করোনাভাইরাসের প্রকৃতিবান্ধব ও লৈঙ্গিক রূপ

সায়েম খানসায়েম খান
Published : 14 May 2020, 04:29 PM
Updated : 14 May 2020, 04:29 PM

করোনাভাইরাসে আগ্রাসী আক্রমণে প্রকম্পিত চারপাশ। করোনা একটি ল্যাটিন শব্দ। যার অর্থ হলো মুকুট। বিশ্ব শাসনের মুকুট অর্জনের দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকা বিশ্বনেতৃবৃন্দকে গৃহবন্দি করে নিজেই মুকুট পরে সারা বিশ্বকে শাসন করে চলেছে করোনা। দুর্ধর্ষ মারাত্মক সংক্রামক করোনাভাইরাসের দুর্দাণ্ড দাপটে সারা বিশ্ব আজ টালমাটাল।  যা কবির কল্পনা ও দার্শনিকের চিন্তাকেও ছাপিয়ে গেছে।

সারা বিশ্ব এক মানবিক সংকটের মুখে। লকডাউনের অচলাবস্থায় মানুষের স্বাভাবিক চলাচল যারপরনাই বিধ্বস্ত। তবে প্রত্যেকটি সংকটের মধ্যেই সম্ভাবনার বীজ নিহিত। সেখান থেকে আমাদের আশার অলোকপ্রভা সঞ্চারিত  করতে হয়। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায় মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্ত করে প্রকৃতি তার আপন ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে। মহাত্মা গান্ধীর একটি কথা আছে-"Earth provides enough to satisfy every man's needs, but not every man's greed." মানুষের সেই আদিম প্রবৃত্তি নিবারণ করতে গিয়ে ক্লান্ত ও বিপন্ন ছিল সমগ্র পৃথিবী। মানুষের ভোগের উপাদানগুলো প্রকৃতি থেকে আসে। শুধু এই কারণেই প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে তার সুস্থতার দিকে মানুষের খেয়াল রাখা উচিত ছিল। মানুষ সভ্যতা তৈরির নামে নিজেদের আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত ছিল। বিশেষ করে শিল্প বিপ্লবের পর গত আড়াই শতকের উপরে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার নামে প্রকৃতির উপরে কর্ষণ করা হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হলেও সেটা ছিল শুধু ব্রান্ডিংয়ের অবলা শব্দমালা। এর বাইরে এই প্রপঞ্চের কোন প্রাণ বা কার্যকারিতা ছিল না। লকডাউনের এই সময়ে প্রকৃতি নিজে থেকে তার ক্ষত কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে।

করোনাকালে প্রকৃতি সুস্থ হয়ে উঠছে। প্রকৃতির সুস্থতা কি সুস্থ পথে, না অসুস্থ পথে? প্রকৃতি অসুস্থ পথেই সুস্থ হচ্ছে। সুযোগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে। পরমা কেন সেটা করছে? কারণ সে নিরুপায়। মানুষ পরমার একটি অংশ। পরমা মানুষকে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করার অধিকার দিয়েছিল। কিন্তু মানুষ সেটার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও খবরদারিত্ব করতে গিয়ে পরমার ব্যালেন্সিংয়ের শক্তিকে ধ্বংস করেছে। এখন প্রকৃতি মানুষের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে তাকে গৃহবন্দি করে নিজেকে সুস্থ করার চেষ্টা করছে। মানুষের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে প্রকৃতির ব্যালেন্সিং সহি পন্থা না হলেও অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। মানুষ পরমার প্রতি যত্নশীল হলে প্রকৃতিকে এই পথে হাঁটতে হতো না। মানুষ মানুষকে বা অন্য প্রাণীকে ভালোবাসলে প্রকৃতিকে স্বৈরাচারী হতে হতো না। প্রকৃতি নিজে কিন্তু স্বৈরাচারী হয়নি। মানবকূলের মধ্যে লোভী-আগ্রাসী অংশের মাধ্যমেই সে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা নিজেরাই লকডাউন ঘোষণা করেছে। প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে প্রেমময় সম্পর্ক থাকলে এটা ঘটতো না। মানুষ অন্যের প্রতি সহমর্মিতা দেখালে প্রকৃতি সকলেকে আগলে রাখতো। স্বার্থপরতা ও মুনাফার লোভে উঁচু শ্রেণি সবসময় নিজেদের স্বার্থে ভয়ের ব্যবসা করেছে। প্রকৃতি যখন তার চেয়ে বড় ভয় দেখাচ্ছে উঁচু শ্রেণি ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। শুধু তাই নয়, সে নিম্নবিত্তকেও বলছে গৃহবন্দি থাকতে। নিম্নবিত্ত তো শোষণের  যাঁতাকলে সর্বদাই ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল। ভয় যেখানে তার জীবনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ সেখানে করোনাভাইরাস তার কাছে বাড়তি কোনও আবেদন রাখে নি। মানবকল্যাণের নামে সারা বিশ্বে যে হিংসা-ঈর্ষা-দ্বেষ-ভয়ের ব্যবসা হয়েছে তার বিরুদ্ধে কিছু মানুষ বলে আসলেও তাতে কর্ণপাত করা হয় নি।

আজ স্পষ্ট হয়েছে বর্তমান প্রজন্মের হাবিলদাররা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুযোগকে ব্যবহার করে নিজেদের জাহির করতে ব্যস্ত। বিজ্ঞানের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে মানুষ জয়ের চাইতে রাষ্ট্র জয়ের দিকেই ছিল তাদের নজর। নিজেদের ভোগবাদিতাকে অনুমোদন করাতে টেকসই উন্নয়নের কথা ছিল ফাঁকা বুলি।  আর এই অনুশীলনের মধ্য দিয়েই কেউ কেউ অসুর হয়ে উঠছে। পৃথিবীর এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও আমাজন ধ্বংস করা হচ্ছে।

লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যপূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে হাজার বছর ধরে শোষিত হয়ে আসছে নারী সমাজ। আর এখন করোনাভাইরাসের প্রভাবে অধিকাংশ আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা পুরুষের। করোনা সেক্স ভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে কিনা সেটা হয়ে উঠেছে গবেষণার বিষয়! নারীর শরীরে সেক্স হরমোন অ্যাস্ট্রোজেন বেশি থাকায় তারা কোন সুবিধাজনক অবস্থানে আছে কিনা সেটা দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি এটা সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে পুরুষের দেহে বেশি পরিমান অ্যাস্ট্রোজেন হরমোন প্রবেশ করালে বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা নতুন ভাবনায় ঠেলে দেয়। গর্ভবতী নারীদের প্রতিও করোনাভাইরাস কিছুটা দয়াশীল বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। প্রকৃতির পাশাপাশি করোনাভাইরাস কিছুটা নারীবান্ধব বলেও ধরে নেওয়া যায়।

যা-ই হোক, আশাবাদীদের জন্য নৈরাশ্যের বড় ভবিষ্যদ্বাণী আছে বলে মনে করি। করোনাভাইরাসের ফলে মানুষের মনে গভীর অভিঘাত সৃষ্টি হবে এবং তাতে সবার মধ্যে শুভবোধের উদয় ঘটবে বলে যারা মনে করছেন তাদের আশার গুড়ে বালিই হতে পারে। করোনাভাইরাসের ফলে সমাজের উঁচু শ্রেণি ভয় পেয়েছে তাই বলে অবস্থান পরিবর্তনে তারা সম্মত হবে না। বরং নিজের এই ভয়ার্ত মূর্তি ঢাকতে এবং নিচু শ্রেণিকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও বড় ভয়ের আমদানি করবে বলেই মনে হয়।