তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় নিয়ন্ত্রণে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার প্রাসঙ্গিকতা

আবু নাসের অনীকআবু নাসের অনীক
Published : 2 Nov 2021, 12:49 PM
Updated : 2 Nov 2021, 12:49 PM

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুসারে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের উর্দ্ধে ৩৫.৩% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে যার মধ্যে ৪৬% পুরুষ এবং ২৫.২% মহিলা। বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান না করেও পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হচ্ছে বহু মানুষ। এই হার কর্মক্ষেত্রে ৪২.৭%, রেস্তোরায় ৪৯.৭%, সরকারি কার্যালয়ে ২১.৬%, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১২.৭% এবং পাবলিক পরিবহনে ৪৪%।

বিশ্বব্যাপী তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০০৩ সালের মে মাসে ৫৬তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ফ্রেমওর্য়াক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) চুক্তি অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ এই চুক্তির প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ এবং ২০০৪ সালে চুক্তিকে অনুসমর্থন করে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার এফসিটিসি'র আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এবং ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করে।

৩০-৩১ জানুয়ারি, ২০১৬ ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'Summit on Achieving the Sustainable Development Goals' শীর্ষক South Asian Speakers Summit-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দেন। দেশের ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG)-এর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লক্ষ্য-৩ অর্জনে আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসি'র বাস্তবায়ন ও তামাকজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এখন আলোচ্য বিষয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা কী স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়িত হবে? নিশ্চয়ই তা নয়! কোনো সিদ্ধান্তই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়িত হয় না এটাই বৈজ্ঞানিক সত্য। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং আরো কিছু অনুসিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেটি বাস্তবায়ন করতে হয়।

তার আলোকেই তামাকবিরোধী সংস্থাগুলির নিরলস প্রচেষ্টা এবং সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্যকর ভূমিকায় জানুয়ারি ২০২১-এ 'স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা' প্রকাশিত হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের সকল দপ্তর/সংস্থা ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে (সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ) নির্দেশিকাটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২ মার্চ ২০২১-এ স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক প্রজ্ঞাপন (স্মারক নং:৪৬.০০.০০০০.০৮৫.০৬.০৪২.২০১৮-১১৮) জারি করা হয়।

তামাকজাত দ্রব্যের (বিশেষকরে সিগারেট/বিড়ি) যত্রতত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও বিক্রয় সীমিতকরণে 'স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা' একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নির্দেশিকাটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে '২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ' ঘোষণা বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা'র ৮ এর ৮.১-এ বলা হয়েছে, 'তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র বা যেখানে তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় হবে তার জন্য আবশ্যিকভাবে পৃথক ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করা এবং প্রতিবছর নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে আবেদনের মাধ্যমে উক্ত ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা।'

লাইসেন্সিং বলতে আমরা কী বুঝি? লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর করা অর্থ শুধু বৈধতা প্রদান নয়। তারচেয়েও বেশি, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। Investopedia তে বলা হচ্ছে, 'Such a license is a mechanism for government to oversee and in many cases tax, certain business operators. A liquor is an example of this type'.

বাংলাদেশে অনেক নিষিদ্ধ দ্রব্যের ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যাতে সেটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। মদ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কিন্তু এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না, সেকারণে এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য বিক্রেতা-ক্রেতা উভয়ের ক্ষেত্রেই লাইসেন্স আরোপ করেছে সরকার। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার একদিনেই বন্ধ করা সম্ভব নয় এটাই বাস্তবতা, কিন্তু পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে অবশ্যই সম্ভব। যা বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যেই করে দেখিয়েছে। বাংলাদেশে সেই সম্ভবকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য এর ব্যবহার ও বিক্রি কমিয়ে আনতে হবে, আর সেটির জন্য অন্যতম একটি পদক্ষেপ লাইসেন্সিং ব্যবস্থা।

বর্তমান অবস্থায় তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ নেই। লাইসেন্সিং ব্যবস্থার প্রচেষ্টা এর বিক্রয় সীমিতকরণে সাহায্য করবে। বিক্রয় সীমিত করা সম্ভব হলে ব্যবহারও কমে আসতে বাধ্য। লাইসেন্সিং-এর বিষয়ে নির্দেশিকায় যে সমস্ত শর্তারোপ করা হয়েছে সেগুলির প্রতিপালন যদি নিশ্চিত করা যায় তবে তামাকজাত দ্রব্যের (বিশেষকরে সিগারেট/বিড়ি) যত্রতত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, বিক্রয় সীমিতকরণে সরাসরি প্রভাব পড়বে।

নির্দেশিকায় ৮ এর ৮.৪-এ বলা হয়েছে, হোল্ডিং নাম্বার ব্যতীত কোনো প্রকার তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় কেন্দ্রকে লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সিগারেট কোম্পানি কর্তৃক সরবরাহকৃত বক্স বসিয়ে, গলায় ঝুলিয়ে যারা সিগারেট বিক্রি করে সেটি আর করতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে বিক্রয় কেন্দ্র সীমিত হয়ে আসবে, বিক্রি সীমিত হবে, সহজপ্রাপ্যতা বাধাগ্রস্থ হবে।

নির্দেশিকার ৮.৫-এ বলা হয়েছে, সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না। তামাক কোম্পানিগুলোর অন্যতম টার্গেট থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে যাতে সিগারেট বিক্রি হয় তার ব্যবস্থা করা। তারা প্রধান ভোক্তা বানাতে চায় শিশু-কিশোর-যুবকদের। কারণ তাদেরকে একবার সিগারেট ধরিয়ে দিতে পারলে দীর্ঘমেয়াদী ভোক্তা তৈরি হয়ে যায়। গাইডলাইনের উল্লেখিত ধারা বাস্তবায়িত হলে তামাক কোম্পানির এই অপতৎপরতাকে বাধাগ্রস্থ করা সম্ভব হবে।

৮.৬ ধারা অনুযায়ী জনসংখ্যার ঘনত্বের বিবেচনায় একটি এলাকায় লাইসেন্স ইস্যু করা হবে। এর মাধ্যমে বিক্রয় কেন্দ্র সীমিত হয়ে যাবে। বিক্রিও সীমিত হয়ে আসবে। সহজলভ্যতা অনেক বেশি হ্রাস পাবে।

লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকরের মাধ্যমে একটি শহরে মোট কতটি দোকানে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় হচ্ছে তার ডেটাবেইজ তৈরি হয়ে যাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। ফলশ্রুতিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করা অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে। সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স এবং পাশাপশি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য পৃথক লাইসেন্সিং ফি কার্যকর করার ফলে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে বিক্রেতা নিরুৎসাহিত হবে। অর্জিত ফি'র অর্থ দ্বারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তামাক নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য কার্যক্রম বাস্তবায়নে অর্থায়ন করতে পারবে।

তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের অনেক রাজ্যে, নেপালেও অনেক পূর্বে চালু হয়েছে। বর্তমানে ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। এর কার্যকারিতার প্রভাব ইতোমধ্যে এ সমস্ত দেশে দেখা যাচ্ছে। BMJ জার্নালে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, লাইসেন্সিং ব্যবস্থার কারণে ফিনল্যান্ডে পয়েন্ট অফ সেলের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ২৮%, ক্যালির্ফোনিয়া কাউন্টিতে ৩১% এবং হাঙ্গেরিতে ৮৩%। অস্ট্রেলিয়াতে লাইসেন্স ফি ১৩ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২০০ ডলার করায় খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা এক ধাক্কায় কমে গেছে ২৩.৭%। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে ৮%, ফিলাডেলফিয়াতে ৯.৮% হ্রাস পেয়েছে।

তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রি সীমিতকরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রভাব তৈরি করায় তামাক কোম্পানিগুলি মরিয়া হয়ে নানা ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে, যাতে নতুন করে কোনো দেশ লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর না হতে পারে এবং যেসমস্ত দেশে কার্যকর হয়েছে সেখানে যাতে এটি কার্যকর না থাকতে পারে। ইউরোপের নরওয়ে ও স্কটল্যান্ডে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা চালু করলেও কোম্পানির কূটকৌশলে সেটি অকার্যকর হয়ে যায়।

BMJ জার্নালে প্রকাশিত 'Tobacco Retail Licensing system in Europe' আর্টিক্যালে বলছে, 'The tobacco industry strongly opposed the licensing system, spread misinformation and encouraged retailers to speak out against the proposed policy. The arguments were mostly focused on the financial loss that retailers would suffer especially if they could not meet all criteria to obtain a license. According to experts, the tobacco industry actively lobbied to turn members of parliament against licensing.'

বাংলাদেশেও তামাক কোম্পানি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন কূটকৌশল গ্রহণ করেছে। নীতিনির্ধারক মহলকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা অনুধাবন করেছে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা পরিপূর্ণরুপে কার্যকর হলে বিক্রি সীমিত হয়ে আসতে বাধ্য। কারণ দেশের বেশ কিছু পৌরসভায় লাইসেন্সিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং বিক্রি সীমিতকরণে যা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। খুলনা বিভাগের সিটি কর্পোরেশনসহ ৯টি জেলা সদর পৌরসভায় বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান এইড ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের সহায়তায় তামাক বিক্রেতাদের ডেটাবেইজ তৈরি হয়েছে। এই তালিকা অনুসারে সংশ্লিষ্ট জেলার টাস্কফোর্স কমিটি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করার জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। এটি সম্ভবপর হচ্ছে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার কারণে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতি আহ্বান, দেশের জনস্বাস্থ্যকে রক্ষায় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা '২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ' বাস্তবায়ন করার জন্য তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্স ব্যবস্থাকে জোরদার করে তামাক কোম্পানির কূটকৌশল প্রতিহত করুন।