সবাই কেন সরকারি চাকরি করতে চায়?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 10 Oct 2021, 06:48 PM
Updated : 10 Oct 2021, 06:48 PM

অর্থনীতির আঙিনায় কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলে। বাস্তবেও আমাদের দেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে বদ্ধপরিকর। সেটাই স্বাভাবিক, এক দিকে দেশের আয় ও মানুষের শ্রীবৃদ্ধি, অন্য দিকে অসন্তোষ বাড়তে না দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা— দুদিক থেকেই কর্মসংস্থানের সাফল্য একটি বিশেষ শর্ত। কিন্তু এই বিষয়ে অনেক সময়েই যে আলোচনা বা শোরগোল হয়, তাতে যুক্তির ভাগ কম থাকে। আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে সীমাহীন ভিড় লক্ষ করা যায়। অল্পসংখ্যক সরকারি পদে প্রচুর আবেদন জমা পড়লে সেটাকে বেকার সমস্যার একটা পরিচায়ক হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও সেটা ঠিক নয়। সমস্যাটা অনেক সময়েই মনের মতো কাজ না পাওয়ার সমস্যা। এই 'মনের মতো' কাজের ব্যাপারটা অনেকাংশেই কাজকে অসম্মান বা উপেক্ষা করার মধ্যে নিহিত।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পরিচিত একজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাল কাজ করে, বেশ মোটা অংকের মাইনে পায়। সে হঠাৎ সিটি করপোরেশন অফিসে একটা পদে চাকরির পরীক্ষায় বসল। কেন সে এখানে চাকরির আবেদন করছে, জিজ্ঞেস করায় বলল, সরকারি চাকরি, তাই পেনশন পাবে। তা ছাড়া, প্রতিদিন যেতে হবে না, দেরি করে গেলেও চলবে, কাজ না করলে চাকরি যাবে না, আর শুনেছে 'উপরি রোজগারের' সুযোগ আছে। সে অকপটে কথাগুলো বলল। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে যারা সরকারি চাকরির আবেদন করছেন, তাদের মধ্যে অনেকে চাকরি করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, অনেকে আবার ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আবার, যারা কিছুই করেন না তাদেরও অনেকেই সরকারি চাকরি ছাড়া কিছু করবেন না বলে মনস্থির করেছেন। তারা মনে করেন কোনো 'নিম্নতর কাজ' তাদের শোভা পায় না, অন্তত সমাজ তাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছে।

সে যা-ই হোক, ধরা যাক একশটি পদের জন্য দশ হাজার মানুষ আবেদন করেছেন। এবার যদি তাঁদের বলি, পেনশন কিন্তু পাবেন না, নিজেরটা নিজেকেই সঞ্চয় করে ব্যবস্থা করতে হবে। তা হলেও কি তারা এখনকার চাকরি ছেড়ে রোজগার ছেড়ে সরকারি চাকরি করতে আসবেন? আসবেন। কারণ সেখানে চাকরি যাওয়ার ঝুঁকি কম। রাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে এই মানসিকতাকে সযত্নে লালন-পালন করেছে এবং করছে। ওই দশ হাজার জনের সবাই এখন বেকার বলে সরকারি চাকরি করতে দৌড়াচ্ছেন না, যাতে বেশি কাজ করতে না হয় সেই আশায় সরকারি চাকরি খুঁজছেন। এই সিদ্ধান্তটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

একজনকে চিনি যিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন। তার সঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিল। তিনি জানতে চান, আমি কখন অফিসে যাই। আমি তাকে জানালাম যে, আমাকে সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসে পৌঁছতে হয় এবং সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। মাঝে মধ্যে এর বেশি সময়ও অফিসে থাকতে হয়। এতে তিনি খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা যা বললেন তাতে আমি বিস্মত। তিনি ফ্রি-স্টাইলে অফিস করেন। যখন মনে হয় তখন যান, আবার যখন ইচ্ছে বের হয়ে পড়েন। তাকে কেউ ঘাটাতে সাহস পান না। বর্তমানে তিনি সরকারি দলের সিবিএ-র নেতা হয়েছেন। বড়কর্তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে দেন-দরবার করবেন। সবাই তাকে সমীহ করে চলেন। অফিসের কাজ করার ক্ষেত্রে তার বড় 'সময়াভাব', কারণ তাকে 'সংগঠন'-এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তার বক্তব্য শুনে খুবই 'হিংসে' হয়েছে। এমন সরকারি চাকরি কে না চাইবে?

একথা ঠিক যে, সরকারি চাকরির একটি পদের বিপরীতে পাঁচ হাজার বা দশ হাজার প্রতিযোগী থাকাটা কোনো ভাবেই দেশের বেকার সমস্যা চিহ্নিত করে না। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যা পড়ানো হয়, অর্থাৎ ওই মজুরিতে যত জন কাজ চাইছে আর যত জনকে কাজ দেওয়া যায়, তার ফারাকটাই বেকারত্বের পরিমাপ— এ ক্ষেত্রে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। আমার অকর্মণ্যতা বা ফাঁকি কোনো ধরনের শাস্তির মুখোমুখি না হওয়ার যে নিশ্চয়তা, 'উপরি কামাই'য়ের যে হাতছানি সেটা অর্জন করব, এর জন্যই আমি সরকারি চাকরি খুঁজছি। অর্থাৎ বাংলাদেশে সরকারি চাকরির আবেদনপত্রের সংখ্যা থেকে কিছুই বোঝা যাবে না।

অর্থনীতিবিদদের মতে প্রচলিত আছে যে, গরিবরা বেকার হন না। এই অমোঘ সত্যটি নিয়ে অনেক দিন আগেই অর্থনীতির চত্বরে গবেষণা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। খুঁটিনাটির মধ্যে না গিয়েও বলা যায় সেই গবেষণার মূল সিদ্ধান্ত ছিল ওপেন আনএমপ্লয়মেন্ট বা যে বেকারত্ব আমাদের চোখের সামনে আসে, যেমন কাজ না পেয়ে মানুষ সর্বক্ষণ কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এমন একটা অবস্থা, সেই মানুষেরা মূলত শিক্ষিত এবং খানিকটা সচ্ছল। অর্থাৎ কাজ না করলে খেতে পাবেন না, এমন নয়। অন্য দিকে গরিব মানুষেরা কাজ না করলে সত্যিই খেতে পাবেন না। না খেতে পেলে মারা যাবেন। এটাই চিরন্তন সত্য। তাই দরিদ্রদের মধ্যে বেকার দেখা যায় না। বেকার সমস্যা বলে সচরাচর যাকে আমরা চিনি, তা আসলে যারা শিক্ষিত এবং যাদের অনেকেরই বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে তাদের সমস্যা। তারা 'মনের মতো' কাজের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। অনেকে করেনও।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা বলি। যা টাকাপয়সা পায় তাতে তার কোনো মতে চলে। কিন্তু কিছুই হাতে থাকে না। গ্রীস্মের ছুটিতে বাড়ি আসার বিমান ভাড়া যোগাতে তাকে একটি খণ্ডকালীন কাজ নিতে হয়েছে। কাজটি হচ্ছে মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়ার চাকরি। যদিও সে এই চাকরির কথা দেশের কাউকে বলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যে কারণে কুর্নিশ জানাতে হয়, তা হলো, সেখানে শৈশব থেকেই শ্রমের প্রতি এক ধরনের সামাজিক সম্মান প্রদর্শন করা হয়। মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়ার চাকরিতে লজ্জার বালাই নেই। ওখানে সমাজটাই অন্যরকম। কাজ সেখানে শুধুই কাজ। এর উঁচু-নিচু নেই।

আমাদের ভালভাবে বুঝতে হবে কেন বিভিন্ন ধরনের কাজে শ্রমের বাজারে চাহিদা আর জোগানে ফারাক হয়, কোথাও কাজের লোক পাওয়া যায় না আবার কিছু জায়গায় সবাই কাজের জন্য লাইন দেয়। শাসক দল ভুলক্রমেও বেকার সমস্যা আসলে কেন হচ্ছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করে না, খানিকটা জ্ঞানের অভাব, খানিকটা 'কী বেরিয়ে পড়ে' সেই ভয়। আর বিরোধী পক্ষ আরও এক কাঠি ওপরে— ঠিক-ভুল কিছুই পরোয়া নেই, শুধু প্রতিবাদ আর বিরোধিতা। এ শুধু এ দেশের সমস্যা নয়। তবে এ দেশে সমস্যাটা খুবই প্রবল।

কথায় কথায় আমরা দারিদ্র্য ও বেকারত্বের কথা বলি, অথচ ঢাকা শহরে বাড়ির কাজের লোক, পানির কলের মিস্ত্রি, বিদ্যুতের কারিগর পেতে মধ্যবিত্ত জেরবার। কাজের লোকের চাহিদা একটা দরিদ্র দেশে পূরণ হয় না কেন? বাংলাদেশ তো ছোট্ট একটি দেশ, এখানে আঞ্চলিক মজুরির হারে সমতার কী অবস্থা? এ সবই বেকার সমস্যার সঙ্গে যুক্ত।

সবাইকে এমএ/এমএসসি, এমবিএ বা পিএইচডি-র সুযোগ দিতে হবে— এই 'সাম্যবাদী' ধারণা দেশটাকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে। কারিগরি শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে কারণ সাবেকি শিক্ষার কাছে সে দলিত, অস্পৃশ্য। এমএ/এমএসসি, এমবিএ শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই 'ডেফারড আনএমপ্লয়মেন্ট' বা প্রলম্বিত বেকারত্বের অবস্থা— সবাইকে অমুক বিষয়ে এমএ পাশ করিয়ে এক দিকে শিক্ষিত বেকারের জোগান বাড়াচ্ছি, অন্য দিকে কাজের অসম্মান করে যে সমাজ, তাকে আরও প্রশ্রয় দিচ্ছি। ''আমি এমএ পাশ করেছি অমুক কাজ কেন করব? লোকে বলবে কী?'' এখনও আমাদের দেশে 'ব্যবসায়ী' হবে বললে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের ভর্ৎসনা করা হয়। আশার কথা, ইদানীং সে আবহাওয়া কিছুটা পাল্টেছে। আত্মকর্মসংস্থান বা ব্যবসায়ী হওয়া ছাড়া এ দেশের বেকার সমস্যা মিটবে না। সরকার বেকার তৈরি করবে, কাজ দিতে পারবে না। এবং অকারণে অযোগ্য উচ্চাশায় বাতাস জোগাবে। আবার অন্যদিকে যোগ্য পেশার সন্ধানও দেবে না— পাছে লোকে কিছু বলে এবং জনপ্রিয়তা কমে যায়।

আসলে আমাদের মন-মানসিকতা বদলাতে হবে। কাজকে মূল্যায়ন করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ঢাকা শহরে অবশ্য একটু একটু করে মানসিকতার বদল হচ্ছে। অনেকেই অ্যাপভিত্তিক যান চালিয়ে উপার্জন করছেন। নানা ধরনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রমের বাজারও পাল্টেছে। কোন কাজ করব, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমার অফিসের এক গাড়ি-চালক কথায় কথায় সেদিন জানাল, তার ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলে তাকে মোটর বাইক কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই দারিদ্র্য এবং অবাঞ্ছিত বেকারত্বের সম্পর্কের গল্পকে আরও সময়োপযোগী ও আধুনিক করতে হবে।