বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ১৯ নভেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন , 'বেগম জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে' আছেন। তখন থেকেই বিএনপি, জিয়ার পরিবার, বিএনপির মিত্র রাজনৈতিক দল এবং অন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি ও অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে ইতিবাচক কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে 'রাজনীতি' করছে। বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। তাই দলীয় প্রধানের অসুস্থতা তাদের বিচলিত করেছে এবং সেজন্য তারা তার চিকিৎসার বিষয়ে রাজনীতি করলে অনেকেই তাতে 'দোষ' দেখবে না।
প্রশ্ন আসছে, বিএনপি না হয় রাজনীতি করছে কিন্তু সরকার কী করছে? সরকার কী মানবিকভাবে বিষয়টি দেখছে? ৭৬ বছর বয়সী একজন নারী, যিনি একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে 'জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে' আছেন, তখন তার বিষয়ে আইনের ধারা মুলতবি রেখে উদারতা ও মানবিকতা দেখাতে আপত্তি কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারের তরফ থেকে পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন সময়ে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে যে কিছু বক্তব্য পাওয়া যায়নি তা-ও নয়। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও এ নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটা তিনি করেছেন। দণ্ডিত অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও শাস্তি স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, বিদেশে যাওয়ার অনুমতি খালেদা জিয়া সহজে পাবেন না।
বিএনপিও ছাড়ছে না। বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, আন্দোলন করে তারা সরকারকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করবেন। তারা কিছু কর্মসূচিও পালন করছেন। তবে এতে সরকারের মনোভাবে নমনীয়তার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে চিকিৎসকরা কথা বলছেন না। দেশে যে বেগম জিয়ার চিকিৎসা সম্ভব নয়- সেটা কি তার কোনও চিকিৎসক বলেছেন?
সম্ভবত এ কারণে রোববার খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের কয়েকজন সদস্য তারই বাসভবনে একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে খালেদা জিয়া অত্যন্ত ঝুঁকিতে আছেন। তার জীবন বাঁচাতে হলে একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। আর এই পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প নেই। তার সবশেষ শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, যেকোনও সময় খালেদা জিয়ার অবস্থা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যেতে পারে। তখন আর চাইলেও তার জন্য কিছু করার সুযোগ থাকবে না। এরমধ্যেই তার তিন দফায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। এখন রক্তক্ষরণ বন্ধ থাকলেও যেকোনও সময় আবার প্রবল রক্তক্ষরণের আশঙ্কা আছে। সেই রক্তক্ষরণের মাত্রাও হবে অনেক বেশি। তার মতো বয়সের একজন মানুষের জন্য সেটা অনেক ভয়াবহ হবে।
চিকিৎসকদের এই বক্তব্য প্রচারের পরও সরকারি পর্যায়ে কোনো পরিবর্তনের খবর নেই। বরং সোমবার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্য দিচ্ছেন বিএনপিপন্থি ডাক্তাররা'। মাত্র তিনটি দেশ ছাড়া আর কোথাও খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা নেই বলে চিকিৎসকদের বক্তব্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, শুধু তারেক রহমান যে দেশে পালিয়ে আছেন সেই দেশ এবং তার কাছাকাছি দুটি দেশে উন্নত চিকিৎসা আছে এটাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন তিনি।
তাহলে কি খালেদা জিয়াকে কোনওভাবেই চিকিৎসা নিতে বাইরে যেতে দেওয়া হবে না? এ প্রশ্নের 'হ্যাঁ' বা 'না' উত্তর শুধু সরকারই দিতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে সরকারও রাজনীতির বাইরে হাঁটছে না। সেটাও অস্বাভাবিক নয়। সরকার তো দল এবং রাজনীতির বাইরে নয়। সবচেয়ে বড় কথা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটাও বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার নয়। বরং বৈরিতার। এর জন্য দায় কার বেশি বা কার কম, সে বিতর্ক এখানে অপ্রাসঙ্গিক। বলার কথা একটাই, তা হলো বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মানবিক আচরণ একবারের জন্যও করেনি। বরং আওয়ামী লীগ এবং দলের নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টার সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি কষ্টকল্পনার নয়, বাস্তব তথ্য প্রমাণও আছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে নিষ্ঠুরতম আচরণ করে ক্ষমতার বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে মানবিক আচরণ প্রত্যাশা করলে তা পাওয়া কি সহজ হতে পারে?
কেউ হয়তো বলবেন, একজন 'অধম' বলে অন্যজন 'উত্তম' হবে না কেন? হ্যাঁ, এটা বলতে ভালো, শুনতেও। কিন্তু রাজনীতি কি এমন আদর্শবাদী ধারায় আছে? সবক্ষেত্রে নীতিহীনতার চর্চা করে শুধু নিজের পাতে ঝোল নেওয়ার বেলায় সুবচন আওড়ালে তা বেমানানই লাগে। তবে কারো বিপদের সময় তার পাশে দাঁড়ানো, তাকে সহযোগিতা করার মতো মহত্ব আর হয় না। আবার এ মহত্ব আকাশ থেকেও ঝরে পড়ে না। এটা নিয়মিত চর্চা এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এসব থেকে যোজন যোজন দূরেই আছে। শত্রুর সঙ্গে গলাগলি করা রাজনীতিতে সাধারণত চলে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ক্ষমা ও উদারতার নীতি নিয়ে চলছিলেন। কি পরিণতি তাকে বরণ করতে হয়েছে?
আচ্ছা কথার কথা হিসেবে ধরা যাক, সরকার খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য তাদের পছন্দের দেশেই যাওয়ার অনুমতি দিল। চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থও হয়ে উঠলেন। তারপর তার রাজনীতি কি শেখ হাসিনার প্রতি মানবিক ধারায় অগ্রসর হবে, নাকি রাজনীতি চলবে রাজনীতির পথেই?- প্রশ্নটি এই মুহূর্তে কারো কারো কাছে অশোভন মনে হলেও, এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না চাইলে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতি দিতে হবে। এটা আসলে হুমকি। শেখ হাসিনাকে হুমকি দিয়ে কিছু আদায় করা যায় না। তাই এসব হুমকি-ধামকিতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে, কাজের কাজ কিছু হবে না।
বিএনপি বর্তমান সরকারের অনেক সমালোচনা করে থাকে। সমালোচনা করার মতো কাজ সরকার করেনি বা করছে না তা-ও নয়। কোনও সরকারই আসলে শতভাগ ত্রুটিমুক্ত শাসন নিশ্চিত করতে পারে না। বিএনপিও দেশ শাসন করেছে। অনেক সাফল্যের দাবি দলটি করে। গণতন্ত্র কায়েম করেছিল। তারা বলে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাকি অবাধ ছিল। এটা নিয়ে বিতর্ক না করে শুধু একটি প্রশ্ন, বিএনপি চিকিৎসাক্ষেত্রে এমন অবস্থা কেন করতে পারলো যে দলের প্রধানের সুচিকিৎসার জন্য এখন হাহাকার করতে হচ্ছে? কাচের ঘরে বাস করে ঢিলাঢিলির রাজনীতিটা পরিহার করলেই ভালো। খালেদা জিয়া সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে রাজনীতিতে সহনশীলতার চর্চা জোরদার করে তুলুন– এটাই আমাদের প্রত্যাশা।