তরুণদের উপর যোগযোগ মাধ্যমের প্রভাব: সাইট বন্ধ নাকি সচেতনতা তৈরিতে সমাধান?  

রাহাত রাফি
Published : 2 March 2019, 01:52 PM
Updated : 2 March 2019, 01:52 PM

যোগাযোগ  মাধ্যম কী শুধু একটা মাধ্যম  যার  মধ্যে দিয়ে আমরা যোগাযোগ করি? তথ্য প্রদানে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি যোগাযোগ মাধ্যম জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ, জ্ঞান সমৃদ্ধ একটি শক্তিশালী সমাজ গঠন, কিংবা একটি ভারসাম্যমূলক সমাজব্যবস্থা গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে৷ গত কয়েক শতক ধরেই দেখা গেছে যে, যে সব সভ্যতা সবচেয়ে আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার হয়েছে তত দ্রুতই তারা এগিয়ে গেছে৷ উত্তরের দেশগুলোতে যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ইতিহাস বেশ পুরনো৷

জার্মানিতে প্রথম পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল ১৫৭৫ সালে, সমসাময়িক সময়ে ইংল্যান্ডেও ছাপা হরফে গণমাধ্যমের ব্যবহার শুরু হয়৷ তার পর থেকে বিশ্বব্যাপী গণযোগাযোগ মাধ্যমের ক্রমাগত বিকাশ তাদের হাত ধরেই ঘটেছে৷ আর এর মধ্য দিয়েই তারা নিজেদের নিয়ে গেছে উন্নতির দিকে৷ আজকে আমরা জ্ঞান, বিজ্ঞান কিংবা একটা ভারসাম্যপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উদাহরণ দিতে গেলে তাদের দিকেই আঙ্গুল তুলি৷ ১৯৯০ সালের পরে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের সূচনাও তাদের হাত ধরেই৷ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের সুচনা গণযোগাযোগ প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে৷ বলা হচ্ছে যে, যোগাযোগ প্রযুক্তির আধুনিক ব্যবহারের কারণে যোগাযোগের ক্ষেত্রে 'সময়' এবং 'স্থানগত' যে পার্থক্য ছিল সেটি অস্পষ্ট হয়ে গেছে৷ মানুষ এখন স্থান ও সময়ের বাঁধা ডিঙ্গিয়ে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে৷ আকর্ষণীয়, তাৎক্ষণিক ও ফলপ্রসূ সুবিধা থাকার কারণে সারা বিশ্বজুড়েই মানুষ এখন ইন্টারনেমুখী৷ ইউরোপের গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টা ডটকম বলছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন৷ ইন্টারনেট ব্যবহারের এ সংখ্যা বাংলাদশেও বাড়ছে বিস্ময়করভাবে৷ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯১ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ১০ লাখ৷ পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ইন্টারনেট  ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে৷

যোগাযোগ এর নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বলছে, ইন্টারনেটে একজন মানুষের অবস্থান তাকে তার আইডেন্টিটি গঠনের একটি মসৃণ ভিত্তি দেয়৷ ক্ষমতা ও সম্পদ দ্বারা তীব্রভাবে বিভাজিত আমাদের সমাজব্যবস্থায় সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী খুব সহজে জনপরিসরে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারে না৷ কিন্তু ইন্টারনেটে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বৈষম্যকে ঠেলে দিয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে৷ আবার স্বভাবগতভাবেই মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগে আবদ্ধ হতে চায়৷ বিশ্বের অন্য প্রান্তে কি ঘটছে সেটি জানতে কৌতুহলী হয়ে উঠে মানুষ৷ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের অনেকগুলো কারণের মধ্যে এই দুটি কারণ অন্যতম৷

এদিকে ইন্টারনেটে কয়েক বিলিয়ন মানুষের এ উপস্থিতির কারণে এটি হয়ে উঠেছে ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু, যোগাযোগ মাধ্যম ও বিনোদন মাধ্যম৷ আর তাই সারা বিশ্বের কয়েক বিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে নিজেদের উপস্থিত রাখছে ইন্টারনেটে৷ গোত্র-বর্ণ-বয়স-লিঙ্গ নির্বিশেষে আমরা ইন্টারনেটে প্রবেশের সমান অধিকার পেয়ে থাকি৷ স্বাধীন এ প্রবেশাধিকার একদিকে যেমন নাগরিকদের যোগাযোগ প্রক্রিয়া বা তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্ম এর মধ্য দিয়ে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে৷ বলা হচ্ছে যে, তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে বয়:সন্ধিকাল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময়টিতে কিশোর কিশোরীরা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হওয়ার মারাত্বক ঝুঁকিতে রয়েছে৷ কেননা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ- কোটি কন্টেন্ট এর মধ্যে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় বার্তাটি বেছে নেয়ার মনস্তাত্বিক দক্ষতা তৈরি না হওয়ার কারণে, এ বয়সীরাই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে৷

ইন্টারনেটে একজন ব্যবহারকারীর নিরাপত্তার দিকগুলো বিভিন্ন রকমের৷ যেমন ইন্টারনেটে ফেইক নিউজ, সাইবার বুলিং, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর প্রচারণা, উগ্র জাতীয়তাবাদ ধারার প্রচারণা, ব্যক্তিগত আক্রমণ, যৌন হেনস্থাসহ নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকেন ব্যবহারকারীরা৷ এ ক্ষেত্রে উঠতি বয়সের তরুণরাই এ ঘটনাগুলোর স্বীকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে৷ কেনানা, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ সকল বার্তার সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা, যথাযোগ্য বার্তা বাছাই, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বার্তা গ্রহণ করতে পারার মতো মানসিক পরিপক্কতা না থাকার কারণে খুব সহজেই তারা এর নেতিবাচক প্রভাবের স্বীকার হয়৷ যে কারণে তরুণদের মাঝে ইন্টারনেটসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা সমালোচনা চলছে৷ বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি৷

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় কিভাবে আমরা এ প্রজন্মকে ইন্টারনেটে নিরাপদ রাখতে পারবো৷ এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে দুটি পদ্ধতির কথা বলা যেতে পারে৷ একটি হলো, সরকার বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্ষতিকর সাইটগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধ করে দিতে পারে৷ ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছে৷ সম্প্রতি বিটিআরসি পর্নোসাইট বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে৷ শুধু পর্নোসাইটই নয়, এ সময়ে বেশ কিছু বিনোদনমূলক অ্যাপও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে৷ সবার জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়৷ নি:সন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ৷ কেননা আমরা সবাই একটি বিষয়ে একমত যে, প্রতিদিন যে সময়টুকু আমরা ইন্টারনেটে ব্যয় করে থাকি সেটি নিরাপদ হোক৷ কিন্তু প্রশ্ন থাকে যে, এ পদ্ধতিটি কতোটা কার্যকর ও টেকসই৷

তথ্য বলছে, ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ইন্টারনেট নিজেদের উপস্থিত রাখছে৷ এই প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নটি তৈরি হয় সেটি হল লক্ষ-কোটি সাইট কিংবা কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করে তাদের উপযোগিতা  নির্ধারণ করা কতটা সম্ভব৷ আবার, সাইট বন্ধ করে দিয়েই যে নিরাপদ থাকা যাচ্ছে তা কিন্তু নয়৷ কেননা, প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে অনেকেই তার পছন্দ মতো কন্টেন্ট ব্যবহার করবে বা করছে যেটি কর্তৃপক্ষ খুব সহজে চিহ্নিত করতে পারবে না৷ তবে আমি এ কথা বলছি না যে তরুণ প্রজন্মকে ইন্টারনেটে নিরাপদ রাখার জন্য সাইট বন্ধ করে দেওয়া কোনও পদ্ধতি নয়৷ অবশ্যই এটি একটি পদ্ধতি। কিন্তু এ পদ্ধতিটি কতটা টেকসই সে প্রশ্নটি থেকে যায়৷

এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে পদ্ধতিটির কথা বলা যেতে পারে সেটি হল ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়ে ব্যবহারকারীকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে দেওয়া৷ পশ্চিমের দেশগুলোতে মূলত এ পদ্ধতিটির উপরেই গুরত্বারোপ করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি৷ একে বলা হয়, জনগণের মধ্যে গণমাধ্যম শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া৷ আলোচনার সুবিধার্থে আমি গণমাধ্যম বলতে আমি এখানে গতানুগতিক যোগাযোগ মাধ্যম (যেমন রেডিও টেলিভিশন, সংবাদপত্র) ও নিউ মিডিয়া (সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম, ইন্টারনেট) দুটোকেই বুঝাতে চাচ্ছি৷

গণমাধ্যম শিক্ষা বলতে বুঝানো হচ্ছে জনগণের মধ্যে গণমাধ্যম থেকে আসা তথ্যের বিষয়ে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা অর্থাৎ তাদেরকে বোঝানো যে, গণমাধ্যম থেকে আসা বার্তার পেছনে একধরনের উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যেটি গ্রাহক হিসেবে আমাদের উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে৷ গণমাধ্যম শিক্ষা ব্যবহারকারীকে গণমাধ্যম ব্যবহার করতে শেখায়, বার্তা যাচাই বাছাই করতে শেখায় ও পাশাপাশি গণমাধ্যমের বার্তার উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শেখায়৷ গণমাধ্যম শিক্ষা একজন ব্যবহারকারীকে গণমাধ্যমের সাথে তার সম্পর্ক কী হবে সে বিষয়ে সচেতন করে তোলে৷ অর্থাৎ গণমাধ্যম বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা থাকলে একজন তরুণ তার নিজের মতো করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনও মাধ্যম থেকে আসা বার্তার বিষয়ে সচেতন হবে এবং সে নিজেই কোন্‌ বার্তাটি গ্রহণ করবে, কোনটি বর্জন করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে৷ পাশপাশাশি কোনও বার্তা বর্জন করার যৌক্তিক কারণও সে খুঁজে নিবে৷

কিভাবে হতে পারে গণমাধ্যম শিক্ষা? গণমাধ্যম শিক্ষার আঁতুর ঘর বলা হয় ফিনল্যান্ডকে৷ প্রায় ৬০ বছর ধরে এ দেশটিতে গণমাধ্যম শিক্ষা কর্মসূচি চালু আছে৷ দেশটিতে কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে ১২ ক্লাস পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীদেরকে গণমাধ্যম বিষয়ে সচেতন করা হয়৷  যেমন ২০১২ সালে দেশটিতে গণমাধ্যম শিক্ষার অংশ হিসেবে 'মিডিয়া ফান' নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়, যেখানে শিক্ষার্থীদেরকে খেলাচ্ছলে শিখানো হয় কিভাবে ও কোন ধরনের মিডিয়া কন্টেন্ট তাদের ব্যবহার করা উচিত৷ শুধু তাই নয়, এ প্রজেক্টের আওতায় অভিভাবক ও শিক্ষকদেরও যুক্ত করা হয়, যেন তারা সঠিকভাবে তাদের সন্তানদের গণমাধ্যম বিষয়ে জ্ঞান দান করতে পারে৷ শুধু ফিনল্যান্ড নয়, ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশ আমেরিকা ও কানাডাতে গণমাধ্যম শিক্ষা একটি গুরুত্বপূরণ বিদ্যায়তনিক শিক্ষার অংশ৷ প্রযুক্তির বিস্তার যে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করেছে সেটি অস্বীকার করার আর কোনও সুযোগ নেই৷ আর এ ভাবনা থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে এ বিষয়ে সচেতন পদক্ষেপ ছিল৷ যে কারণে এ দেশগুলোতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর, উগ্র-জাতীয়বাদের, প্রপাগান্ডা ছড়ানো গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি থাকলেও, সাধারণের উপর তারা ততটা প্রভাব ফেলতে পারে না৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, পশ্চিমের দেশগুলোতে খুব সহসাই কোনও ইন্টারনেট সাইট বন্ধ করে দেওয়ার খবর পাওয়া যায় না৷ কেননা, তারা তাদের নাগরিককে গণমাধ্যম বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন করার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলছে এবং কে কোন্‌ যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করবে সে বিষয়ে নাগরিককেই সিদ্ধান্ত নিতে দিচ্ছে৷

আমাদের দেশের বেলায়ও এটি খুব কার্যকর একটি পদক্ষেপ হতে পারে৷ এর মধ্য দিয়ে যেটি হতে পারে তা হলো যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে শিশুদেরকে সচেতন করে তুলতে পারলে, যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াবে না৷