বাজেটে এমএফএস খাত: স্বীকৃতি মিললেও চেপে বসল করের হুমকি

তানভীর এ মিশুকতানভীর এ মিশুক
Published : 12 June 2021, 01:56 PM
Updated : 12 June 2021, 01:56 PM

গত দুই বছর ধরে 'নগদ' নিয়ে নিরলস কাজ করে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসকে ডিজিটালাইজেশন এবং ক্যাশলেস লেনদেনের প্রেক্ষাপটে অমিত সম্ভাবনার একটি জায়গায় নিয়ে এসেছি আমরা – এ কথা আমাদের সমালোচকরাও দ্বিধাহীনচিত্তে স্বীকার করেন।

এক দিকে 'নগদ' এর মাধ্যমে আমরা যেমন নতুন নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছি, লেনদেনের ধরনকেই অনেকাংশে বদলে দিয়েছি; তেমনি আবার আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বা সরকারি ত্রাণ সহায়তা বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা – সব কিছু মিলে অনেকের কাছেই দিন বদলের স্বপ্ন বাস্তবতায় মিলেছে যেন।

অনাহুত এক কোভিড এসে সবকিছু তছনছ করে দেওয়ায়, অনেক কিছুর হিসেবই যখন আর আগের মতো মিলছে না তখন রক্ষাকবচ হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস, বিশেষ করে আমাদের 'নগদ'। জনগনের সেবা হওয়া আরো বেশি করেই হয়তো 'নগদ' মানুষকে ভালোবাসায় কাছে টানতে পেরেছে। এবারকার বাজেট প্রস্তাবেও মিলেছে তার অনেক কিছুর স্বীকৃতি।

কিন্তু একটা জায়গায় এসে যেন সব আটকে যাচ্ছে! একের পর এক সম্ভাবনার জন্ম দেওয়া – ব্যবসার নতুন নতুন উপলক্ষ্য তৈরি করে যে আমরাই বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে নতুন করে চেনালাম এখন আমরাই কিনা চাপা পড়তে যাচ্ছি করপোরেটর কর নামক বড়সড় রোলারের নীচে। আমি দেখে অবাক হয়েছি যে, দেশে যতগুলো ব্যবসাক্ষেত্র আছে, ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটে কেবল মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের করপোরেটর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকিদের করপোরেট কর হয় কমেছে, নয় তো আগের মতোই আছে। আমার স্থির বিশ্বাস যে কোথাও কোনো একটা ভুল হচ্ছে।

ভুলই হোক আর সঠিক চিন্তাই হোক, যেহেতু ঘটনাটা একবার ঘটে গেছে সুতরাং সেটা সংশোধনের উদ্যোগ নিশ্চয়ই নিতে হবে। না হলে ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত করা বা দিনবদলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বড় রকমের ধাক্কা লাগবে।

আমরা যারা এমএফএস সেবা দেই তাদের করপোরেট কর আছে এখন সাড়ে ৩২ শতাংশ। সামনের অর্থবছরে এটি দুই ভাগ করে সাড়ে ৩৭ এবং ৪০ শতাংশ করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানির করপোরেট কর হবে ৩৭ শতাংশ, আর অনিবন্ধিত কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি হবে ৪০ শতাংশ। তবে যেহেতু এই খাতের কোনো কোম্পানি এখনো নিবন্ধিত হয়নি ফলে সবার জন্যে ৪০ শতাংশ রেট কার্যকর হবে। তবে এখন যেহেতু কোনো কোম্পানি লাভ করছে না ফলে এই কর এখনই সেবা বা গ্রাহকের ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে না।

তবে এই কর কাঠামোর কারণে সমস্যা যেটা হবে সেটি হল – বিনিয়োগকারীরা আর এই সেবায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না। কারণ লাভ করে তার ওপর থেকে দিয়ে দিতে হবে ৪০ শতাংশ। কিন্তু অন্য সাধারণ ব্যবসার ক্ষেত্রে করের চাপটা এমন হয়।

আমরা 'নগদ' থেকে বলতে পারি – বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানি এখন আমাদের প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করার জন্যে আলোচনায় রয়েছে। নতুন কর কাঠামোতে তারা হয়তো বিনিয়োগে আগ্রহী নাও হতে পারে।

তবে এসব বড় বড় কোম্পানিকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ দেওয়া উচিৎ। সেটি হলে অন্তত আর্থিকখাতের ডিজিটালাইজেশন আরো দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারত। বদলে যেতে পারত আমাদের ডিজিটালাইজেশনের ম্যাপও। যা একই সঙ্গে সরকার ও দেশকে দিতে পারত লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উপলক্ষ্যও।

এমএফএস এমনিতেই সরকারের হয়ে রাজস্ব সংগ্রহের কাজটি করে দেয়। প্রতিটি লেনদেনের ওপর থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পায় সরকার। তাছাড়া এজেন্ট এবং ডিস্ট্রিবিউটর লেভেলে ১০ শতাংশ এবং ১২ শতাংশ করে অগ্রিম আয়করও প্রযোজ্য আছে। সব মিলে ভালো অংকের আয় জমা হয় সরকারের কোষাগারে। তারপরেও যেহেতু সহজেই পাওয়া যায় ফলে তাকে আরো ধরো – এমন নীতিতেই হয়তো এমএফএস-এর ওপর নতুন কর আশংকা তৈরি হয়েছে।

তবে এর মধ্যেও আমাদের জন্যে ভালো খবরও এসেছে বাজেটে। এবারের বাজেটেই হয়তো প্রথমবারের মতো আমরা এক ধরনের স্বীকৃতিও পেয়েছি।

তাছাড়া সরকারি নথিপত্রের জন্যেও এমএফএস-এর লেনদেনের তথ্য গ্রহণ করার বিধান এই বাজেটে দেওয়া হয়েছে। কোম্পানির কর্মীর বেতন ১৫ হাজার টাকার ওপর হলে আগে কেবল ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদানের বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু এবার সেখানে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস অপারেটরকে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

একইভাবে বাড়ি ভাড়াও দেওয়া যাবে এমএফএস এর মাধ্যমে। যেগুলো আবার রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

এর বাইরে আরো একটি ভালো খবরটি হল – আগে ব্যবসায়িক কেনাকাটার পরিমান ৫০ হাজার টাকা বা তার ওপরে হলে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করা ছিল বাধ্যতামূলক। এবারের বাজেটে এখানে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস অপারেটরদের যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এই পরিমান কেনাকাটায় এমএফএস থেকে লেনদেন করলে সেটির প্রমাণকে সরকারি নথিতে যুক্ত করা যাবে।

আমি মনে করি এগুলো মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস অপারেটরদের জন্যে বড় রকমের স্বীকৃতি যে, লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আমাদের সেবা ব্যাংকের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

তাছাড়া বাজেট বক্তৃতার বহু জায়গায় মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। আমার বিশ্বাস, এমএফএস সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় যে বড় রকম পরিবর্তন আনতে সহায়তা করেছে তার কারণেই এসেছে এই স্বীকৃতি।

তবে এসব স্বীকৃতির মাঝেও করপোরেট করের বোঝা চেপে বসার কারণে সুখের ঢেকুরটা আসলে তোলা যাচ্ছে না।