Published : 03 Aug 2017, 11:24 PM
বাংলাদেশের মুসলমানদের বিশ্বাস, তাদের ধর্মপালনের ধরন ও জীবনযাপন দেখে মোটাদাগে তাদের তিনটি দলে ভাগ করা যায়।
প্রথম দল এই ভূভাগে ইসলামের যে বিকাশ ও তার ধারাবাহিকতা, সেটা বুঝুক বা না-বুঝুক, তাদের কথাবার্তা ও জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়, তারা তা একভাবে ধারণ করে। তারা এ দেশের পীর-মুর্শিদ-আউলিয়া-ফকির-দরবেশ-আউল-বাউলদের কমবেশি শ্রদ্ধা-ভক্তি-সম্মান করতে চায় (অনুসারী হোন বা না-হোন)। তারা তাদের ধর্মীয় জীবন বাংলার পেশা-প্রকৃতি-ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-কালচারের ধারাবাহিকতার সঙ্গে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত-স্বাভাবিক সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে যাপন করেন বা করতে চায়।
সময়-পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়ে চলে সেভাবেই তারা তাদের জীবনযাপনে পাপ ও পুণ্যের প্রয়োজনের সমন্বয়ও একভাবে করে চলে। এই সমন্বয়ের কাজে তারা ধর্মের দলিল-দস্তাবেজ আর এগুলোর আদি-অন্তে কী ছিল না-ছিল তা নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাটি করতে চায় না। মোটামুটিভাবে তারা ধর্মে একটা সরল আস্থা নিয়ে জনজীবন ও প্রগতির ধারার সঙ্গে কমবেশি সঙ্গতি-সাযুজ্য রেখে জীবন কাটাতে চায়।
দ্বিতীয় দলের মানুষ সময়ের স্রোতে চলেন এবং যুগের চাহিদা, দাবি ইত্যাদি পূরণে পিছিয়ে থাকতে চান না। কিন্তু মনে করেন এগুলোর অনেক কিছুই ধর্মে নেই এবং তা বন্ধ হওয়া উচিত। এবং প্রয়োজনে এর জন্য শাস্তি দেওয়া উচিত। তারা নাচ-গান-অভিনয়-আঁকাআঁকি-সুদ-মদ-ঘুষ থেকে শুরু করে অনেককিছুই মনে-মুখে পাপ মানেন। কিন্তু এগুলোতে অংশগ্রহণে খুব একটা পিছিয়ে থাকেন না।
আবার জাগতিক অনেক সংকট-সমস্যার কারণ তারা অনেক সময় এগুলোর মধ্যেই খোঁজেন। তাদের আচরণে এমন প্রত্যয় ফুটে ওঠে যে, ক্ষমতা-আইন হাতে নিয়ে কেউ যদি এগুলো থামাতে বাধ্য করতেন তাহলে তারাও থেমে শান্তি পেতেন। অথবা তারা নিজেরা যদি ক্ষমতা-আইন হাতে পেতেন তবে এসব একেবারে থামিয়ে দিতেন। বিশ্বাস ও জীবনাচরণে তুলনামূলকভাবে অধিক বৈপরীত্য নিয়ে তারা সময় ও পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের দ্রুত অভিযোজন করে চলেন।
তৃতীয় দলভুক্তরা মনে করেন ইসলামের নামে এ দেশের মানুষ যা পালন করে এসেছে এবং এখনও করে তার মধ্যে আসল ইসলাম নেই। আসল ইসলাম হল মূলত প্রাক-ইসলাম আরবের কৃষ্টি-কালচার-সমাজ-রাজনীতিসহ যে ইসলাম, সেটি। তারা মনে করেন, ইসলামের মধ্যে যে বহু ভাগ-উপবিভাগ আছে এর মধ্যে তারা যেটা পালন করেন সেটাই আসল ইসলাম। মনে করেন, তাদের সেই আসল ইসলাম বাংলাদেশে এ রকম ভাষা-সমাজ-রাষ্ট্র-কৃষ্টি-কালচার-শিক্ষা ইত্যাদি বহাল রেখে পাওয়া সম্ভব নয়। এই ইসলাম বাংলার জমিনে যেভাবে হোক, মুসলমানদের উদ্ধারের জন্য কায়েম করা দরকার। তারা শারীরিকভাবে স্ব-সময়ে ও স্ব-সমাজে বাস করেন, স্ব-সময়ের অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা বর্জন করতেও খুব একটা সক্ষম হন না, কিন্তু মানসিকভাবে সব সময় অন্য সময়ে ও অন্য সমাজে বিচরণ করেন এবং সেটাকেই সর্বকালে সর্বজনীন কল্যাণের জন্য আদর্শ ভাবেন।
মোটাদাগে ভাগ করা এই তিনটা দলের রাজনৈতিক শ্রেণিকরণও যদি মোটাদাগে করা, তবু এ কথা বলা যায়:
প্রথম দলটা মূলত আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলের, দ্বিতীয় দলটা মূলত বিএনপি-জাপা ও সমমনা দলের এবং তৃতীয় দলটা মূলত জামায়াত-হেফাজত ও সমমনা দলের উত্তরাধিকার ধারণ করে।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শেষের দলের মুসলমানদের খুব একটা সংকট নেই। তাদের নানা কথাবার্তা, লেখালেখি, আচরণ ও কর্মসূচি থেকে অনেকটা বুঝে নেওয়া যায় যে তারা মনে করছেন, দেশ তাদের ধর্মীয় চাওয়ার দিকেই ক্রমে ধাবিত হচ্ছে। আওয়ামী সমমনা ও বিএনপি-জাপা সমমনা রাজনীতি নানা সময়ে ক্ষমতার স্বার্থ উদ্ধারে তাদের সমর্থন লাভে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, এবং প্রয়োজনে উসকানিও দিয়েছে।
দুর্নীতিগ্রস্ত, নির্বাচিত-অনির্বাচিত সব সরকারের নানা নীতি-কৌশলও শেষ পর্যন্ত তাদের সামাজিক ভিত্তিই শক্তিশালী করেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে দ্বিতীয় দলের মুসলমানেরা দ্রুত অভিযোজনের মাধ্যমে একভাবে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন।
কিন্তু এতে ভয়াবহ রকমের সংকটের মুখে পড়েছে প্রথম দলভুক্ত মানুষেরা। তারা যেহেতু এই ভূভাগের সমাজ-সংস্কৃতির স্বাভাবিক-স্বতঃস্ফূর্ত রূপান্তরের ধারায় বিকশিত, সুতরাং সেটাকে ত্যাগ করে এ রকম অস্বাভাবিক অভিযোজনে প্রায় অক্ষম। তারা যে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ধারণ করেন সেই আওয়ামী সমমনা রাজনীতি তাদের বহন করতে চাইছে কি না, এ নিয়ে তারা এখন প্রতিনিয়ত দ্বিধায়।
তারা মনে করছেন, আওয়ামী সমমনা রাজনীতি বাকি দুই দলের, বিশেষ করে তৃতীয় দলের বক্তব্য ক্রমশ গিলে নিচ্ছে। তাহলে তাদের আশ্রয় কোথায়? এটা তাদের জন্য একটা ভয়াবহ রকমের অস্তিত্বের সংকট।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ামক শক্তি এখনও এই প্রথম দল। এ দলই সত্তরে ছয় দফায় একচ্ছত্র রায় দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা অবশ্যম্ভাবী করেছিল। এ দলই একাত্তরে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। এই দলই এর আগে সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টি করে চুয়ান্নতেই মুসলিম লীগকে এ দেশের রাজনীতি থেকে ছুঁড়ে ফেলেছিল। আর এই দলই অনেক পরে ২০০৮ সালে আওয়ামী সমমনা রাজনীতির একচেটিয়া বিজয় নিশ্চিত করেছিল। এই সেদিনও এ দলই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-বিচার খেলা থামিয়ে সত্যিকারের বিচার করতে আওয়ামী সমমনা রাজনীতিকে বাধ্য করল।
ইতিহাস যদি দেখি, রাজনীতি তার ক্ষমতার স্বার্থে যে কোনো কিছু গিলে বা উগড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু মানুষের বিশ্বাসের ধরন এখনও এ রকম নয় (ভবিষ্যতেও হয়তো এ রকম হবে না)। সে কারণেই সে প্রয়োজনে আগের রাজনীতি ছুঁড়ে ফেলে তার বিশ্বাস বহন করে নতুন রাজনীতিতে ভর করতে খুব বেশি সময় নেয় না।
আমাদের বোঝা দরকার, শুধু পেশার ধরন বা চরিত্র নয়, শুধু শ্রমিক-কৃষক এগুলোও নয়, এ দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি আরও অনেকদিন হয়তো এই বিশ্বাসের ধরন দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হবে।
এ দেশে রাজনীতি করতে চাইলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম, আবেগ ও তাদের বিশ্বাসের ধরন বোঝা প্রয়োজন। যে কতিপয় মানুষ মনে করেন, দেশের সব মুসলমান দ্বিতীয় বা বিশেষ করে তৃতীয় দলে ভিড়ে গেছেন তাদের ধারণা সত্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। নতুন রাজনীতির আশ্রয় পেলেই সে তার স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতে বাকি সবাইকে ভাসিয়ে দেবে।