সয়াবিন তেলের দামে কারসাজি ও যুদ্ধের মজুতদারি মহড়া

সুরেশ কুমার দাশসুরেশ কুমার দাশ
Published : 16 March 2022, 01:15 PM
Updated : 16 March 2022, 01:15 PM

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সয়াবিন তেলের মজুতদারদের অবস্থা দেখলে তেতাল্লিশের মনন্বন্তরের বিভীষিকা মনে উঁকি দেয়। এরকম মনে হবার কারণ, পণ্যমূল্য বাড়ার জন্য যুদ্ধের অজুহাত দেওয়া শুরু হয়েছে। এটা কি সেরকম কোনো ইঙ্গিত– আমাদের মনে যা উঁকি দিচ্ছে তারা সেটা কঠোর বাস্তবতায় পরিণত করতে চায়। অভিযানে মুরগির খামারসহ আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে তেল পাওয়া যাওয়ার খবর আমরা পড়েছি। হয়ত আরো গুপ্ত জায়গায় তেল লুকানো আছে যা অভিযানের প্রেক্ষিতে স্থানান্তর করা হয়েছে বা হচ্ছে।

অথচ ব্যবসায়ীদের এক অংশ (এফবিসিসিআই) বলেছে, পর্যাপ্ত ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে যাতে অন্তত রোজার মাস পর্যন্ত সংকটের কোনো কারণ নেই। তারাও এক্ষেত্রে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি রয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ঘাটতি না থাকার পরও সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক। গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এই কথা থেকেই বোঝা যায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে সেরকম কিছু লোক আছেন।

সয়াবিন তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা সেই যুদ্ধের কথাই আনছেন। যদিও আমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে। যাদের সাথে খাদ্যপণ্যের মধ্যে বিশেষত গমের সম্পর্ক ছাড়া অন্যকিছুর সম্পর্ক নেই। আর আছে জ্বালানি খরচের বিষয়টা। এসব দেখেশুনে ভোজ্যতেলের ব্যাপারে হাইকোর্টও বেশ তৎপর। কারণ ভোজ্যতেলের মিলার, ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতাদের এ বিষয়গুলো সবার মধ্যেই বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেউ বিনামূল্যে কিছু চায় না। এমনকি বেশি দামে বেচলেও ভোক্তারা সেটা কিনে খায়। কিন্তু তারা যে তেল লুকিয়ে ফেলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে, সেটা অত্যন্ত মারাত্মক খবর। ভয়াবহ এবং পৈশাচিক।

তেলের ব্যাপারটা না হয় মানলাম। ধরা যাক, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তেলের ব্যবহার বাদ দিয়ে বা কমিয়ে না হয় চালিয়ে নিলো সবাই। কিন্তু এই অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে যদি চালের বাজারটা পড়ে, চালের নিয়ন্ত্রণ যদি তাদের হাতে চলে যায় তাহলে দেশের মানুষের কী হবে! সয়াবিন তেল নিয়ে ক্রেতার সাথে লুটপাট এবং সরকারের সাথে রীতিমতো লুকোচুরি খেলছে তারা। সরকার তাদেরকে যদি এত সহজে বিশ্বাস করে তাহলে ভবিষ্যতে তারা জনগণের ঘাড় আরও মটকে দিতে প্রস্তুতি নেবে। জনগণ সরব হবার পর সরকারের কিছু পরিকল্পনার কারণে হয়তো তারা তাদের টার্গেট পূরণ করতে পারছে না। কিন্তু তারা যদি আরও বড় পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে! তেলের ক্ষেত্রে নয়, সেটা যদি চালের ক্ষেত্রে হয় বা অন্যান্য খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে! তাই এখানে থেমে গেলে চলবে না।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা জনগণের কাছ থেকে এক হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে ১৫ দিনে। তিনি এই লুটের একটা হিসেব দাঁড় করিয়েছেন। এই লুটের টাকা তো সুদে আসলে লুটের শাস্তিসহ জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার কথা। বিচার-সালিশে তো তাই হয়। কীভাবে তারা এত টাকা লুট করলো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে মিটিংও হয়। কারণ, মিটিং থেকে সিদ্ধান্তের পরই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সেখানে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রকৃত কোনো খবর মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারীদের কাছে ছিল কিনা কে জানে!

বাজার ব্যবস্থাপনার এই জায়গাগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি, নানা অজুহাত-আবদার করে অবৈধ লাভ শুধু ব্যবসায়ীদের পকেট ভারি করে। এ কারণে অনেক রাজনীতিবিদের মুখ থেকে বের হয়েছিল ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে কীভাবে জাঁকিয়ে বসেছে। কারণ, ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ যারা তাদের কাছে ব্যবসায়ীর কস্ট ও কষ্টের উপলব্ধিটা বেশি। আর যারা জনগণের কাতারের রাজনীতিবিদ তারা হয়তো জনগণের কথাটা বেশি উপলব্ধি করতেন।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানের প্রসঙ্গ থেকে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর প্রসঙ্গে যাই। গোলাম রাব্বানী তার ফেইসবুকে লিখেছেন,

'বেশ কিছুদিন যাবত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখছি, আমদানিকারক ও মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ সয়াবিন তেলের অস্বাভাবিক মুল্যবৃদ্ধির জন্য বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে দায় এড়াতে মরিয়া! জাস্ট কিউরিসিটি থেকে গতকাল পরিশোধিত সয়াবিন তেল (রিফাইনড সয়াবিন অয়েল) এর পাইকারি মূল্য যাচাই করতে গ্লোবাল এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কমোডিটিতে সয়াবিন তেলের পাইকারি মূল্য যাচাই করতে মেইল করেছিলাম।'

তাদের রিপ্লাই থেকে হিসাব করে রাব্বানী ওই ফেইসবুক পোস্টে দাবি করেন, 'রপ্তানিকারক থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো অবধি সকল ব্যয়ভার বহন ও সম্ভাব্য মুনাফা যোগ করেও লিটার প্রতি ১২৮-১৩০ টাকায় সয়াবিন তেল পৌঁছানো সম্ভব, প্রয়োজন শুধু ইতিবাচক মানসিকতা, সদিচ্ছা, সততা ও দেশপ্রেম।'

সেই ব্যবসায়ীদের সততা, দেশপ্রেম, সদিচ্ছা আমাদের জানা-বোঝা হয়ে গেছে। ধর্মের কাহিনী কখনো চোরদের চুরি থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে জনগণের পকেট কেটে যে এক হাজার কোটি টাকা লুট করেছে তার কী জবাব দেওয়া হবে? যে কারণে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণের এক রিটে হাইকোর্ট বলেছে, এখানে সবার স্বার্থ জড়িত।

আর টিসিবি যে তেল বিক্রি করে তার দামও রাব্বানীর দেওয়া তালিকার মতো হয় না। কারণ সরকারও স্থানীয় আমদানিকারকদের কাছ থেকেই তেল কিনছে। এই কারণে সরকারও বেশি কম দামে তেল দিতে পারছে না। সেখানেও সরকারের ক্ষতি তথা জনগণের টাকাই যাচ্ছে। আপাতত ভালোয় ভালোয় ব্যবসাযীরা টিসিবিকে সরবরাহ দিচ্ছে। কিন্তু কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে তারাও যদি সেই সিন্ডিকেটে ঢুকে পড়ে! তাহলে কী হতে পারে? শুধু ব্যবসায়ীদের আবদারে এত দ্রুত সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে।

সবশেষ সরকার তাদের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে সায় না দেওয়ায় লুটেরা ব্যবসায়ীদের থলের বেড়াল বের হয়েছে। এর আগে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মিটিং-সিটিং করে এসে আবার সিন্ডিকেটবাজি চালিয়ে গিয়েছে তারা। দাম বাড়ানোর নতুন নতুন অজুহাত (প্রস্তাব) দিয়েছে। যতবার তাদের কথা শুনেছে- ততবার তাদের কাছে কি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের খবর ছিল। বা বাজারে সরবরাহ খরচের খবর। জানা থাকলে মিটিং থেকে বের হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম নিরপেক্ষ জায়গা থেকে সংবাদ মাধ্যমকে জানানো উচিত।

শুধু ব্যবসায়ীদের জন্য উপরি লাভের কথা ভাবলে তারা এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার সুযোগ পাবে। শুধু ক্ষমতার নিরাপত্তার জন্য পণ্যমূল্য ব্যবসায়ীদের মনমতো হলে চলবে না।

আর যারা অহরহই আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলছে, তারা স্থানীয় বাজার মূল্যে কোনো পণ্য ক্রয় করতে পারে কিনা– সেটা ভাবনার সময় এসেছে। তারা বিক্রয় করতে গেলে বারবার আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে কিন্তু স্থানীয় বাজারের পণ্য কেনার সময় কি তারা আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী মূল্য দেয়? এ বিষয়টা সুরাহা করার কথা অর্থনীতিবিদদের। তার নিজের পণ্য বিক্রি করতে আন্তর্জাতিক বাজার দর চাইবে, আর অন্যের পণ্য তারা স্থানীয় বাজার দরে কিনবে কীভাবে?

দুর্ভিক্ষের কথা বলে এই লেখা শুরু করেছিলাম। সেই ১৯৪৩ সালের চরম দুর্ভিক্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি। কেন সেই সময় বাংলা ও ভারতে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। মানুষ কচু-ঘেঁচু, শাক-লতাপাতা, শামুক-গুগলি এমনকি গাছের পাতা খেয়েও বাঁচার চেষ্টা করেছে। যখন আর কিছু খেতে পায়নি তখন মানবিক বিপর্যয় তো ছিলই, লাখে লাখে (৩০ লাখ) মানুষ মরেছে কঙ্কালসার হয়ে পথেঘাটে সর্বত্র। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রে এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারি। বাংলা ভাষার অমর কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের 'অশনি সংকেত'- এ আছে সেই ভয়ে আঁৎকে ওঠার চিত্র। কিংবা ক্ষুধার আর্তিতে আর্ত হওয়ার চিত্র। আর অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় অনেক কাজ হয়েছে। সেই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটিশ বেনিয়া এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির কর্মকাণ্ডের কারণে। তারা এই অঞ্চলের সমস্ত খাদ্য যুদ্ধ চালানোর জন্য মজুদ করেছিল। সাধারণ মানুষের জন্য বাজারে কিছুই ছিল না। সম্পন্ন কৃষক আর জমিদারদের গোলা লুটপাট করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভাতের মাড় চেয়ে তাও পাওয়া যেত না। এখানে ব্রিটিশদের অরাজকতা-রাহাজানির একটা করুণ চিত্র হচ্ছে সেই ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ। ব্রিটিশরা নেই কিন্তু আজও কিছু ব্যবসায়ীর মনের মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ বেনিয়াদের পৈশাচিকতা। সামনে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে ভোক্তাদের তথা জনগণকে 'আন্তর্জাতিক ঘানিতে' পিষে তেল বের করে গায়ে মাখবে সেইসব ব্যবসায়ী। হয়ত চাল-ডাল, আটা, কচু-ঘেঁচু সব কিছু মজুদ করে লুটতেও কার্পণ্য করবে না। আর তখন তো অজুহাতের অন্ত থাকবে না।

এত মাতামাতির পরও সেইসব মজুতদার দুশমনদের নাম জনগণ জানতে পারে না। সব সময় কিছু চুনোপুঁটিদের নাম সামনে নিয়ে আসা হয়। যেমন জানা যায় না- পেট্রোল বোমা হামলাকারীদের গডফাদার, হেফাজতের তাণ্ডব সৃষ্টির পেছনের অর্থ জোগানদাতাদের, প্রতিমা ভাংচুরকারীদের নেপথ্যের অপশক্তিদের, জঙ্গিদের অর্থ জোগানদাতা গডফাদারদের নামও। তাদের নাম বলবে বলবে করে আর বলা হয় না। কী সম্পর্ক তাদের সাথে- যারা রাষ্ট্র, জনগণ ও সংবিধানের শত্রু?