আওয়ামী লীগ যদি বলে উত্তর দিক, বিএনপি বলে দক্ষিণ

মো. ইকবাল হায়দার
Published : 5 March 2022, 12:41 PM
Updated : 5 March 2022, 12:41 PM

নানা কারণে ইদানিং পত্রপত্রিকায় লেখা হয়ে ওঠেনা। পায়ে কিছুটা আঘাত পাওয়ায় সিএমএইচ হাসপাতালে শুয়ে কিছুটা অবসর পেলাম। ভাবছিলাম বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি নিয়ে। ভাবনার বিষয়ের মূলভাব এক কথায়- 'আওয়ামী লীগ যদি বলে উত্তর দিক, বিএনপি বলে দক্ষিণ'।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ যে মেরুতে অবস্থান করে, বিএনপি ঠিক তার বিপরীত মেরুতে। এখন ইউক্রেইন ইস্যু চলছে। সে ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকার 'নিরপেক্ষ' অবস্থান নিয়েছে জাতিসংঘের অধিবেশনে। বিএনপি যে আওয়ামী লীগের এ অবস্থান নিয়ে কটাক্ষ করবে তা এক প্রকার অনুমিতই ছিল। অথচ হয়তো দলটি ক্ষমতায় থাকলেও, একই ধরনের কূটনৈতিক অবস্থান নিত। আমরা যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশে দেখি- এই ইস্যুতে তাদের নেতৃত্বস্থানীয় দলগুলো কিন্তু অন্তত মোটাদাগে জাতীয়ভাবে একমত পোষণ করছে।    

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সবসময়ই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছে, করছে। অর্থাৎ জাতীয় কোনও বিষয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগের সাথে কখনো একমত হতে পারেনি। এমনকি স্বৈরাচার পতন বিরোধী আন্দোলনেও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল সম্পূর্ণ আলাদা!  

আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৯ সালে রোজ গার্ডেনে, আর বিএনপির জন্ম হয়েছিল ১৯৭৮ সালে ঢাকা সেনানিবাসে। আওয়ামী লীগ  বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রমনা রের্সকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।" আমি তখন সরকারি তিতুমীর কলেজে (সাবেক জিন্নাহ গভর্মেন্ট কলেজ) এর ইন্টারমেডিয়েটের ছাত্র ছিলাম। আমার কাছে তো ওটাই স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল! সেই কৈশোরেও বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা বুঝতে তো একটুও অসুবিধা হয়নি।  

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। অথচ বিএনপি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রচার করেছে, করছে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান করাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু সরকার বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য বিদেশের অনেক দেশের সাহায্য সহাযোগিতা কামনা করেন। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারত সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য যে সহযোগিতা করেছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

মুক্তি সংগ্রামে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সাড়ে ৪ হাজারের মতো সেনা শহীদ হন।  আর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীকে ট্রেনিং এবং অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন। দীর্ঘ ৯ মাস ভারতের সীমান্তবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি জনগণকে আশ্রয় দেওয়া হয়। এসময় ইন্দিরা গান্ধী আবার বিভিন্ন দেশ সফর করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমতও আদায় করেন।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। সেই সময়ে বাংলাদেশের পুনর্গঠনের গতি ছিল বিস্ময়কর। একথা ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশগুলোর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই বঙ্গবন্ধু ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে সচল করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সংবিধান থেকে শুরু করে কেন্দ্রিয় ব্যাংক, আন্তজার্তিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সামাজিক অস্থিরতার মোকাবেলা, পর পর দুই বছর খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ- এসবকিছুই তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। 

পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে হত্যার শিকার হলে বাঁকবদল হয় ইতিহাসের। কুচক্রী ও বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মুশতাক রাষ্ট্রপতি হয়ে  জিয়াউর রহমানকে করেন সেনাপ্রধান। এরপর দেশ একযুগেরও বেশি সময় চলে প্রকান্তরে সামরিক শাসনের ছত্রচ্ছায়াতেই।

এসময় বঙ্গবন্ধু জ্যেষ্ঠ কন্যা জানের পরোয়া না করে শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। বলা যায়, রাজপথের।  এসব ইতিহাস সবারই জানা রয়েছে।

১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর আবারও বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচনী কৌশলের কাছে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। তাই প্রথমবারের দলটি তার সুদূর উন্নয়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাঝপথেই থেমে যায়। তারপর আবার সংগ্রাম এবং অবশেষে আওয়ামী ক্ষমতায় আসে।  

একযুগেরও বেশি সময় আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় রয়েছে। এসময় উন্নয়ন হয়েছে বিস্ময়কর। ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। লাগাতার হরতাল দিয়ে, রেললাইন উপড়ে ফেলে, বড় বড় গাছ কেটে ফেলে, মুমূর্ষু রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স পুড়িয়ে দিয়ে দেশে তাণ্ডব চালায় বিএনপি-জামায়াত জোট। 

২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোনে গণভবনে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানান। প্রায় ৪০ মিনিট দুইজনের মধ্যে কথাবার্তা হয়। দেশবাসী তাদের দুই জনের আলাপচারিতা শোনেন। ২০১৪ সালে খালেদা জিয়া যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন সেইজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বলেন, "আসুন সবাই মিলে সর্বদলীয় সরকার গঠন করি।" শেখ হাসিনা এটাও বলেন, "স্বরাষ্টমন্ত্রণালয়সহ যেকোনও মন্ত্রণালয় আপনাকে (খালেদা জিয়া) দিব"। তবুও বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার অনুরোধ রক্ষা করেননি। বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি।

বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ সরল বিধায় রাজনীতির অতোটা মারপ্যাঁচ বোঝে না। যদি তাই হত,  বিএনপি কখনও ক্ষমতায় আসতে পারত না। বিএনপির একজন সাবেক সংসদ সদস্যের সাথে রাজনীতি নিয়ে আমার অনেক আলোচনা হয়েছে। বিএনপি বাংলাদেশের সংবিধানেই বিশ্বাস করেনা এবং বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মেনে নিতে তারা এখনো রাজি নয়।

বিরোধীদল শুধু সরকারের বিরোধিতা করার জন্য নয়। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করাই বিরোধীদলের প্রধান কর্তব্য। সার্চ কমিটির মধ্য দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের বাকিরা নিয়োগ পেয়েছেন। সামনে আবার নির্বাচন আসছে। 

বাংলাদেশের জনগণের একটি অংশ আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকারী। সে সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। প্রকৃত গণতন্ত্র সচল রাখতে সব মানুষের অংশগ্রহণে নির্বাচন প্রয়োজন। তাই বিএনপিকে অনুরোধ থাকবে, বাংলাদেশের জনগণের যে ভোটাধিকার সেই জায়গা তৈরি করতে যেকোনও টুটকা-ফাটকা ইস্যুতে যেন গো ধরে না থাকে। নির্বাচন থেকে নিজেদের যেন দূরে না রাখে। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই বিএনপির অস্তিত্ব টিকবে। সেই সঙ্গে দলটি তার নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদেরও আস্থার প্রতিদান দিতে পারবে। সেই অংশগ্রহণ হতে হবে সর্বাত্মক। ২০১৮ সালের মতো 'আধা যাবে- আধা যাবো না' মনোভাবে নির্বাচন করলে হবে না। সেটি হলে কেবল হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন-ক্ষণ গুণতে হবে।