বিকিরণের সন্ধানে অশীতিপর

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
Published : 1 Nov 2019, 03:34 PM
Updated : 1 Nov 2019, 03:34 PM

ফিলিপ জেমস এডউইন পিবলসের জন্ম কানাডার উইনিপেগে ১৯৩৫ সালে। ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবাতে  ডিগ্রি সম্পন্ন করে ১৯৫৮ সালে পাড়ি জমান প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬২ সালে সম্পন্ন করেন পিএইচডি। সেই থেকে তিনি কসমোলজির বিবিধ বিষয় নিয়ে সারাজীবন গবেষণা করে চলেছেন। তার সেই গবেষণার এক চমৎকার সারাৎসার পাওয়া যাবে 'প্রিন্সিপল্‌স অব ফিজিকাল কসমোলজি' (Principles of Physical Cosmology, Princeton University Press, 1993) বইটিতে। এই বইটি নানা কারণে প্রচণ্ড গুরুত্ব বহন করে। ৭১৮ পৃষ্ঠার এই ঢাউস বইটি কসমোলজি বিষয়ে যা জানা গেছে, যা বোঝা গেছে তার এক সংহত অনুধাবন। আধুনিক কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্বের বাইবেল এই বইটি।

বইটির একটি ইতিহাস আছে। পিএইচডি শেষ করেই পিবলস কাজ করছিলেন তার তত্ত্বাবধায়ক রবার্ট ডিকির সাথে। ডিকি তার গ্রাভিটি ফিজিক্স সংক্রান্ত কাজের জন্য বিখ্যাত। তিনি আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বের সমান্তরালে ব্রান্‌স-ডিকি থিওরি খাড়া করেছিলেন ১৯৬১ সালে। এই স্কেলার-টেন্সর থিওরিটি যদিও চমৎকার গাণিতিক সৌন্দর্যের দাবি করে, কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্বের মতো সুন্দরভাবে আগাম ফলাফল (প্রেডিকশন) করতে অক্ষম। যাহোক, ডিকির সাথে পিবলস করছিলেন বিগব্যাং নিউক্লিও-সিন্থেসিস সংক্রান্ত গবেষণা।

ষাটের দশকে বলাবাহুল্য কসমোলজি তেমন সংহত কোনো বিজ্ঞান শাখা হিসেবে গড়ে ওঠেনি। তখনো এর  তত্ত্ব ও সমীকরণ সুগঠিত হলেও এর পরীক্ষণজনিত খুব একটা প্রমাণাদি ছিল না। ফলে একটি বিকশিত শাখা হিসেবে কসমলোজি তখনো পাত্তা পেত না। এমতাবস্থায় ১৯৬৯ সালে পিবলস কসমোলজিতে বিবিধ সাম্প্রতিক গবেষণার বিষয়াদি নিয়ে প্রিন্সটনে একটি গ্রাজুয়েট কোর্স দিচ্ছিলেন। বিখ্যাত পদার্থবিদ জন হুইলার তাকে বলেছিলেন, কোর্স মেটেরিয়ালটিকে সংগ্রহ করে বইতে রূপান্তর করতে। তখন-তরুণ পিবলস যারপরনাই লজ্জিত ছিলেন, এরকম একটা অথরিটেটিভ বই লেখা, উপরন্তু এমন তরুণ বয়সে! কিন্তু হুইলার ছিলেন নাছোড়বান্দা, তিনি পিবলসের ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতেন, নোট নিতেন। শেষে পিবলস রাজি হলেন বই লিখতে। এভাবে রচিত হলো 'ফিজিকাল কসমোলজি' (Physical Cosmology, Princeton University Press, 1971)।

পিবলস অন্যত্র লিখেছেন, "সেই সময়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম কসমোলজি একটি বাস্তব-সম্মত ভৌতবিজ্ঞান যার চমৎকার তাত্ত্বিক ও পর্যবেক্ষণসম্মত বর্ণনা সম্ভব। তবে এটা নিশ্চিত ছিল যে এটা এমন এক  বিজ্ঞান যার পরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণসুলভ সাক্ষ্যপ্রমাণ খুবই সীমিত। এটা বোঝা যায় বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা থেকে- মাত্র ২৮০ পাতায় আমি ঐ সংক্রান্ত বিজ্ঞানের একটি যৌক্তিক সার্ভে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম।"  ১৯৭১ সালে যা ছিল ২৮০ পাতার বিজ্ঞান, সেটা কুড়ি বছর পর ৭১৮ পাতার ঢাউস এক বইয়ে রূপান্তরিত হয়। এক ভাবে বলা যায়, পিবলসের এই দুটো বইয়ের ইতিহাস কসমোলজির বয়ঃপ্রাপ্তির ইতিহাস। আপনি যদি প্রথম সংস্করণ (১৯৭১) এবং সর্বশেষ সংস্করণ (১৯৯৩) পাশাপাশি রাখেন (এক্ষেত্রে 'সংস্করণ' বলাটা ঠিক নয়, কেননা বইদুটির নাম ভিন্ন, যদিও একই লেখক এবং একই প্রকাশনী, একই বিষয়, পার্থক্য কেবল বিস্তারে) আপনি কসমোলজির পুরো বিবর্তনটি বুঝতে পারবেন। দেখতে পাবেন, বিশ্লেষণের দক্ষতাগুলো কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, গণিত কীভাবে শাণিত হয়েছে, পর্যবেক্ষণ কীভাবে পরিস্রুত হয়েছে। একইসাথে পুরনো বইটাও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে একারণে যে অনেক গাণিতিক তত্ত্ব বা বিশ্লেষণের প্রথম দিককার রূপ অনেকটাই জটিলতা-বর্জিত হয়। যত দিন যায়, সেটা তত জটিল হয়, তত বেশি স্তর যুক্ত হয়। ফলে নবীন শিক্ষার্থীর জন্য পুরনো সায়েন্টিফিক পেপার এজন্য খুবই শিক্ষণীয়।

'প্রিন্সিপিল্‌স অব ফিজিকাল কসমোলজি' বইটির মুখবন্ধে পিবলস লিখেছেন, "ভৌত সৃষ্টিতত্ত্বের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে এই বইতে একটি সামগ্রিক পরিচয় (জেনারেল সার্ভে) দেওয়া হয়েছে; সাথে থাকছে এই বিষয়বস্তুকে একটি বিকশিত ভৌতবিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে যে অসংখ্য পর্যবেক্ষণ ও তাত্ত্বিক তত্ত্বতালাশ প্রয়োজন, তার বর্ণনা; এবং বর্তমান বিশ্বচিত্রকে উন্নত ও বিস্তৃত করতে (যেসব গবেষণা) করা হচ্ছে তার বর্ণনা। কসমোলজিতে যাকিছু আনন্দদায়ক তার মূলে রয়েছে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত অগ্রগতি এবং নতুন আর পুরানো পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রয়োজনীয় বিবিধ ধারণাসমূহের সমাহার। যেসব ধারণার (প্রতি সক্রিয় গবেষকদের) আগ্রহ বেশি দেখা যায়, ধরে নেওয়া যায় সেগুলো প্রমিত বিশ্বচিত্রের- প্রসারমান মহাবিশ্বের 'হট বিগ ব্যাং মডেল'- মূল কাঠামো-ভিত্তির উপরেই প্রোথিত আছে। এই বিশ্বচিত্রের বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধি যতখানি অনুধাবন করা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি, ততখানি কিন্তু হয়নি, এমনকি এ বিষয়ে যারা অনেক মৌলিক অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যেও নয়। এর কারণ আমার মনে হয় এই যে, এই চিন্তা কাঠামোটি গড়ে উঠেছে বেশ ধীর গতিতে, গত সাতটি দশক ধরে (১৯৯৩-এ লেখা), এবং কখনো কখনো খুব এলোমেলোভাবে। কণা পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে হারে উন্নয়ন হয়েছে, তার সাথে কসমোলজির উন্নয়ন তুলনা করলেই বোঝা যাবে- ছয় দশক আগেই আমরা প্রসারমান বিশ্বের আধুনিক কনসেপ্ট পেয়ে গেছিলাম, অথচ কণা পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জানা ছিল শুধুমাত্র কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের সাধারণ কিছু বিষয়। কোনো বিষয় যদি এমন শম্বুক গতিতে এগোয়, তাহলে সেখানে ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে, তখন পুনরাবিষ্কারেরও দরকার হয়। এখন যেহেতু কসমোলজি জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এখন বাড়তি সমস্যা যোগ হয়েছে – নতুন এক্সাইটিং কিন্তু ক্ষণস্থায়ী আইডিয়ার ভিড়ে পুরনো অথচ বহু-স্বীকৃত ধারণাসমূহের প্যাটার্ন খুঁজে বের করা। তাই আমি মনে করি, কসমোলজিতে দীর্ঘ প্রভাব রাখবে এমন বিষয়সমূহের একটা সার্ভে করা প্রয়োজন, একইসাথে সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো সম্পর্কে একটা রক্ষণশীল মূল্যায়ন প্রয়োজন এবং একইসাথে দরকার পুরনো কিন্তু সমান গুরুত্বের বিষয়গুলির উপস্থাপন, যাতে সেগুলো ভুলে না যাই।"

ফিজিকাল কসমোলজি কাকে বলে? সৃষ্টি নিয়ে তো অনেকেই ভাবে, ভেবেছে। পৌরাণিক গাঁথাও আছে। কিন্তু ভৌত সৃষ্টিতত্ত্ব কাকে বলব? পিবলসের ভাষায়, "ফিজিকাল কসমোলজির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভৌত বিজ্ঞানের জানা নিয়মনীতির আলোকে ব্যাপকতর পটভূমিতে চতুষ্পার্শ্বের বস্তুজগতের অর্থ অনুধাবন করা।"- এই সংজ্ঞার আলোকে পরবর্তী ৭১৮ পৃষ্ঠাব্যাপী বইয়ের পাতায় পিবলস ব্যাখ্যা করেছেন মহাজগৎকে। এই গ্রন্থে রয়েছে তিনটি বিভাগ। প্রথম ভাগে রয়েছে ভৌত সৃষ্টিতত্ত্বের উদ্ভব ও বিবর্তন, যার অধীনে আলোচিত হয়েছে আইনস্টাইনের বিশ্বচিত্র, প্রসারমান মহাবিশ্ব, মাইক্রোতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ (Cosmic Microwave Background, CMB) ইত্যাদি। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের আলোকে কসমোলজি সংক্রান্ত আরো কিছু জরুরি টেকনিকাল বিষয়: যেমন- সাধারণ সহভেদিতা, ক্ষেত্র-সমীকরণ, রবার্টসন-ওয়াকার জ্যামিতি ইত্যাদি। তৃতীয় ভাগে রয়েছে মডার্ন কসমোলজির বিষয়-আশয়: স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সমস্যা, মনোপল ও টেক্সচার, ডার্ক ম্যাটার, গ্যালাক্সি ডিস্ট্রিবিউশন, ব্যাপক কাঠামোয় ভর-বণ্টন, গ্যালাক্সি তৈরির তত্ত্বসমূহ ইত্যাদি। মোটকথা, মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা যেসব তত্ত্ব নির্মাণ করতে পারি, এবং এ সম্পর্কে যা সব পর্যবেক্ষণ আমরা করতে পেরেছি সেই ডেটার চুলচেরা বিশ্লেষণ, এবং ভৌত পরিমাপের এইসব বিষয়-আসয় নিয়ে এক নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক সালতামামি পরিবেশিত হয়েছে এই ঢাউস বইটিতে। এইজন্যই কসমোলজি যারা শিখতে চান তাদের জন্য বইটি অপরিহার্য। এই সব মিলিয়ে ২৬টি অধ্যায়। এই বইটির সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক অংশ হল প্রথম অধ্যায় ('স্ট্যান্ডার্ড কসমোলজিকাল মডেল') এবং শেষের অধ্যায়টি ('লেসন্‌স অ্যান্ড ইস্যুজ')। পুরো বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ পরিচয় এবং পরিশেষে কী শিখলাম, আধুনিক পর্যবেক্ষণ ও মডেল কী দিক-নির্দেশনা দেয়, চিন্তা-কাঠামোয় কী কী সংযোজন বা পরিমার্জন প্রয়োজন, কিংবা তত্ত্বের কোন কোন ধারণায় বা অনুকল্পে শোধন প্রয়োজন সেসব নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা এই দুটি অধ্যায়ে আছে। সত্যি বলতে কি, ১৯৭১ সালের মূল বইটি ('ফিজিকাল কসমোলজি') এবং ১৯৯৩ সালের ঢাউস বইটি ('প্রিন্সিপ্‌ল্‌স অব ফিজিকাল কসমোলজি') উল্টে-পাল্টে দেখলে দুই দশকে কসমোলজি বিষয়ে কী কী আমরা জেনেছি, জানার পরিধি কতটা বেড়েছে, কীভাবে বেড়েছে, আগে কী জানতাম আর এখন কী জানি, চমৎকার সব পর্যবেক্ষণ থেকে পরিস্রুত ডেটা কীভাবে বোধকে শাণিত করে সেটা জানা যায়। যেমন- ১৯৭১ সালে পিবলস তার উক্ত বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন, "কসমোলজিতে ভৌত অবস্থার সহজতা, বিশুদ্ধ চিন্তা আর অনুধাবনের মাধ্যমে আমরা অনেক দূর অগ্রসর হতে পারি। এই দুঃসাহসী কোর্সটির মাধ্যমে মহাবিশ্ব কেমন হতে পারে সেই সম্পর্কে কয়েকটি সহজ প্রতিরূপ আমরা গঠন করতে পারি। এখন আমাদের উদ্দেশ্য হবে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরো ভালভাবে জানা, এবং আলোচিত প্রতিরূপগুলি [বাস্তব মহাবিশ্বের সাথে] আদৌ কোনো যৌক্তিক আসন্নতা প্রকাশ করে কিনা, এবং যদি করে তাহলে, সেই আসন্নতাকে আমরা কীভাবে আরো সঠিক করে তুলতে পারি। কসমোলজির সবচেয়ে আনন্দদায়ক বিষয় হল এই কাজটি আসলেই সম্ভব।" ১৯৬৯ সালের প্রদত্ত কোর্সের ভিত্তিতে রচিত ওই বইটি এবং তার নবতম 'সংস্করণ' আজো সমানভাবে কসমোলজির ছাত্রদের জন্য সোনার খনি হয়ে আছে। আমার হাতে ২০০১ সাল নাগাদ বিদেশ-ফেরতা বন্ধুর বদৌলতে বইটি স্থায়ীভাবে এসে পৌঁছালেও, তার আগেই (সম্ভবত ১৯৯৮ সাল নাগাদ) আমি অধ্যাপক এ এম হারুন-অর-রশীদের কাছে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত 'প্রিন্সিপ্‌ল্‌স' বইটি দেখেছিলাম এবং প্রয়োজনীয় কিছু নোট নিয়ে রেখেছিলাম। এইসব নোটের সাহায্যে আমার দ্বিতীয় গ্রন্থ 'জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান পরিচিতি'র (বাংলা একাডেমি, ২০০০) কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ রচনা করি। এই বইটির প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের পুরোটা এবং তৃতীয় অধ্যায়ের অংশবিশেষ পিবলসকে গভীরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে পিবলসের ঐ বইটি আমার হৃদয়ের খুব কাছের সম্পদ তা বলা যায়। পিবলসের বইটির একটাই সমস্যা – ১৯৯৩ সালের ভার্সনটি ('প্রিন্সিপ্‌ল্‌স') খুবই সাধারণ (জেনারেল টার্মস) বর্ণনা সমৃদ্ধ (এমনকি পিবলসের পূর্বতন বইটিও (১৯৭১'র 'ফিজিকাল') অনেক সহজপাঠ্য, এবং গাণিতিক বিশ্লেষণের ধাপগুলো স্পষ্ট চিহ্নিত), এবং অনেক খুঁটিনাটির ব্যাখ্যা করা নেই, কিন্তু তদুপরি যে পরিমাণ রেফারেন্স বই-জার্নাল ইত্যাদির হদিস শেষে যুক্ত হয়েছে তা এক অসাধারণ রত্নখনির নির্দেশক। এখন অবশ্য কসমোলজি শেখার অনেক ভাল বই আছে, কিন্তু তবু পিবলস (১৯৯৩) আজো অনবদ্য।

পিবলসের দ্বিতীয় যে বইটি আমি আজ আলোচনা করব, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি তার অন্য কয়েকজন কনিষ্ঠ সহকর্মীদের (লাইমান পেইজ ও ব্রুস প্যাট্রিজ) সাথে সহলিখিত, বইটির নাম – 'ফাইন্ডিং দ্য বিগ ব্যাং' (Finding the Big Bang, Cambridge University Press, 2009)। পিবলসের প্রথম জীবনের একটি মূল কাজ ছিল মহাবিশ্বের পটভূমি বিকিরণ (CMB) খুঁজে বের করা। তারা সেটা করেওছিলেন। কিন্তু দৌঁড়ে হেরে যান। সেই বিকিরণটি সঠিকভাবে মাপার কৃতিত্ব পান পেনজিয়াস ও উইলসন। কিন্তু যে তাত্ত্বিক গবেষকরা এটা গণনা করেছিলেন, তারা নোবেল পাননি, পেলেন আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন। সেটা তাদের জন্য একটা বড় বেদনার বিষয় ছিল, ২০১৯ পর্যন্ত! এই পটভূমি বিকিরণ আবিষ্কৃত হল কী করে সেই গল্পটাই এই গ্রন্থের উপজীব্য বিষয়। এটা কোনো পাঠ্যবই নয়। সেই সময়কার বিজ্ঞানীদের জবানীতে সেই সময়, সেই বিজ্ঞান কেমন ছিল সেটাই প্রত্যক্ষভাবে ফুঁটে উঠেছে। প্রতিটি বিজ্ঞানী তার শিক্ষা, তার পড়ালেখা, তার ট্রেনিং, গবেষণা, সতীর্থদের কর্মকাণ্ড, যন্ত্রের বর্ণনা, কীভাবে বিকিরণ মাপলেন – এসবই অকপটে বলেছেন। ফলে বিশ শতকের একটা চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কীভাবে সংঘটিত হল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এখানে ফুটে উঠেছে। বইটির লেখকত্রয় বলেছেন, "এই গল্পের প্রধান অংশগুলো – প্রেডিকশন, নিরূপন, প্রত্যয়ন, এবং বিগব্যাঙের ফসিল বিকিরণের গুণাবলি পরীক্ষার বিষয়গুলো বিভিন্ন বিজ্ঞানের ইতিহাস বর্ণনায় উঠে এসেছে। কিন্তু ওই সময়টায় কী অনুভূতি কাজ করছিল সেটা ঠিক উঠে আসেনি।" এজন্য তারা বিভিন্ন বিজ্ঞানীর স্মৃতি ধারণ করে এখানে তুলে ধরেছেন। প্রায় ৪৬ জন বিজ্ঞানী এই বইয়ে ওই আবিষ্কার বিষয়ে তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। এতে আছেন নোবেল-জয়ী জেফ্রি বারবিজ; তাছাড়াও আছেন বার্নার্ড বার্ক, জর্জ এলিস, জয়ন্ত নারলিকার, ইগোর নভিকভ, জিম পিবলস, আর্নো পেননিয়াস, মার্টিন রীস, পিটার রোল, জোসেফ সিল্ক, রশিদ সুনিয়ায়েভ, রাইনার ওয়েইস, ডেভিড উইলকিনসন, জে ইউ প্রমুখ। ইয়াকত জেল'দোভিচ মারা গেছেন বলে তাঁর কোনো লেখা রাখা সম্ভব হয়নি। এছাড়া রবার্ট ডিকিও মারা গেছেন।

লেখকরা বলেছেন, "এই বইয়ের গল্পটি হলো মহাশূন্যের সর্বত্র সুষমভাবে বিদ্যমান সেই তাপীয় বিকিরণের সমুদ্র আবিষ্কার ও এর খুঁটিনাটি সম্পর্কে। এই বিকিরণের গুণাবলী দেখায় যে এটি এক প্রকার অবশেষ বা ফসিল- বিশ্ব যখন ঘনতর, তপ্ততর এবং সরলতর ছিল সেই সময়কার অবশেষ, এবং এটি পদার্থ ও বিকিরণের এক প্রায়-সুষম সমুদ্র। সুপ্রাচীন কালের ঘটনার অবশেষ হিসেবে রয়ে যাওয়া এই বিকিরণ গুরুত্বপূর্ণ; যেমন অন্য সব ফসিলের ক্ষেত্রে হয়, এর গুণাবলির পরিমাপ অতীতের বিষয়ে আমাদের জ্ঞানবৃদ্ধি করে। এই ফসিল বিকিরণের বিশ্লেষণ কসমোলজির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর সাহায়্যে আমরা জানতে পারি আমাদের মহাবিশ্ব কীভাবে প্রসারিত হয়েছে, শীতল হয়েছে এবং কীভাবে এখনকার এই জটিল অবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে।"

পটভূমি বিকিরণের সন্ধান শুরুই হয়েছিল কিছুটা অনিশ্চয়তা থেকে। কয়েকজন বিজ্ঞানী নানান পথে অন্ধের মত হাতড়াচ্ছিলেন। ১৯৬০ এর দশকে এইসব নানবিধ উপায় অভিসারী হয়ে একটা পথ দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ক্রমান্বয়ে, যে সুড়ঙ্গের ওপারে আলোর দিশা আছে। সেই আলোর বিকিরণ খুঁজে বের করা, নিরূপণ করা, তাত্ত্বিক গণনা করা এবং এর নানান ভৌত গুণাগুণ আদি বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের কী বলে তা জানার প্রচেষ্টার কথাই অংশগ্রহণকারী বিজ্ঞানীদের কথায় উঠে এসেছে- যা এই বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ষাটের দশকে কসমোলজির চলতি ভাবনাগুলো, কেন্দ্রীণ সংশ্লেষণের (নিওক্লিওসিন্থেসিস) মূল বিষয়গুলো, পটভুমি বিকিরণের সম্ভাবনা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা আছে। পটভূমি বিকিরণের গণনার কাজে আদিম বিশ্বে কেন্দ্রীণ সংশ্লেষণ কীভাবে হয়েছিল তার বিশ্লেষণ জরুরি। এই বিষয়টি ১৯৩০ ও ১৯৪০-র দশকে জর্জ গ্যামো, রালফ আলফের ও রবার্ট হেরমানের হাতে বিকশিত হয়। তিরিশের দশকে দেখা যাচ্ছিল যে রাসায়নিক মৌলের উৎপত্তি নক্ষত্রের অভ্যন্তরে অথবা মহাবিশ্বেই তৈরি হয়ে থাকতে পারে, পৃথিবীতে হওয়া সম্ভব নয়। চল্লিশের দশকে জর্জ গ্যামো ক্রমান্বয়ে কয়েকটি পেপার প্রকাশ করেন। তাতে কেন্দ্রীণ সংশ্লেষণের ধারণাটি বিকশিত হয়। বিশেষ করে, ১৯৪৮ সালে গ্যামোর ছাত্র রালফ আলফের তার পিএইচডি গবেষণায় আদিম কেন্ত্রীণ সংশ্লেষণ সংক্রান্ত তত্ত্ব পূর্ণতা দেন। এরপর ওরাই বলেন যে, যদি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সত্যিই ঘটে, তাহলে বিশ্বসৃষ্টির পরবর্তী অবশিষ্ট বিকিরণও থাকবে। সেটা গেল কই? সেই তত্ত্ব থেকে ফসিল বিকিরণের অস্তিত্ব যে থাকা সম্ভব, সম্ভব হলে কতটুকু বিকিরণ কোন তাপমাত্রায় এবং সেটা মাপা যায় কীভাবে- এসব নিয়ে অনেকেই ভেবেছিলেন। সেই ভাবনা-সমাহারের একটি চমৎকার সহজবোধ্য সারসংক্ষেপ তৃতীয় অধ্যায়ে দেওয়া আছে। চতুর্থ অধ্যায়টিই 'রিকালেশন্‌স', যেখানে ৩৪০ পৃষ্ঠাব্যাপী ৪৬ জন বিজ্ঞানী তাদের স্মৃতিচারণ করেছেন বিশদে। তাত্ত্বিক ভাবনা, গণনার গল্প, গ্রাজুয়েট সুপারভাইজারদের স্মৃতি, পরিমাপের পদ্ধতির বর্ণনা – সব মিলিয়ে এ এক অনবদ্য সংগ্রহ।

এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়টি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আরেকজন অতিথি লেখকের সহায়তায় CMB সম্পর্কে জরুরি আরো কিছু গুণাবলি বিধৃত আছে। যেমন CMB-এর শক্তি-বর্ণালি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা (কোন কম্পাঙ্কে বেশি শক্তি ধারণ করে এবং কেন), দ্বিপোল দিক-সাপেক্ষতা (dipole anisotropy, সমুদ্রের মধ্য দিয়ে গমন করলে গতির দিকে পানির বাধা বেশি থাকে, তুলনায় উল্টোদিকে কম বাধা থাকবে, পটভূমি বিকিরণেও দেখা যায় গতির দিকের তুলনায় উল্টোদিকে কম ফোটন পাওয়া যাচ্ছে), CMB পরিমাপ নিয়ে অন্য যেসব গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ আছে (COBE, BOOMERANG, WMAP) সেসব নিয়েও আলোচনা আছে। বইটির পরিশিষ্টে ষাটের দশক থেকে এ পর্যন্ত পটভূমি তাপমাত্রা পরিমাপ, দিক সাপেক্ষতার পরিমাপসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপের পদ্ধতি ও গুরুত্বপূর্ণ পেপারের সারসংক্ষেপ সংযোজিত হয়েছে। এই বইটি দেখায় যে পটভূমি বিকিরণ শুধু একটি তাপমাত্রা পরিমাপের বিষয় নয়; এটি বিজ্ঞানের একটি বিকশিত  শাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যা শুধু একটি সমতলে আবদ্ধ নয়। এর মধ্যে রয়েছে মহাবিশ্বের কাঠামো-বিন্যাস, বিগ ব্যাং মডেলের সূক্ষ্ম কারুকাজ এবং পর্যবেক্ষণ-পদ্ধতির সাথে জড়িত বহুবিধ প্রযুক্তি।

পিবলসের আরো একটি বই আমার হাতে আছে, সেটি 'কোয়ান্টাম মেকানিক্স' (Quantum Mechanics, Princeton University Press, 1992)। বইটি কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের একটি স্ট্যান্ডার্ড টেক্সট। আমি ঠিক বইটি শেখার জন্য ব্যবহার করিনি, তবে মনে হয়েছে, পিবলসের যেটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, সেটা হল গাণিতিক বিশ্লেষণের জেনারালাইজড বর্ণনা! খুঁটিনাটি নয়, সাধারণ বর্ণনা। এর ফলে আধুনিক শিক্ষার্থীর শেখার জন্য এই করণকৌশল খুব একটি বন্ধুসূলভ নয়।

এবার একটু অন্য বিষয়। পিবলসের গুরুত্ব এবং অবস্থান বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বের নিরিখে বোঝা দরকার। কসমোলজির দুটি প্রধান বিষয় হল পটভূমি বিকিরণ গণনা ও পরিমাপ এবং গ্যালাক্সি গঠন প্রক্রিয়া। এই দুটো বিষয় নিয়ে পিবলস সারা জীবন কাজ করেছেন। CMB বা পটভূমি বিকিরণ নিয়ে পিবলসের যুগান্তকারী কাজ হয়েছে। শুধু একটি ধাপে নয়, একাধিক ধাপে। শুধু একবার গণনা করেই ক্ষান্ত দেননি, এর বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভেবেছেন, এর আরো সূক্ষ্ম পরিমাপ নিয়ে ভেবেছেন। কসমোলজির আরো অন্য বিষয় নিয়ে ভেবেছেন, কাজ করেছেন। তার প্রধান অবদান অনেকগুলো, কিন্তু বিশেষ অবদান ফিজিকাল কসমোলজি বা ভৌত সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক দুটো বই। বাজারে অনেক পাঠ্যবই আছে, কিন্তু প্রথম দিককার গুরুর হাতে শেখার আনন্দই আলাদা। বিষয়ের প্রতি লেখকের মমত্ব, গভীরতা ও ব্যাপ্তি খুব দরকার হয়। এখানে আলোচিত বইত্রয় ছাড়াও তার আরেকটি বই আছে ব্যাপক পটভূমিতে মহাবিশ্বের কাঠামো সংক্রান্ত। আমার সংগ্রহে নেই বলে সে সম্পর্কে আলোচনা করা গেল না।

১৯৬০-এর দশকে যখন পটভূমি বিকিরণ আবিষ্কারের জন্য রেডিও প্রকৌশলী আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন বলা হয়েছিল এটা রবার্ট ডিকি ও পিবলসের মন ভেঙ্গে দিয়েছে। এর কারণ অবশ্যই এটি যে সে সময়ে পটভূমি বিকিরণ নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণায় এগিয়ে ছিলেন তারা, এবং এ সংক্রান্ত আগাম ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতাও তাঁদেরই ছিল এবং তারা তা করেও ছিলেন। কিন্তু পুরস্কার জুটল শুধুমাত্র রেডিও ইঞ্জিনিয়ারদের। ২০১৯ সালে বলা যায় সেই গ্লানি মোচিত হল অবশেষে। পিবলস নোবেল পুরস্কারের অর্ধেকটি পেলেন যখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ!

পটভূমি বিকিরণ সংক্রান্ত তাত্ত্বিক বিষয়টি সম্পর্কে আমার পূর্বোক্ত বই 'জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান পরিচিতি'র ৩.২ নং অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা আছে, সেটি পাঠ করলে বোঝা যাবে ওই বিকিরণ আবিষ্কারের পেছনের তত্ত্ব। তবু এখানে সংক্ষেপে বলা দরকার। পিবলসের সাথে CMB আবিষ্কারের বিখ্যাত ঘটনাটি এরকম: ১৯৬০ এর দশকে কয়েকটি দল আলাদাভাবে পটভূমি বিকিরণ খুঁজছিলেন। কিন্তু এই বিকিরণটা কী? কোথা থেকে আসে?

১৯৪০ এর দশকে জর্জ গ্যামোর নেতৃত্বে 'বিগ ব্যাং নিউক্লিওসিন্থেসিস' বিষয়ক খুব মৌলিক কিছু গবেষণা শুরু হয়। তিনি ও তার বন্ধুরা পরমাণু কেন্দ্রীণ বিশ্লেষণের তত্ত্বের সাহায্যে মহাবিশ্বের আদি মুহূর্তের ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। বিভিন্ন পারমাণবিক বিক্রিয়ায় কী ধরনের তাপমাত্রা ও অবশিষ্ট কণিকার উদ্ভব হতে পারে সেটা নিয়ে ভাবছিলেন। তাদের মতে, যদি মহাবিস্ফোরণের মত একটা ঘটনা থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভব হয়ে থাকে, তাহলে আদি মুহূর্তে কী ধরনের কণিকার উদ্ভব হতে পারে, কোন তাপমাত্রায় কী কী বিক্রিয়া চলতে পারে, প্রসারণের ফলে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কীরূপ হতে পারে- এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব। গ্যামোর গবেষণা থেকে বলা যায়, মহাবিস্ফোরণ সত্যি হলে আদি শক্তি-তেজের কিছু অবশেষ আজো রয়ে যাবে একটি ফসিল বিকিরণ হিসেবে। তাদের হিসাবে সেটা প্রায় ৫ ডিগ্রি কেলভিন। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে পরমাণু বোমা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছিল। দেখা গেল, হাইড্রোজেন বোমার যে তত্ত্ব, সেই একই তত্ত্ব মহাবিশ্বের আদি মুহূর্তকেও ব্যাখ্যা করতে কাজে লাগে। ফলে তদানিন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইয়াকভ জেল'দোভিচ ও তার ছাত্র ইগোর নভিকভ, রশিদ সুনিয়ায়েভ প্রমুখও এই বিষয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা করছিলেন। কিন্তু প্রকাশের কড়াকড়ি থাকায় পশ্চিমের দুনিয়া আর সোভিয়েত দুনিয়ায় গবেষণা-তথ্যের আদান-প্রদান খুবই সীমিত ছিল। যাহোক, ১৯৬৩ সালের দিকে ডেভিড উইলকিনসন যখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে এলেন, তিনি রবার্ট ডিকির সাক্ষাৎ পেলেন। ডিকি আগে থেকেই পটভূমি বিকিরণের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। পিবলস লিখেছেন, "একটি কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের উপস্থিতি হট বিগ ব্যাঙের প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হবে। এইকথা আলাদাভাবে এবং প্রায় একইসময়ে বুঝতে পেরেছিলেন প্রিন্সটনের রবার্ট ডিকি এবং মস্কোয় ইয়াকভ জেলদোভিচের গ্রুপ"। মস্কোর গবেষকরা এই তাপমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন ১ থেকে ১০ কেলভিন, আর ১৯৪৬ সালে ডিকির হিসাব মতে ২০ কেলভিন। বিশ্ব আদিতে অত্যুত্তপ্ত থাকলে এখন সেই তাপের অবশিষ্টাংশ বিকিরণ আকারে মহাকাশে পাওয়া যাবার কথা। ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামরিক-গবেষণার অংশ হিসেবে ডিকি একটা যন্ত্রের আবিষ্কার করেন যার নাম 'ডিকি রেডিওমিটার'। রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা এই যন্ত্রটা সম্পর্কে জানেন। ১৯৬০ এর দশকে রবার্ট ডিকি চারজনের একটা দল নিয়ে পটভূমি বিকিরণ খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এই দলে এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করতেন ডেভিড উইলকিনসন আর পিটার রোল; আর থিওরির কাজ করতেন পিবলস। ডেভিড উইলকিনসন জানাচ্ছেন, "এই বিকিরণটা যে আমরা খুঁজে পাব সেটা আমরা তেমন আশা করিনি। প্রথমত, আমরা যে একটা বিগ ব্যাং মহাবিশ্বে বাস করি তার কোনো নির্ভরযোগ্য ডেটা ছিল না। এই বিকিরণটা চারপাশে আছে এবং কেউ সেটা খুঁজে পায়নাই – এই আইডিয়াটাই ছিল ফ্যান্টাস্টিক। কিন্তু ঘটনা যেটা দাঁড়াল, রেডিও জ্যোতির্বিদরা যেভাবে কাজ করেন, তারা অত্যন্ত সুবেদী যন্ত্র নিয়ে কাজ করেন অতোটা হয়ত তাদের দরকারও নেই, কিন্তু তারা এই বিকিরণ খুঁজে পান নাই, কেননা এই বিকিরণ সবদিক দিয়েই আসছে। কাজেই আমরা যত ভাবছিলাম, এবং রেডিও অ্যাস্ট্রনমির পেপার পড়ছিলাম, ততই বুঝতে পারছিলাম, হ্যাঁ এটা থাকতে পারে, কিন্তু কেউ এটা খুঁজে পায়নাই। বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপ থাকলে এটা পাওয়া সম্ভব। প্রতি মঙ্গলবার ডিকি গ্রুপ মিটিং করতেন। এরকমই এক মঙ্গলবার মিটিংয়ের মধ্যিখানে হঠাৎ বব ডিকির ফোনখানা বেজে উঠল। অন্য তিনজন অন্যমনষ্ক ছিলেন, কিন্তু যখন তারা শুনতে পেলেন, ডিকি 'হর্ন অ্যান্টেনা', 'কোল্ড লোড' এসব কথা বলছেন, তখন ওঁরা নড়েচড়ে বসলেন। ফোনালাপ শেষে ডিকি বললেন, 'বয়েজ, তোমাদের কম্মো সারা, আমরা হেরে গেছি!' কীরকম? না, ৩০ মাইল দূরে নিউ জার্সির হোমডেলে বেল ল্যাবের একখানি টেলিস্কোপ নিয়ে পেনজিয়াস ও উইলসন নামের দুই রেডিও ইঞ্জিনিয়ার সেই কাঙ্খিত বিকিরণ খুঁজে পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে'।"

কীভাবে এই দুই গ্রুপ পরস্পরের কথা জানতে পেলেন? পিবলস জানাচ্ছেন, "ডিকির নির্দেশে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পিটার রোল এবং ডেভিড উইলকিনসন একটি রেডিওমিটার বানিয়েছিলেন ওই বিকিরণ খুঁজে পাবার উদ্দেশ্যে, এবং তিনি আমায় বলেছিলেন ওই বিকিরণ খুঁজে পাবার অথবা না-পাবার কী কী তাৎপর্য থাকতে পারে সেটা ভাবার। এর ফলে মহাবিশ্বে হাল্কা মৌল উদ্ভবের 'গ্যামো শর্ত' পুনরাবিষ্কৃত হল, এবং গ্যালাক্সি ফরমেশনের ফিজিক্স নতুন আলোচনায় এল। এসব নিয়ে বাল্টিমোরে জনস হপকিন্স অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে কলোকিয়াম দেবার জন্য আমাকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল এই ভেবে যে রোল-উইলকিনসনের তৈরিকৃত যন্ত্র নিয়ে আর কোনো প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা নেই। … [আমি বলেছিলাম] পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১০ কেলভিন হতে পারে, যা অবশ্যই রোল-উইলকিনসনের যন্ত্রের পক্ষে নিরূপণ সম্ভব। ওই বাল্টিমোর কলোকিয়ামে অংশ নিয়েছিলেন কেন টার্নার, যাঁর কাছ থেকে বার্নি বার্ক (তিনি টার্নারের সাথে ওয়াশিংটনের কারনেগি ইনস্টিটিউশনে কাজ করতেন যেটি আদতে একটি রেডিও অ্যাস্ট্রনমি গবেষণা কেন্দ্র ছিল) জেনেছিলেন, সেখান থেকে হোমডেলের বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে কর্মরত আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন জানতে পেরেছিলেন। তারা হোমডেলস্থ টেলিস্কোপটিকে রেডিও অ্যাস্ট্রনমির কাজে লাগাতে চাইছিলেন, কিন্তু ঐ যন্ত্রে একটা বাড়তি নয়েজের সন্ধান পেয়েছিলেন যেটা তারা বুঝতে পারছিলেন না। পরে হোমডেল ও প্রিন্সটন গ্রুপের এক যৌথ সভায় শেষে বোঝা গেল যে ওই বাড়তি নয়েজটিই আসলে মহাজাগতিক উৎস থেকে আসছে। যেহেতু নয়েজটি দিক-নিরপেক্ষ [সব দিক থেকেই প্রায় সমান] তাই বলা যায় সেটি হট বিগ ব্যাং কসমোলজির কথিত তাপীয় পটভূমি বিকিরণের প্রথম শর্ত অন্তত পূরণ করে। তখন ৭-সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে নিরূপিত ঐ 'বাড়তি অ্যান্টেনা টেম্পারেচার'  সম্পর্কে প্রবন্ধ রিপোর্ট করা হল (পেনজিয়াস ও উইলসন, অ্যাস্ট্রফিজিকাল জার্নাল, খণ্ড ১৪২, পৃ. ৪১৯, ১৯৬৫) এবং একেই 'মহাজাগতিক কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ' হিসেবে শনাক্ত করা হল (ডিকি, পিবলস, রোল এবং উইলকিনসন, অ্যাস্ট্রফিজিকাল জার্নাল, খণ্ড ১৪২, পৃ. ৪১৪, ১৯৬৫)।" (-পৃ. ১৪৬-৪৭, পিবলস, 'প্রিন্সিপলস অব ফিজিকাল কসমোলজি') লক্ষণীয়, দুটি পেপারই একই জার্নালে পরপর প্রকাশ পেয়েছিল! ফলে ১৯৬৫ সালে পদার্থবিদ্যায় যখন পেনজিয়াস ও উইলসনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল, সেটা নির্ঘাত ডিকি ও তার দলের মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল। কেননা সেই সময়ে কসমোলজি নিয়ে খুব কম লোকই কাজ করতেন, তন্মধ্যে আবার রবার্ট ডিকি ও তার গবেষণা দল খুবই নামজাদা ছিল। ২০১৯ সালের নোবেল পুরস্কার পিবলসের অন্তত সেই চুয়ান্ন বছর আগেকার বেদনাটা হয়ত লাঘব করল।

ডিকি বা জেলদোভিচ বেঁচে থাকলে খুবই আনন্দিত হতেন এইসব অগ্রগতি দেখে। তবে পটভূমি বিকিরণের জয়যাত্রা আজো অক্ষুণ্ন আছে এবং বিকল্প কসমোলজি আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এর গবেষণা চলতেই থাকবে। হয়ত ভবিষ্যতের আরো দুয়েকটি নোবেল পুরষ্কারের কারণ হবে, পটভূমি বিকিরণ। তাই চরিত্র যেই হোন না কেন, এ গল্পের মূল নায়ক একজন বিকিরণ – অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ।