পোশাক শিল্পে ইউনিফায়েড কোড অব কনডাক্ট কেন প্রয়োজন

আশিকুর রহমান তুহিন
Published : 2 Dec 2021, 12:51 PM
Updated : 2 Dec 2021, 12:51 PM

সম্প্রতি ৯০টির বেশি পোশাকের ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতা 'ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড ফর হেলথ অ্যান্ড সেইফটি ইন দ্য টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি' নামে নতুন চুক্তিতে যুক্ত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী দুই বছর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার বিষয়টি পরিদর্শন করবে এই ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড। আগের 'অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ'-এর ধারাবাহিকতায় খুচরা বিক্রেতা, ব্র্যান্ড এবং আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নতুন এই চুক্তি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ২০১৯ সালে আদালতের নির্দেশনায় 'অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ' চলে গেলে কারখানার কর্মপরিবেশ, শ্রম নিরাপত্তাসহ অন্য বিষয়গুলো দেখভালের জন্য 'আরএমজি সাসটেইনেবলিটি কাউন্সিল' বা আরএসসি কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নেয়। এরপর থেকে আরএসসি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আরএসসি একটি স্থায়ী জাতীয় সংগঠন। পোশাক প্রস্তুতকারক বা মালিকপক্ষ, পোশাকখাতের বায়ার বা আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও পোশাক শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক প্রতিনিধিরা এর সদস্য। নতুন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ডে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে আরএসসি-এর চলমান কার্যক্রমে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নতুন চুক্তি করা ব্র্যান্ডগুলো। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে নতুন করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড ফর হেলথ অ্যান্ড সেইফটি কেন গঠন করা হলো।

সত্যিকার অর্থে বললে, নিরাপত্তা পরিদর্শনে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে এ ধরনের উদ্যোগের ঘটনা নতুন কিছু নয়। সোশ্যাল কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন বায়ার ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা দিয়ে থাকেন। পোশাক কারখানাগুলোকেও সেসব চাহিদা পূরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে শুধু অর্থ নয়, সময় এবং শ্রম ‍তিনটিই ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে ইউনিফায়েড কোড অব কনডাক্ট-এর প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন যাবত অনুভূত হচ্ছে। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক পরিসরে ইউনিফায়েড কোড অব কনডাক্টের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। কারণ পোশাক শিল্পে নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্বে বিশ্বে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করে আসছে বাংলাদেশ।

পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, আশির দশকের শুরুতে হাঁটি হাঁটি পা পা করে গার্মেন্টস সেক্টরের যাত্রা শুরু। সেখান থেকে আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক বিক্রেতা বাংলাদেশ। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে পোশাক শিল্পের মালিক-শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল বিশ্বে এই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া। পোশাক শিল্প এখন বাংলাদেশের জাতীয় শিল্প। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪% অর্জিত হয় তৈরি পোশাক থেকে।

দেশের পোশাক শিল্পের শুরুটা অপরিকল্পিত হলেও ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখন অর্গানাইজড কমপ্লায়েন্স শিল্পে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা এবং দেশীয় আইন অনুযায়ী পোশাক শিল্প কারখানাকে ১০০% কমপ্লায়েন্সের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।

শুরুটা বাংলাদেশ ফ্যাক্টরি রুলস ১৯৭৯ অনুসরণের মধ্য দিয়ে। এরপর বিভিন্ন ক্রেতার নিজস্ব code of conduct (COC)-এর আলোকে। আবার কখনো WRAP, BSCI, SEDEX অথবা এই ধরনের সার্টিফিটেকের মাধ্যমে বাংলাদশের পোশাক শিল্প কারখানাগুলো কমপ্লায়েন্স প্রতিপালন করে আসছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প পরিণত হয়েছে সোশ্যাল অ্যান্ড সেইফটি কমপ্লায়েন্স পরিপূর্ণ শিল্পে। শিশুশ্রমের সমাপ্তি, কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। ILO গাইডলাইন এবং দেশের আইন অনুযায়ী শ্রমআইনে পরিবর্তন এনে যুগোপযোগী করা হয়। এখন পোশাক শিল্পে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক অনেক সুদৃঢ়।

২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের পর দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। এরপর ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা। আমাদের অর্জিত শ্রম, অর্জন সবকিছু যেন চোখের নিমিষে মিলিয়ে যায়। কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। বিশ্বজুড়ে ক্রেতা, গণমাধ্যম, ডোনার এজেন্সি, শ্রমিক ইউনিয়ন সবাই একই প্রশ্ন তোলে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কতটা নিরাপদ? শুধু পোশাক শিল্প না, পুরো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে।

নিজ ভাষার জন্য যে জাতি প্রাণ উৎসর্গ করেছে, স্বাধীনতার জন্য যে জাতির ৩০ লক্ষ সূর্যসন্তান প্রাণ দিয়েছে, মর্যাদার প্রশ্নে তাদেরকে কি দাবায় রাখা সম্ভব? নানা অঘটনের পর শুরু হয় পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের পরীক্ষা। আন্তর্জাতিক ক্রেতা, লেবার ইউনিয়ন সবাই মিলে গঠন করে অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স। কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপিয়ান ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত হয় 'অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ'। অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের পাশাপাশি বাংলাদেশের কলকারখানা অধিদপ্তর সমস্ত কারখানাগুলোর বিল্ডিং, ফায়ার এন্ড ইলেকট্রিক সেফটি ইন্সপেকশন শুরু করে। পোশাক শিল্প উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আর্ন্তজাতিক মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশকে এমন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়নি। বাংলাদেশের গার্মেন্টস আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত, নিরাপদ ও স্বীকৃত শিল্প। যা প্রতিনিয়ত পরিদর্শনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। হংকংভিত্তিক কিমার সাম্প্রতিক জরিপে ইথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যবিধি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিশুশ্রম, কর্মঘন্টা, বেতন ও কর্মীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয় এতে বিবেচনা করা হয়। শুধুমাত্র তাইওয়ান বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। আমাদের প্রতিযোগী দেশ চীন, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ভারত সবাই বাংলাদেশের পেছনে।

ইতোমধ্যে পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের আওতায় পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্পের দিকে ঝুকেছে। যা আমাদের পোশাক শিল্পকে বিশ্বের বুকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪৪টি গ্রিন সার্টিফাইড ফ্যাক্টরি রয়েছে। প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে আরো ৫০০ কারখানা। বিশ্বের শীর্ষ ১০০ গ্রিন ফ্যাক্টরির মধ্যে ৩৯টিই বাংলাদেশে।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে দীর্ঘ পথচলায় বহুবার পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমাদের পোশাক শিল্প পরীক্ষিত ‍ও পরিণত। ফলে সময় এসেছে আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য একটি ইউনিফায়েড কোড অফ কনডাক্ট তৈরি করার। একমাত্র বাংলাদেশের পক্ষেই এটা সম্ভব। কারণ বিশ্বের অন্য কোনো দেশ আমাদের মতো নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্বে উন্নতিসাধন করেনি। ইউনিফায়েড কোড অফ কনডাক্ট তৈরি হলে, বারবার নতুন নতুন কোনো কোড অব কনডাক্ট বা সেইফটি রিকোয়ারমেন্ট দিতে হবে না বায়ারদের। এতে করে পোশাক শিল্প কারখানা ও উদ্যোক্তাদের হয়রানি কমবে। বাঁচবে শ্রম, অর্থ ও সময়। একইসাথে এটা ক্রেতাদের জন্যও সুবিধাজনক হবে। পোশাক প্রস্তুকারকরা ইউনিফায়েড কোড অফ কনডাক্ট পালন করছে কিনা পরিদর্শনের মাধ্যমে দেখতে পারবে বায়াররা। প্রত্যেক বায়ারও নির্দিষ্ট নির্দেশিকা প্রতিপালন করবে। এটা সবার জন্যই সুবিধাজনক হবে। পোশাক শিল্পে বিশ্বের সামনে একটি উদাহরণ তৈরি করতে পারবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকার, পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সংস্থা, ক্রেতা এবং ক্রেতাদের সংস্থা মিলে ঐক্যমতের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য একটি ইউনিফায়েড কোড অফ কনডাক্ট তৈরিতে এগিয়ে আসতে পারেন। এই উদ্যোগ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের জন্য এক উজ্জল দৃষ্টান্ত হতে পারে।