বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে প্রকৌশলীদের আগ্রহ ও সম্ভাবনা

মুহাম্মদ রবিউল হোসেন
Published : 27 July 2020, 02:31 PM
Updated : 27 July 2020, 02:31 PM

বেশ কয়েক বছর ধরে বিসিএস পরীক্ষার ব্যাপারে মেধাবী তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বেতন কাঠামোতে যুগোপযোগী পরিবর্তন, দেশকে সরাসরি সেবা দেওয়ার সুযোগ, চাকরির নিশ্চয়তা এবং বর্তমান রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পারিবারিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা মূলত এ আগ্রহের কারণ। দীর্ঘমেয়াদে এটি অবশ্যই দেশের জন্য ইতিবাচক। কারণ সরকারের নীতি ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাফল্য অনেকাংশে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্তদের দক্ষতা ও মেধার উপর নির্ভর করে। তবে এবারের ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল সোশ্যাল ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে সাধারণ ক্যাডার – পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশে প্রকৌশলীদের সাফল্য। অনেক বিদগ্ধ গুণীজন এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন, এমনকি বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শও দিয়েছেন।

দু:খজনক সত্যি যে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শুধু অগ্রসর ছাত্রছাত্রীদেরকেই (অল্প ব্যতিক্রম বাদে) বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। নি:সন্দেহে এ ধরনের স্টেরিওটাইপ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও নতুন প্রজন্মের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এরপর তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে এসব ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকেই সবচেয়ে ভাগ্যবান ও মেধাবীরা প্রকৌশল ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ পায়। 

তাই বিসিএস- সাধারণ ক্যাডারে প্রকৌশলীদের ভাল ফলাফল অপ্রত্যাশিত নয়। এমন কি পাশের দেশ ভারতের আইএএস (IAS) ও ইউপিএসসি (UPSC) পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের বেশিরভাগ প্রকৌশলী। ২০১৬ সালের আইএএস পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত ১৭৬ জনের মধ্যে ৫৬ জনের-ই স্নাতক প্রকৌশল বিদ্যায়। প্রকৌশলীদের টার্গেট করে বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনের সুপারিশ অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস অপরিবর্তনীয় কোনো বিষয় নয়। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন হতে হবে মেধাবী ও যোগ্যতমদের নিয়োগের জন্য তা সে যেকোনও ব্যাকগ্রাউন্ডের হোক না কেন।

প্রযুক্তির এযুগে জনপ্রশাসনের কাজে প্রযুক্তির ব্যবহারে পারদর্শিতার পাশাপাশি এর সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকাটা জরুরী। প্রকৌশল শিক্ষায় কারিগরি বিষয়ের পাশাপাশি এ সম্পর্কেও পড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানকারী সংস্থা ABET এর (https://www.abet.org/) প্রকৌশল শিক্ষার মানণ্ডের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে– (১) নেতৃত্ব, জনসংযোগ দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা, ও পেশাগত সততা এবং (২) প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত সমাধানের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণী ক্ষমতা। বুয়েটসহ দেশের সকল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম কমবেশি ABET এর মানদণ্ডকে ভিত্তি করেই তৈরি ও সংস্কার করা হয়। তাই বিসিএস সাধারণ ক্যাডারের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের সাথে প্রকৌশলীদের উল্লেখিত ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো ফল বয়ে আনার কথা।

কর্পোরেট জগতে প্রকৌশলীদের নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা রীতিমত ঈর্ষণীয়। এই তো কোভিড-১৯ মহামারীর শুরুতে ভেন্টিলেটরের নকশা উন্মুক্ত করে দেওয়া বিশ্বখ্যাত মেডট্রনিক ও ইন্টেলের (Intel) চেয়ারম্যান ড. ওমর ইশরাকের সব ডিগ্রি-ই প্রকৌশল বিদ্যায়। এর বাইরে গুগল, মাইক্রোসফট, স্পেস-এক্স, অটোমোবাইলসহ অনেক বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে প্রকৌশলীরা সুনামের সাথে ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্ব দিচ্ছে। কর্পোরেট জগতের বাইরে পৃথিবীব্যাপী জনপ্রশাসন ও রাজনীতিতেও প্রকৌশলীদের পদচারণা আছে। বিশ্ব-রাজনীতির অন্যতম খেলোয়াড় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর স্নাতক প্রকৌশলে আর জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মারকেল তো একজন পুরোদস্তুর পিএইচডি ডিগ্রিধারী কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি গবেষক ছিলেন। বাংলাদেশেও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকে প্রকৌশলী।

প্রকৌশল ও তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির কারণে প্রশাসন, জননিরাপত্তা ও বৈদেশিক সম্পর্ক সব কিছুতেই বিপ্লব ঘটে গেছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের (SDG) সতেরটি লক্ষ্যের অনেকগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে প্রকৌশল জ্ঞান অত্যন্ত জরুরী। সাশ্রয়ী নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো ও শিল্পায়ন, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন এবং টেকসই নগর পরিকল্পনা ইত্যাদি লক্ষ্য অর্জনের কর্মসূচী প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তদারকীর কাজে প্রকৌশল শিক্ষা কাজে আসবে। জননিরাপত্তায় প্রযুক্তির ব্যবহার, ডিজিটাল ফরেন্সিকস, সাইবার ইন্টেলিজেন্স ও সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধের জন্য প্রায় সবদেশেই প্রকৌশলীরা পুলিশে কাজ করছে । অন্যদিকে প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মেধাস্বত্ব, নীতি নির্ধারণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি তো এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দর কষাকষির বিষয়।

প্রচলিত আছে যে চীনের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ও নীতি নির্ধারণে প্রকৌশলীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। তাদেরকেই চীনের কারিগরি দক্ষতা ও প্রযুক্তিভিত্তিক ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাস্টার মাইন্ড মনে করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের অবলুপ্তি এবং চীনের অনুকুলে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি, নব্বইের দশকে করা বাণিজ্যচুক্তি গুলোর দুর্বলতা এবং এতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মেধাস্বত্ত্বের ছাড়কে অনেকে দায়ী করেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট দেশের স্বার্থ রক্ষায় প্রকৌশলীদের আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অবদান রাখা ও আগ্রহী করে তোলার জন্য বিভিন্ন মেয়াদী ফেলোশিপ ও প্রণোদনা দিয়ে থাকে। প্রকৌশলীরা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ছাড়াও নীতি নির্ধারণ থেকে নেগোসিয়েশানসহ সকল কাজে অংশ নেন। এছাড়া প্রযুক্তির সাথে জড়িত জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা, কার্বন নিঃসরণ, পরিবেশ বান্ধব জ্বালানী, খাদ্য নিরাপত্তায় জীন পরিবর্তিত কৃষি পণ্য, সমুদ্রসম্পদ আহরণ এবং অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি এখন আন্তর্জাতিক কূটনীতির অন্যতম বিষয়। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইতিহাস, রাজনীতি ও আইন বিষয়ের পাশাপাশি প্রকৌশল ও প্রযুক্তির জ্ঞান দেশের কূটনৈতিক সক্ষমতাকে নিঃসন্দেহে বাড়াবে। 

বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীদের সাধারণ ক্যাডারে যাওয়া সরকারী অর্থের অপচয় কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আসে। কিছু প্রকৌশলী যদি যোগ্যতা দিয়ে, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে কারিগরি ক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে অন্যান্য পরিসরে দেশকে সেবা দিতে চায়, তাহলে সে সুযোগ দেওয়াটাই ন্যায্য। বিষয়টা তো এমন নয় যে প্রকৌশল সেবার প্রয়োজনে পর্যাপ্ত প্রকৌশলী পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও দু:খজনক যে, বিসিএস -প্রকৌশল, কৃষি ও চিকিৎসার সাথে সাধারণ ক্যাডারদের বৈষম্য দীর্ঘদিনের। বৈষম্য নিরসনের দাবিতে কিছু দিন আগেও বিসিএস–প্রকৃচি নামে পেশাজীবী সমিতির আন্দোলন প্রায়ই শিরোনাম হত। প্রকৌশলীসহ অন্যান্য পেশাজীবীরা যাতে নিজ ক্ষেত্রেই মর্যাদা ও সন্তুষ্টির সঙ্গে সেবা দান করতে পারেন তাই এ বৈষম্যের প্রতিকার এখন সময়ের দাবি।

বিশ্বব্যাপী প্রকৌশলীদের সৃষ্টিশীল ও প্রায়োগিক সমস্যার সমাধানকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই কারিগরী ক্ষেত্রের বাইরে সামাজিক ও বাণিজ্যিক সমস্যা সমাধানে প্রকৌশলীদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আগামী দিনগুলো হবে মেশিন লারনিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ, যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। ঘরে বসে ভার্চুয়াল ক্লাস, মিটিং, কাজ-কর্ম, স্মার্ট হোম, চালকবিহীন গাড়ি ইত্যাদি সময়ের ব্যাপারমাত্র। কোভিড-১৯ এর কারণে তা আরো এগিয়ে আসছে। এ যুগের রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ অনেক ভিন্ন হবে, সম্বনয় করতে হবে মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায়। এজন্য আগামী দিনে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারীদের শুধু প্রযুক্তির ভোক্তা হলে চলবে না, প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে তার ধারণা থাকাটাও জরুরি। তাই দেশের নির্বাহী বিভাগের জনশক্তিতে রংধনুর বৈচিত্র্য আনলে সরকারের দক্ষতা ও গতিশীলতা বাড়বে বই কমবে না!