সরি স্যার

মুস্তাফা খালীদ পলাশ
Published : 28 April 2020, 01:05 PM
Updated : 28 April 2020, 01:05 PM

ব্রহ্মাণ্ডের চক্রযানে কালের যে অসীম যাত্রা তার ত্বরণ হঠাৎ থমকে যাবে এমনটি কে ভেবেছিল। জাগতিক কি মহাজাগতিক, মানবজাতি ধরেই নিয়েছিল এই সকলই চলবে তার দেখানো পথ ধরে। হলো না; কবির সুমনের কথায় 'হঠাৎ সময় থমকে দাঁড়ায়' কাণ্ডটি সত্যিই ঘটে গেল। কে জানে এই সময়- বিরাম অল্পবিরাম কিনা! 

কবে কখন এই তথাকথিত সভ্যসমাজ এমন সময়ের মুখামুখি হয়েছিল যখন প্রিয়জনকে শেষ বিদায়েও নিষেধাজ্ঞা- তা ইতিহাসের কোন পাতায় লেখা আছে আমার জানা নেই। চলমান বৈশ্বিক ক্রান্তিকালের পরাকাষ্ঠে পিষ্ট মনে বার বার পেড়েক গাড়ার খবর সেই কষ্টের কফিনে বাড়তি যন্ত্রণা তৈরি করছে প্রতিনিয়ত। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেইসবুক খুলে প্রায়ই আঁতকে উঠতে হচ্ছে মৃত্যু সংবাদে। প্রতিদিনের রোজনামচায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম; কাছের মানুষ, দূরের মানুষ। 

'আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।

          তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,

          বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥

          তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,

          কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।

নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ–

          সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥'

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনে উপলব্ধ ঘাতপ্রতিঘাতের এক পর্যায়ে নিজেকেই বুঝি প্রবোধ দিয়েছিলেন এ গানের মাঝ দিয়ে। তিনি মৃত্যুকে অমোঘ মেনে নিয়ে চলমান প্রকৃতিতে অনন্ত-আনন্দের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন, তরঙ্গের পুনরুত্থানের কথা বলেছেন, দেহের ক্ষয়কে স্বীকার করলেও আত্মার পূর্ণতাকেই নিয়তি মেনেছেন। 

অতি সম্প্রতি কিছু মহান মানুষের মহা-প্রস্থান সামাজে তথা হৃদয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে তার বৈষয়িক অনুভূতির নাম 'অভিবাবকহীনতা'। শিল্পী কালিদাস কর্মকার, স্থপতি কবি রবিউল হুসেন, স্থাপত্য পুরোধা বশিরুল হক এবং সবশেষ আজ ২৮ এপ্রিল চলে গেলেন আমাদের প্রাণ প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী। 

কিছু ক্ষণজন্মা পুরুষ আছেন যারা তাঁদের ব্যক্তিগত কারিশমা দিয়েই তাদের নামে পাশে যুক্ত তকমাগুলোকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় জামিলুর রেজা চৌধুরী, আমাদের প্রাণের 'জেআরসি' স্যার, ছিলেন তেমনই একজন। কি খেতাব, কি পদক কোনো কিছুই তাঁকে অতিক্রম করতে পারেনি। বিপুল জনগোষ্ঠির এ দেশে তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি সকল রাজনৈতিক মতাদর্শকে পাশ কাটিয়ে শুধুই দেশপ্রেমে নিজেকে নিমগ্ন করেছিলেন। এমন কখনো শোনা যায়নি যে তিনি কোনো প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকে ঝুঁকেছেন। তার এই অবিচল অবস্থানের কারণে তাকে নিয়ে কেউ টানাটানিও করেনি বরং রাষ্ট্রযন্ত্র যুগেযুগে তাকে সঙ্গী করেছে উন্নয়নে। 

দেশ বিভাজনপূর্বের আসাম প্রদেশের সিলেট জেলায় ১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর জন্ম নেন এই ক্ষণজন্মা পুরুষ। আজকের যে জেআরসিকে তাকে 'বিস্ময়-বালক'ই বলতে হবে, কারণ স্যারের কাছেই শোনা, যে তিনি মাত্র ছয় বছর বয়সে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং মাত্র বিশ বছর বয়সেই ১৯৬৩ সালে অভাবনীয় কৃতিত্বের সাথে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পূরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। জামিলুর রেজা স্যারের জ্ঞানের আধারের গভীরতার বর্ণনা এখানে বাতুলতা তাই সেদিকে না গিয়ে অন্তত এটুকু বলতে পারি যে ৬০ এর দশকে অনেকটা তাঁর হাত ধরেই এদেশে কম্পিউটার ধারণার আবির্ভাব হয়। তাঁর কৃতিত্বের তালিকা দেশের প্রতি তাঁর অবদানের কাছে ম্লান করেছেন তিনি নিজেই। দাঁড়িয়েছেন সর্বাগ্রে অগ্রনায়ক হয়ে দেশের কারিগরি উন্নয়নে। যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চতর শিক্ষা লাভের পর তিনি অনেকের মতো না পালিয়ে গিয়ে শেষ জীবন পর্যন্ত দেশমাতৃকার সেবা করে গেছেন। এমন সৌভাগ্য নিয়ে কজন জন্মান যিনি কিনা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের জন্য কাজ করে যেতে পারেন?

স্যারকে চেনে না এমন ছাত্র বুয়েটে নেই; আমিও তেমনই একজন যে স্থাপত্যের ছাত্র হয়েও আর সবার মতই তার গুণমুগ্ধ ছিলাম। পরবর্তীতে আমার সরাসরি পরিচয় হয় বুয়েটে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর। তখন স্যারের ক্যারিয়ারের সূর্য মধ্যগগণে জ্বলজ্বলে দীপ্যমান। ১৯৯৮ সালে আমার শিক্ষকতা পেশার সমাপ্তির পরপরই স্যারকে আবার পাই অন্যভাবে। পেশার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার সৌভাগ্য হয়েছে এই মহামানবের সান্নিধ্য পাবার। যতই স্যারকে দেখেছি ততই একজন নিরেট মাটির মানুষকে আবিষ্কার করেছি। কিছু কিছু সান্নিধ্য পাওয়া সত্যিই জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি যা আমৃত্যু লালন করার মতো। 

মানুষ' শব্দটি যদি মানবিকতার প্রতীক হয়, তবে জেআরসি স্যারকে অবশ্যই এই 'মানুষ' পদকটি আমরা পরাতেই পারি। নির্মলচিত্তের, নমনীয়তায় দৃঢ়, মৃদুভাষী, সদা হাসোজ্জ্বল মানুষটি শুধু দিতেই এসেছিলেন। বড়ই কষ্টের কারণ হচ্ছে এমন একজন মানুষের চিরপ্রস্থানের মূহুর্তে তাঁকে সামনে দাঁড়িয়ে স্যালুট না করতে পারাটি। 

সময় যে বাধ সেধেছে স্যার; ক্ষমা করবেন আমায়, ক্ষমা করবেন এদেশের সকল মানুষকে।