, অনুভূতিগুলোকে কোনো প্রিয় আবৃত্তি শিল্পীর কণ্ঠে গভীর ভালোবাসায় উপলব্ধি করতে চাই, যারা আবৃত্তি করতে চাই কিংবা শিখতে চাই সেই সবার কথা মাথায় রেখে "আবৃত্তি Online" নামক প্রতিষ্ঠানের শুরু। "আবৃত্তি অনলাইন" সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়াজাল ছিন্ন করে বিশ্বময় বাংলা ভাষাভাষীদের বেঁধেছে আবৃত্তির ছন্দে।

গোটা বিশ্ব যখন অদ্ভুত এক অস্থির আতংকে দোদুল্যমান, সেখানেই "আবৃত্তি অনলাইন" এক পশলা মানসিক প্রশান্তি। কর্মব্যস্ত শহুরে জীবনে ক্লান্ত শরীরে দিনশেষে বাইরে তাকালে হয়তো চাঁদের আলো কিংবা জোনাকি আর ঝিঁঝিঁ পোকার সমাগম মিলবে না ঠিক, তবে আবৃত্তির আশ্চর্য শক্তি আমাদের    মুহূর্তেই নিয়ে যেতে পারে রূপকথার মতো কাব্যিক জগতে, অনিন্দ্য সুন্দর সেই উচ্চারণ আবৃত্তির ভেতর দিয়ে। 

তাই বলা যায়, মধ্যরাতের নিঃসঙ্গতাই হোক কিংবা অনলাইন আড্ডা-ই হোক সব কিছুর সঙ্গী "আবৃত্তি অনলাইন"। প্রতিষ্ঠানটি বরেণ্য আবৃত্তি শিল্পীদের নিয়ে নিয়মিত লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করে চলেছে। ভার্চুয়াল এই প্লাটফর্মটি প্রতি সপ্তাহে আবৃত্তি লাইভের পাশাপাশি আবৃত্তি বিষয়ক আলোচনা 'আবৃত্তি কথন' এবং অডিও পডকাস্ট 'হ্যালো নিশুতি' প্রচার করছে পাক্ষিকভাবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবৃত্তি প্রাণ মানুষদের জন্য "আবৃত্তি অনলাইন" তাদের অনুষ্ঠানগুলো "আবৃত্তি  Online" এর ফেইসবুক পেজ, গ্রুপ, ইন্সটাগ্রাম এবং ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করে। 

"আবৃত্তি অনলাইন" এর মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবীর সব আবৃত্তি শিল্পী ও কবিতা প্রেমিদের একত্র করা। সেই  লক্ষ্যে অটুট থেকে "আবৃত্তি অনলাইন টিম"- এর অ্যাডমিন ও মডারেটররাও নিয়মিত একনিষ্ঠ পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাদের নিজস্ব সমবেত বাণী হলো- 'কবিতা এক আশ্চর্য শব্দময় ধ্বনি আর আবৃত্তি তার প্রতিধ্বনি'। 

অনলাইন আবৃত্তি চর্চার অন্যতম এই প্লাটফর্ম আবৃত্তির প্রসারে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে এবং খুবই স্বল্প সময়ে ব্যপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। 

তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালির সংস্কৃতি ও বাঙালির কবিতা সারা পৃথিবীতে পৌঁছে দেওয়া আমাদের কর্তব্য। বাংলার বিখ্যাত যেসব কবিগন তাদের কবিতার মাধ্যমে  আজও অমর হয়ে আছেন, সেসব কবিতার ভাব, আবেগ এবং গভীরতা সারাবিশ্বে মেলে ধরেছে "আবৃত্তি অনলাইন"। এ কারণেই খুবই স্বল্প সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা কাব্যনুরাগী মানুষের মনের অন্তর্জালে ঠাঁই পেয়েছে এই ভার্চুয়াল প্লাটফর্মটি। এক কথায় বলা যায়, পরিশীলিত বাকরীতির মাধ্যমে বাংলা ভাষার উৎকর্ষতা বাড়িয়ে বাংলা ভাষার মাধুর্যতা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ে আবৃত্তিকে একটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে "আবৃত্তি  অনলাইন" চেষ্টা করে যাচ্ছে।