মদ ও মাতালের গল্প

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 11 Feb 2021, 06:13 AM
Updated : 11 Feb 2021, 06:13 AM

বাঙালির সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। মদ নিয়েও। মদে পুষ্টি নেই। এ জিনিস পেটে চালান করলে বাড়তি কোনো সুবিধা পাওয়া যায়, এমনটাও নয়। তারপরও এ জিনিসের প্রতি একটা দুর্দমনীয় লোভ ও আসক্তি দেখা যায়। মদ প্রকাশ্যে কেনা যায় না। খাওয়া যায় না। প্রচুর ভেজাল থাকে। ভেজাল মদ গিলে নিয়মিত মানুষ মরে। আর এই বিষাক্ত জিনিসের দামও অনেক চড়া। তারপরও দেশে মদ বিক্রি হয়। অনেকে মদ পান করে। অনেকে মারাও পড়ে।

ইউরোপ-আমেরিকার মানুষজনের কাছে মদ্যপান জাস্ট একটা রিফ্রেশমেন্ট। কিন্তু বাঙালির কাছে এ এক জটিল মনস্তাত্বিক রসদ। মদ নিয়ে এদেশের মানুষের অনেক ছুঁতমার্গ আছে। আছে নানা সংস্কার, গল্প-কাহিনি আর মিথ্যে মোহ। অনেকে মদ খেয়ে মাতলামি করেন। যদিও মাতলামি করাটা নিম্নবিত্ত স্ট্যাটাস হিসেবে ধরা হয়। সাধারণত দেশে তৈরি কমদামি বাংলা মদ খেয়ে এক শ্রেণির মানুষ মাতলামি করেন। আবার উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের কাছে মদপান একটা বিপ্লবে এসে ঠেকেছে। সন্ধ্যায় ঘরের কোণে, বারে কিংবা ক্লাবে হাল্কা চুমুক। রাজা-উজির মারা। চাষের পাঙ্গাস মাছ আর ব্রয়লার মুরগি সুলভ ও সস্তা হওয়ার কারণে যে দেশে প্রোটিনের ঘাটতি কমেছে এবং এ কারণে করোনাভাইরাস এদেশে সুবিধা করতে পারেনি, বাজারে পেঁয়াজের দাম কেমন সের্গেই বুবকার রেকর্ডের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, গলির মোড়ে যে লোকটা চা বিক্রি করে, সে আসলে কোটিপতি কি না, ডনাল্ড ট্রাম্প আসলে কেজিবির এজেন্ট কিনা, পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিরা কে কতটা মদ খেয়েছেন, দেশের ভবিষ্যৎ মন্ত্রী-এমপি-আমলা-ব্যবসায়ীদের হাত ধরে কতটা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে, এই রকম আরও অনেক জরুরি ব্যাপারে সুচিন্তিত মতামত দেওয়া ছাড়া মদ্যপদের আর কোনো ভূমিকা সমাজে দেখা যায় না।

আবেগপ্রবণ বাঙালির হৃদয় বেশ নরমসরম আর যকৃৎ আপাতদৃষ্টিতে শক্তিশালী ও সাহসী। নেশাখোর দেবদাস বাঙালির প্রিয় চরিত্র। মাইকেলের সাহিত্য কিংবা ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার থেকে মদপান নিয়ে আলোচনা হয় বেশি। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, বিদ্যাসাগর, শেরেবাংলা, ভাসানী প্রমুখ ব্যক্তিরা মদপান করতেন, এমন কথা ভুলেও বাঙালি শুনতে চায় না। আসলে বাঙালি অদ্ভুত ভাবে নিজের মনের মধ্যেই চরিত্রের রূপায়ণ করে। ভালো-খারাপের গণ্ডি টেনে দেয়।

যাহোক, মদের মতো তরল বিষয় নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা না করাই ভালো। বরং আমাদের সমাজে যারা মদ্যপ বা মদপান করে যারা মাতাল হন, তাদের নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। মদপান করে মাতাল হওয়া বা মাতলামি করা মদের দোষ নাকি ওই ব্যক্তির গুণ-এ নিয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল। বিশেষজ্ঞ মত হচ্ছে, মদ খেলেই কেউ মাতাল হয় না। অনেকে ইচ্ছা করে মাতলামি করে। মাতালের ভাব ধরে। আবার বহু মানুষ আছে যারা জাতে মাতাল তালে ঠিক, এদের দেখে মাতালদের বিচার করা ঠিক হবে না। যারা সামান্য মদ খেয়েই মাতলামি করে, চিৎকার কিংবা গালাগাল করে, উচ্চস্বরে বেসুরো গান গায়, বউয়ের গায়ে হাত তোলে, তারা নিকৃষ্ট শ্রেণির মাতাল। মানুষ হিসেবেও তারা একেবারেই ফালতু। তাদের এড়িয়ে চলাই ভালো।

চার্লি চ্যাপলিনের সিটি লাইট সিনেমায় একজন বড়লোককে দেখা যায়, যে কিনা মদ খেলেই চ্যাপলিনকে আমন্ত্রণ করে ভালো ভালো খাবার খাওয়াতো, যত খুশি টাকা বিলিয়ে দিত। কিন্তু সকালে যখন তার নেশা কেটে যেত তখন আর চ্যাপলিনকে চিনতে পারত না। লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিত। এই সিনেমার গল্প থেকে বোঝা যায়, মদ খেলে মানুষের মন উদারও হয়!

তবে আমাদের সমাজে মাতালরা বড় বেশি অবহেলিত। মান-ইজ্জতের ভয়ে নিজেরাও বড় গলায় কথা বলতে পারেন না। এমনকি সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে তাদের মদও গিলতে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে। যখন বাজারে জিনিসিপত্রের দাম বাড়ে, তখন কত লোক প্রতিবাদে মুখর হয়, মিটিং-মিছিল হয় দাম কমানোর জন্য। টেলিভিশনের টকশোতে বক্তারা টেবিল উড়িয়ে দেন কথার তোপে। অথচ মদের দাম হু হু করে বাড়লেও এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই, কোনো আলাপ-আলোচনা নেই পর্যন্ত। হতভাগ্য মাতালরা কেবল বেশি দাম দিয়ে মদ খেয়ে দেবদাসের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এরা এতই নিরীহ ও ভালোমানুষ যে মদের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কখনও কোনো প্রতিবাদ করেনি। বিনা প্রতিবাদে সরকারের অন্যায় মেনে নিয়েছে বারবার!

রক্ষণশীল বেরসিকরা বলবেন, মদের দাম বাড়িয়েছে, বেশ করেছে, আরও বাড়ানো উচিত। মানুষ ভাত খেতে পায় না, আর ওরা আছে মদ নিয়ে। মদের দাম আরও বাড়ুক, আরও বেশি করে বিষাক্ত জিনিস দিয়ে ওই জিনিস তৈরি হোক, মাতালগুলো ভেজাল ও বিষাক্ত মদ খেয়ে সাফ হয়ে যাক। সমাজের কলঙ্ক ঘুচুক। আসলে এ ধরনের কথা যারা বলেন, তারা খুবই নির্মম ও পাষাণ হৃদয়ের মানুষ। তাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম-ভালোবাসা নেই।

মাতালদের ব্যাপারে সবাই নাক গলায়, কিন্তু মাতালরা অন্য কারো ব্যাপারে নাক গলায় না। জগৎ-সংসার নিয়ে তারা একেবারেই নির্বিকার। লোকে মাতালদের মিছেই বদনাম করে। আমাদের এলাকায় এক ভদ্রলোককে চিনতাম যিনি খুব সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন মদপান করতেন তখন নিজেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মতো ক্ষমতাবান মনে করতেন। তিনি যখন মদের আসর থেকে বের হতেন, তখন সেখানে সার দিয়ে রিকশা দাঁড়িয়ে থাকত শুধু তার জন্য। এই দৃশ্যটা ছিল দেখবার মতো। সব রিকশাওয়ালা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। কেউ যদি ভুল করে তাকে বলত, আমার রিকশায় আসুন, তাহলে তিনি তার রিকশায় যেতেন না। উনি তো তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট! এই প্রেসিডেন্টকে রিকশাওয়ালা ডাকবে কেন? তার যেটা পছন্দ হতো, সেই রিকশাতেই উঠতেন। তাই সব রিকশাওয়ালা দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতেন। যে রিকশায় তিনি উঠতেন, নামবার সময় পয়সা গুনে দিতেন না। পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা বের হতো সেটাই দিয়ে দিতেন। যদি এক হাজার টাকার নোট দুইটা বের হয়, তিনি অম্লান বদনে তাই দিয়ে দিতেন। মাতালদের মধ্যে এমন দিলদরিয়া মানুষ এখনও রয়েছে। একজন মাতালের কাহিনি শুনেছি, যিনি বার থেকে বের হওয়ার সময়, বয়-বেয়ারা-পিয়ন থেকে শুরু করে সামনে যাকেই পেতেন তাকেই টিপস দিতেন। বারের সামনে একটা নেড়ি কুকুর শুয়ে থাকতো। ভদ্রলোক এই কুকুরটাকেও নিয়মিত টিপস দিতেন!

এক লেখক লিখেছেন: মদের অনেক গুণ আছে। মন ভালো নেই? বোতল খুলে দুই ঢোক মেরে দিন, দেখবেন দুনিয়াটা একেবারে অন্যরকম মনে হচ্ছে। ক্লান্তি লাগছে? জটিল সমস্যায় পড়েছেন? একটু মেরে দিলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যাবে। নিজেকে স্রেফ প্রজাপতি মনে হবে। ভাঙ্গা ঘরে বসে স্বর্গ দেখতে চান? অন্ধকারের মধ্যে প্রেয়সীকে দেখতে চান? জোছনায় ভিজতে চান? দুই পেগ মেরে দিন। দেখবেন, আপনি যা চান, যেভাবে চান, তাই পেয়ে যাচ্ছেন। তখন ঝগড়াটে বউকেও সোফিয়া লরেনের মতো কোমল মনে হবে। নিজেকে আলেকজান্ডারের মতো দিগ্বিজয়ী বীর মনে হবে। তবে এই বীর ও বীরত্বের ব্যাপারটা সাধারণত মেয়েরা মানতে পারেন না। তাই তারা ঘোরতর মদবিরোধী। কারণ মদ খেলেই ছেলেরা একেকজন 'বীর' বনে যান। জীবন দিতে এবং জীবন নিতে তখন আর ভয় পান না। কিন্তু এমন পুরুষ তো মেয়েদের পছন্দ নয়। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, মেয়েরা প্রশংসা করে সিংহের কিন্তু ভালবাসে গাধাকে। মদ খেয়ে অনেকে 'পুরুষসিংহ' হয়ে যান। তাই মেয়েরা সেই 'সিংহ' এবং তার স্রষ্টা মদকে এতটা অপছন্দ করেন!

আমাদের জটিল-কঠিন-বিয়োগান্ত জীবনে মদ্যপরা কিন্তু বিরাট বিনোদন। তারা নিয়মিত বিনোদন যুগিয়ে যান। এক লোকের কাহিনি জানি, যিনি একবার পর্যাপ্ত দেশি মদ খেয়ে বাসে উঠেছেন। তার শরীর দিয়ে ভুরভুর করে গন্ধ বেরোচ্ছে, তাই পাশের লোকেরা মুখে রুমাল চাপা দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ তার মাথায় একটা প্রশ্ন আসে। তিনি পাশের যাত্রীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ভাই, শুনছেন?

যাত্রীটি শুনতে না পাওয়ার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে রইল।

এবার লোকটি সেই সহযাত্রীর কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে বললেন, ভাই শুনছেন? আমি খুব একটা সমস্যায় পড়েছি।

এবার যাত্রীটি বিরক্ত হয়ে বললেন, কি সমস্যা হয়েছে আপানার? এত বিরক্ত করছেন কেন?

ভদ্রলোক খুব অমায়িকভাবে জানতে চাইলেন, ভাই আমি কি বাসে উঠেছি?

যাত্রীটি কথা না বাড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ উঠেছেন।

কিন্তু লোকটির তাতেও যেন ধাঁধা কাটছে না। সে আবার বলল, ভাই সত্যি করে বলেন তো, আমি কি বাসে উঠেছি?

মাতালের এই কাণ্ড দেখে যাত্রিটি খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি উঠেছেন।

ভদ্রলোক এরপর জানতে চাইলেন, আপনি কি আমাকে চেনেন? যাত্রীটি পড়লেন মহাফ্যাসাদে। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, না!

এবার ভদ্রলোক বললেন, আপনি কি আগে কখনও আমাকে দেখেছেন?

যাত্রীটির উত্তর: না! আগে আপনাকে কখনও দেখিনি।

এবার ভদ্রলোক মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়লেন, যদি আমাকে কোনোদিন নাই দেখে থাকেন, তবে এত নিশ্চিত হয়ে কী করে বললেন, যে আমিই বাসে উঠেছি?

এর উত্তর কি দেবে ভেবে না পেয়ে যাত্রীটি পরের স্টপেজে পড়িমরি করে নেমে পড়লেন!