করোনাকালে ঢাকার বায়ুমান অবস্থা

মো. মাসুদ রানা
Published : 28 April 2020, 04:05 PM
Updated : 28 April 2020, 04:05 PM

শুষ্ক মৌসুম এখনো শেষ হয়নি। ঢাকা শহরবাসী এখনো বায়ুদূষণের তীব্রতায় অতীষ্ট। পৃথিবীব্যাপী ব্যস্ত নগরগুলোর বায়ুদূষণ পর্যালোচনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ুদূষণে ঢাকা এখনো শহরগুলোর তালিকার ওপর দিকেই অবস্থান করছে। এমন সময়ে ঢাকা শহরে অত্যন্ত ছোঁয়াচে ও মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ায় এর বিস্তার রোধকল্পে ২৬ মার্চ ২০২০ থেকে পর্যায়ক্রমে "বন্ধ" কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় শুধু অফিস-আদালত ও গণপরিবহণ বন্ধ করা হলেও পরবর্তীতে দোকানপাট ও গণজমায়েত বন্ধসহ মানুষজনের বাসা থেকে বের হওয়ার ব্যাপারেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এসব বিধিনিষেধের প্রতিটি পর্যায়ে রাস্তায় যানবাহন ও মানুষজনের চলাফেরা, শিল্প-কারখানার কার্যক্রম, ইত্যাদি প্রভাবিত হয়েছে যা স্বাভাবিকভাবেই শহরের বায়ুমান মাত্রাকে প্রভাবিত করেছে; তবে কি পরিমাণ প্রভাবিত করেছে তা জানাটা জরুরি কেননা সেটি শহরের বায়ুদূষণে স্থানীয় উৎসসমূহের প্রভাব নির্দেশ করবে।

এই "বন্ধ" কালীন সময়ের প্রাথমিক সুফল হচ্ছে ধুলামুক্ত পরিছন্ন বাতাস ও দৃশ্যমান নীলাকাশ। তবে ধুলা ও সূক্ষ্ণ বস্তুকণা (পিএম২.৫) এক নয়; ধুলা যখন খুব বেশি মাত্রায় দৃশ্যমান, পিএম২.৫ অদৃশ্য। ধুলার মধ্যে মোটা বস্তুকণার পরিমানই বেশি থাকে, তবে অল্প পরিমাণে পিএম২.৫-ও বিদ্যমান থাকে। যানবাহন, শিল্প-প্রতিষ্ঠান, রাসায়নিক কারখানা, জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো, ইত্যাদি পিএম২.৫ এর প্রধান উৎস। ধুলা নগরজীবনে বিরক্তি সৃষ্টি করলেও স্বাস্থ্যের উপর তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না। পক্ষান্তরে, পিএম২.৫ মানব শরীরে শ্বাসযন্ত্রের নানান সমস্যা সৃষ্টি করাসহ হার্টের সমস্যা, বুদ্ধি বিকাশে প্রতিবন্ধকতা, ক্যান্সার ইত্যাদি মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

শহরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনার একটি সুষ্ঠ পদ্ধতি প্রণয়নের লক্ষ্যে বায়ুদূষণে দোষী উৎসসমূহের দূষণ মাত্রার অনুপাত জানাটা জরুরি। পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশন বিভিন্ন সময় পৃথকভাবে "রিসেপ্টর মডেল" পদ্ধতি'র মাধ্যমে এ ধরনের অনুপাত নির্ণয় করার চেষ্টা করেছে। সেসব সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বাতাসে অতিরিক্ত মাত্রায় সুক্ষ্ণ বস্তুকণা (পিএম২.৫) এর উপস্থিতির জন্য ইটভাটা, যানবাহন ও কলকারখানার ধোঁয়া, জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার, নির্মাণ কাজ, রাস্তার ধুলা ইত্যাদি দায়ী। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১০-২০১২ সময়কালে ঢাকার বাতাসে পিএম২.৫ এর বাৎসরিক গড় হিসাবের প্রায় ৫৮% ইটভাটা, ১৫.২% ধুলার উৎস ও ১০.৪% যানবাহন নিঃসরণ থেকে আসে। অন্যদিকে, এটমিক এনার্জি কমিশনের ২০০৭-২০০৯ সময়কালের তথ্য নিয়ে পরিচালিত সমীক্ষায় কিছুটা ভিন্ন ফলাফল পরিলক্ষিত হয়; সে সমীক্ষা অনুযায়ী শুধুমাত্র শুষ্ক মৌসুমের হিসাবে বাতাসে উপস্থিত পিএম২.৫ এর ২২.০% ইটভাটা, ২৪.৫% ধুলার উৎস এবং ৩৬.০% যানবাহন থেকে আসে। উৎসগুলোর মধ্যে যানবাহন, ধুলার উৎস (রাস্তার ধুলা বা রাস্তা মেরামত, নির্মাণকাজ, উম্মুক্ত মাঠ ইত্যাদি), আশপাশের কলকারখানা, রান্না-বান্নায় ব্যবহৃত শক্তি ইত্যাদিকে স্থানীয় উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ইটভাটা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান শহরের কেন্দ্র থেকে ১০-২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আরো দূরের উৎসসমূহও গুরুত্বপুর্ণ। তবে শুষ্ক মৌসুমের এই সময়ে বায়ুমণ্ডলের বিশাল জায়গা ভাসমান বস্তুকণা ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য উম্মুক্ত থাকে বিধায় দূরের উৎসগুলো ততটা প্রভাব ফেলতে পারার কথা নয় এবং এসময় এমনিতেই বাতাসে পিএম২.৫ এর মাত্রা কমতে শুরু করে।

ঢাকার বারিধারায় অবস্থিত আমেরিকান এমব্যাসি'র নিজস্ব চত্বরে পরিচালিত সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় উৎপাদিত বায়ুমান তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চ মাসে ঢাকার বায়ুমান এমনিতেই ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২০% ভাল ছিল। ২৫ মার্চ ২০২০ তারিখ অফিস বন্ধ ঘোষণার পর মানুষজনের ঢাকা ছাড়ার প্রবণতায় প্রথম তিন দিনে বাতাসে পিএম২.৫-এর মাত্রা মার্চ মাসের পূর্বের দিনগুলোর (১-২৪ মার্চ ২০২০) গড় মানের চেয়ে প্রায় ২০% বেড়ে যায়। ২৮ মার্চ থেকে বায়ুর মান ভাল হতে শুরু করে এবং ২৮ মার্চ–১৬ এপ্রিল ২০২০ সময়কালে বাতাসে পিএম২.৫ এর গড় মানমাত্রা (৭০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটারে) অফিস বন্ধ ঘোষণার পূর্ববর্তী সপ্তাহ অর্থাৎ ১৮-২৪ মার্চ ২০২০-এর গড় মানমাত্রার থেকে ১৭.০% কমে যায়। করোনাভাইরাসের প্রকোপে "বন্ধ" কালীন এই সময়টায় (২৮ মার্চ–১৬ এপ্রিল ২০২০) পিএম২.৫ এর গড় মানমাত্রা ২০১৯ এর একই সময়ের গড় মানের চেয়ে ১০% কম রেকর্ড করা হয়।

বাংলাদেশ সরকারের বিধি অনুযায়ী দৈনিক গড়ে বাতাসে পিএম২.৫ এর অনুমোদিত সীমা ৬৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার বাতাসে। ২০১৯ ও ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের এই সময়ের বায়ুমান তথ্য থেকে দেখা যায়, এ সময়ে (১-১৬ এপ্রিল) বাতাসে পিএম২.৫ এর মাত্রা অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে সাধারণত কম বা কাছাকাছি থাকে; ২০১৯ সালের এ সময়ে ০৮ দিন পিএম২.৫ এর মাত্রা অনুমোদিত সীমা অতিক্রম করেছিল যেখানে ২০২০ সালে এরকম দিনের সংখ্যা ০৬। করোনাভাইরাসের কারণে নগরব্যাপী বন্ধের এই সময়ে ৬০-৭০% যানবাহন বন্ধ রয়েছে, নির্মাণকাজ, বেশির ভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎসও বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় বাতাসে পিএম২.৫ এর মাত্রা'র ১৭% উন্নয়ন নির্দেশ করে যে বন্ধ থাকা ৬০-৭০% যানবাহন, ধুলার উৎস (নির্মাণকাজ, রাস্তার ধুলা) ইত্যাদির মতো স্থানীয় উৎসসমূহ এসময় ঢাকার বাতাসে পিএম২.৫ এর ১৫-২০%-এর মত দায়ী হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এই সময় নগরের পিএম২.৫ এর জন্য দায়ী উৎস কে? বন্ধের এই সময়েও কখনো কখনো ঢাকায় পিএম২.৫ এর মানমাত্রা সরকার নির্ধারিত মানমাত্রা (২৪ ঘণ্টা গড়ে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম পার কিউবিক মিটার) এর চেয়ে বেশিই পাওয়া যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত ১ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টা গড়ে ঢাকার পিএম২.৫-এর মাত্রা ছিল ১২৬ মাইক্রোগ্রাম পার কিউবিক মিটার যা সরকার নির্ধারিত মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ।

বছরের এই সময়টায় বাতাস দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়। সে হিসেবে নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে চালু থাকা ইটভাটা ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকার এই দূষণের জন্য দায়ী হতে পারে। এর সাথে ৩০-৪০% যানবাহনের চলাচল ও এর ফলে বাতাসে ভেসে যাওয়া রাস্তার ধুলা, বস্তি এলাকায় কাঠের চুলায় রান্না ইত্যাদি যুক্ত হতে পারে। সকল যানবাহন ও শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকলে বায়ুমানের আরো ২০% উন্নয়ন হতে পারত। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে জাতীয় সংসদ ও ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে ঢাকা সিটি নির্বাচনকালে সকল প্রকার যানবাহন ও শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল যার ফলশ্রুতিতে ঢাকার বায়ুমানের ৩৫-৪০% উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়েছিল।

পরিশেষে বলা যায়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে গৃহীত "বন্ধ" কার্যক্রমে ঢাকা শহরের বায়ুমান যথেষ্ট মাত্রায় উন্নতি হয়নি এবং শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণের জন্য শহরের বাইরের উৎসসমূহও অধিক মাত্রায় দায়ী; এমনই একটি বড় উৎস অবশ্যই ইটভাটা।