প্রযুক্তিনির্ভর প্রজন্ম গড়তে শিক্ষক তৈরিই বড় চ্যালেঞ্জ

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
Published : 21 Jan 2021, 01:58 PM
Updated : 21 Jan 2021, 01:58 PM

আজকের দিনে যে শিশুদের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছর, ২০৪১ এ গিয়ে এই শিশুরাই পরিণত বয়সে পৌঁছে উন্নত বাংলাদেশের দায়িত্ব নেবে। অভিভাবক হিসেবে আমরা এখন যারা ভাবছি, ততদিন বেঁচে থাকলে, সে সময়টাতে ওদের কর্ম দেখে হয় গর্ববোধ করব, নইলে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ওদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকব মাত্র।

সুখানুভূতি কিংবা দুঃখবোধের বেশিরভাগটাই নির্ভর করছে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও শিক্ষক মিলে আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কতটুকু প্রস্তুতি নিচ্ছি- ঠিক তার উপর। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে উপযুক্ত পরিকল্পনা। 

রাষ্ট্রসহায়ক আমরা যারা সরকারি সেবায় নিয়োজিত, তারা এই পলিসিকে আত্মস্থ করে বাস্তবায়নে কতটুকু সহায়তা করতে পারছি, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষক হিসেবে পরিবার থেকে অভিবাবকরা তা কতটুকু বোধগম্যতায় নিয়ে শিশুদেরকে তৈরি করার প্রস্তুতি নিচ্ছি আর সর্বোপরি পারিবারিক স্কুলে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষকতার জন্য শিক্ষকদের কতটুকু প্রশিক্ষিত করে উপযুক্ত শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলতে পারছি, তা নিঃসন্দেহে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

বোধকরি, যারা বর্তমান সময়ে এসে সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, তাদের বেশিরভাগ শিক্ষকই খোলা পরিবেশে, আলো বাতাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় আনন্দ, বিনোদন, বন্ধুবান্ধবসহ সব রকমের সামাজিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে লেখাপড়া শিখেই আজ শিক্ষকতা পেশায় নিজেদেরকে নিবেদিত করেছেন।

কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খুব বেশি সংখ্যক শিক্ষিত ব্যক্তিরা যে শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন তা কিন্তু নয়। অন্তত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বলাই যায় যে, শিক্ষক নিয়োগের প্রচলিত কাঠামোতে খুব বেশি মেধাবীরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শিক্ষকতা পেশায় আসেননি। আর শিক্ষা কাঠামোতে প্রচলিত প্রথার একটি বড় দুর্বলতা নিয়ে আমরা ছাত্র জীবন শেষ করেছি, বস্তুত তা ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চাকরিকেন্দ্রিক শিক্ষা। পরিবার থেকে শুরু করে, প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে মননে আমাদেরকে শিক্ষিত করে তুলেছেন, তা রীতিমত চাকরি করে জীবন-জীবিকা অর্জনের পথকেই নির্দেশিত করেছে। 

অথচ, বাস্তব জীবনে এসে দেখা গেল চাকরি জীবনের বাইরে দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে জীবনকে নির্বাহ করছেন।

আমাদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওই ২০ ভাগ মানুষের দলভুক্তের চেষ্টা করেছেন। আমাদের অনেকের মধ্যেই এমন সম্ভাবনা ছিল, যা সঠিকভাবে উদঘাটিত হলে আমরাও হয়তো চাকরি না করে চাকরি দেবার সম্ভাবনাময়ী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা জীবনের শেষ অব্দি কোনও শিক্ষককেও সে সম্ভাবনা খোঁজার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করতে দেখিনি কখনও। 

বলতে গেলে কারিগরি শিক্ষা কিংবা উদ্যোক্তা তৈরি বিষয়ক শিক্ষার সাথে আমাদের কোনও বাস্তব শিক্ষা ও পরিচয় ছিল না। পরিবারে বাবা-মা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, সমাজের মুরুব্বীরা সকলেই একজন ভালো ছাত্রকে হয় ডাক্তার, না হয় ইঞ্জিনিয়ার- এরকমটাই হতে হবে মর্মে প্ররোচিত করেছেন। সে সময় পর্যন্ত গ্রামীণ অর্থনীতিভিত্তিক জীবন নির্বাহ প্রক্রিয়ায় শিক্ষিত মানুষের জন্য চাকরি-বাকরি ছিল তৎকালীন সমাজের কাছে অনেক বেশি আভিজাত্যের। এমনকি বিয়ের পাত্র পছন্দের ক্ষেত্রেও চাকরিজীবীদের পছন্দের বিষয়টি ছিল চোখে পড়ার মত। বলে রাখা প্রয়োজন, চলমান সময় পর্যন্ত যারা শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন তাদের খুব নগণ্য সংখ্যকই  আছেন যারা প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ শিক্ষকের শিক্ষা এবং মনন তৈরি হয়েছে মূলত প্রযুক্তিবিহীন শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে।

মানুষের চিন্তনে একটি প্রচলিত প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সেটি হল, কোনও বিষয় বা ঘটনাকে মানুষ তার নিজের জীবন প্রক্রিয়া এবং চিন্তনের সাথে মিলিয়ে প্রথমত চিন্তা করতে চায়। অতঃপর প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য কোনও প্রাসঙ্গিকতাকে জ্ঞানের আলোয় সম্পর্কযুক্ত করা সম্ভব হলে, তা সম্পর্কিত করে নিয়ে ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রসঙ্গটা ঠিক এখানেই।

শিক্ষকেরা প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষকতায় বেড়ে ওঠেন নি। সেই সাথে তারা যে পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন ঠিক আজকের সময় এসে আমাদের শিশু-কিশোরদের সেই অবারিত আলো, বাতাস, খেলাধুলা, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক বিনোদনের বাস্তব উপস্থিতি নেই। ঠিক এমন বাস্তবতায় শিক্ষকরা তাদের নিজেদের উপযুক্ত করে প্রস্তুত করা এবং অতঃপর শিক্ষার্থীদের মনন বুঝে শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টিই বস্তুত আমাদের মূল আলোচ্য।

এক দিক থেকে চিন্তা করলে একেবারেই বিপরীত পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে ছাত্র-শিক্ষকের শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষা নেওয়া। 

শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি, আপাতত ক্লাসরুম বিহীন পারিবারিক স্কুলে পড়াশোনা করা, ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের ভিন্নতা, সামাজিক-মানবিক সম্পর্কের সরাসরি অনুপস্থিতি, প্রত্যেকের পারিবারিক পরিবেশের ভিন্নতা, পারিবারিক পরিবেশে বিদ্যমান সদস্যদের সম্পর্কের প্রভাব, পারিবারিক পরিবেশে বিদ্যমান শিক্ষা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার নানা প্রসঙ্গের সাথে সহশিক্ষা হিসেবে খেলাধুলা বিনোদন এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক শিক্ষাবিহীন কেবল প্রযুক্তিনির্ভর একজন শিশু-কিশোরের মনস্তত্ত্ব। অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরে মুক্ত পরিবেশে গড়ে ওঠা শিক্ষকের মনস্তত্ত্ব এবং নতুন প্রযুক্তি নির্ভর শিশু মনস্তত্ত্বের বিশাল বৈপরীত্য অতিক্রম করে এসকল শিশু-কিশোরদেরকে সামাজিক, মানবিক, নৈতিক ও প্রযুক্তি জ্ঞান বিজ্ঞানে শিক্ষিত করে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণের মত উপযুক্ত সুনাগরিক তৈরি করা খুব বড় একটি চ্যালেঞ্জ এর বিষয়। 

স্মরণ করাতে চাই, একথাগুলো বলে আসা যতটা সহজ মনে হয়েছে, সঠিকভাবে সমস্যাগুলোকে উৎরে গিয়ে কাজটি সম্পন্ন করা বলার চেয়ে হাজার হাজার গুণ কঠিন। আর এ কঠিনকে সহজ করবার গুরুদায়িত্ব বিশেষ করে শিক্ষকদের উপরই বর্তায়। কাজেই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জটি হল প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের মননে গুণগত পরিবর্তন আনা, যা অর্জন করলে প্রতিকূল পরিবেশে যে সকল শিশুদের পাঠদান করে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে তাদেরকে পরিপূর্ণরূপে বুঝে শিক্ষা দেওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠাকেও শিক্ষার্থীকে গুরুত্বের সাথে  বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যথায় সকল একইরকম বিবেচনা করে পাঠদান করলে সেটি খুব একটা কার্যকরী হবে না। ক্ষেত্রবিশেষে হিতে বিপরীতও হতে পারে। 

অনেক অমিত সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বিষয়টি অনেক বেশি স্পর্শকাতর। কোন কোন ক্ষেত্রে শিক্ষকের অনলাইন পাঠদান এর বাইরে একজন শিশু শিক্ষার্থীর আর কোন উপায় থাকবে না যদি পঠিত বিষয়টি বুঝতে অন্য কারো সাহায্য গ্রহণ করা জরুরি হয়, আর ওই পরিবারটিতে যদি উপযুক্ত একজন মানুষও না থাকেন।

প্রথমত, শিক্ষক প্রস্তুতকরণ এবং দ্বিতীয়ত- দেশপ্রেম, সামাজিক ও মানবিক  মূল্যবোধ সম্পন্ন করে একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা- দুই ক্ষেত্রেই গবেষণা আবশ্যক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গিয়ে বন্ধুবিহীন, শিক্ষকদের সংস্পর্শবিহীন শিক্ষার্থীর শিক্ষা ও আচার-ব্যবহার, বিশ্বাস অবিশ্বাস, দেশপ্রেম মানবিক ও সামাজিক ভাবনা, বিদ্যমান পারিবারিক পরিবেশের সুবিধা অসুবিধা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে মাথায় নিয়ে পর্যায়ক্রমিক গবেষণা অব্যাহত থাকা প্রয়োজন। যেন বড় মাপের সামষ্টিক কোনও অসুবিধা তৈরি হওয়ার আগেই আমরা তার প্রতিকার এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। অন্যথায়, আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলতে কোথাও কোনও বড় রকমের ভুল সাধিত হয়ে গেলে উন্নত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং সেই ধারায় আগামীর অগ্রযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হতে পারে।

কাজটিতে সরকারের পাশাপাশি সব নাগরিককে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে অনুধাবন করে এরকম একটি চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষা বিষয়ক গবেষক যারা রয়েছেন, অন্তত আগামী পাঁচ-সাত বছর নিরবিচ্ছিন্ন ও আন্তরিক গবেষণার মাধ্যমে নতুন একটি নির্দিষ্ট নির্ভরযোগ্য সুকাঠামো গড়ে না উঠা পর্যন্ত কাজটি চালিয়ে যেতে হবে নিবিড় পর্যবেক্ষণের সাথে। 

প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব দেশ পূর্ব অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তাদের অভিজ্ঞতা-কলাকৌশল আমাদের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে সমন্বয় করে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কয়েকটি প্রোটোটাইপ স্তর তৈরি করা যেতে পারে। যেসকল ক্ষেত্রে যে বিকল্পটি উত্তম কার্যকরী হবে, সে সকল ক্ষেত্রে তা প্রয়োগের জন্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এমনকি সমাজ সবাইকে সেই প্রক্রিয়ার সাথে অভিযোজিত করতে হবে। বোধকরি রাষ্ট্রের সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে শিক্ষা পরিবেশের প্রযুক্তি নির্ভরতা মূল্যায়নপূর্বক ক্ষতিকর দিকটা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে। প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং বিনোদন। 

সর্বোপরি শিক্ষক, অভিভাবক, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলে মিলে আন্তরিকভাবে অনুধাবন করে ভবিষ্যৎ শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলে ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশকে, চলমান আগামীর হাতে স্বাচ্ছন্দে তুলে দিয়ে আমরা নিজেদেরকে নির্ভার করতে পারব। বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পতাকার সাথে শোভিত  হবে। সেই সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক।