আমাদের শক্তি সংকট: নিওলিথিক মোমবাতি বনাম পরমানুর শক্তি

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
Published : 23 June 2011, 06:08 PM
Updated : 15 Oct 2011, 05:01 PM

বিদ্যুতের সমস্যা যে কী তা আমরা, বাংলাদেশীরা, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আধুনিক জীবনের প্রায় সবকিছু নির্ভর করে বৈদ্যুতিক শক্তির ওপর, তাই বিদ্যুতের অনিয়মিত সরবরাহে দৈনন্দিন জৈবনিক সমস্যাগুলো এখন তুঙ্গে। দুই/তিন ঘন্টা পরপর একঘন্টার জন্য বিদ্যুৎ নেই। অনিয়মিত মৌসুমী বায়ু প্রবাহের দরুণ সৃষ্ট অস্বাভাবিক গরম কিংবা রমযান মাসেও লোড-শেডিং চলছে নৈমিত্তিক।

ঢাকাতে আমার বাসস্থান মিরপুরে, সেখানে লোডশেডিংয়ের মাত্রা নিকটস্থ মোহাম্মদপুর থেকে গড় হিসাবে বেশী। একটি হিসাব দিচ্ছি – রমযান মাসে ইফতার থেকে তারাবি'র নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত পুরো প্রায় ৪ ঘন্টা সময়ে মোহাম্মদপুরে একটিবারও বিদ্যুৎ যায় না, অথচ আমার মিরপুরে এই সময়ের মধ্যে অন্তত একবার বিদ্যুৎ যাবেই। শুনেছি, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীর (ডিপিডিসি) তুলনায় তুলনামূলকভাবে ডেসকো কম বিদ্যুৎ পায়।

নানা সূত্রে থেকে শুনেছি, আমাদের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। কথাটি সত্যি, কোনো শুভঙ্করের ফাঁকি নয়। গত বছর (২০১০) যেখানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল গড়ে প্রায় ৪০০০ মেগাওয়াট, এখন সেখানে উৎপাদিত হচ্ছে গড়ে ৫০০০ মেগাওয়াট। তাহলে এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ যাচ্ছে কোথায়? আসলে চাহিদা বেড়ে চলেছে, যা প্রত্যাশা করা হয়েছিল তার তুলনায় অনেক বেশী। আপনি যদি ঢাকা শহরে আপনার মহল্লার কথাই চিন্তা করেন, আপনি দেখবেন আগে যেখানে ছিল ১/২ তলা বাড়ি, এখন সেখানে ডেভেলপারের কল্যাণে ৫/৬ তলা সুউচ্চ ইমারত। ফলে আগে যেখানে ১/২টি পরিবারের জন্য বিদ্যুৎ দেওয়া হতো, এখন সেখানেই লোড বেড়েছে ৪/৫ গুণ বা তারও বেশি। আপনি ঢাকা শহরে ক্রমবর্ধমান শপিংমলগুলোর কথা এবং ঢাকা শহরের ভেতরে ও বাইরে আবাসন প্রকল্পগুলির দানবীয় বৃদ্ধির কথা ভাবুন। এরা সবাই বিদ্যুতের নতুন গ্রাহক। চাহিদা যেভাবে বাড়ছে সেই অনুপাতে উৎপাদন বাড়ছে না, কাজেই সৃষ্টি হচ্ছে ঘাটতির।

ঢাকা শহর বিদ্যুৎ ব্যবহারের দিক দিয়ে ব্ল্যাক-হোলের মতো, সারা দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের অর্ধেকের কিছুটা কম সে একই শুষে নেয়। মেগাসিটির তো বিদ্যুৎ লাগবেই। সভ্যতার প্রথম উপাদানই হলো শক্তির ব্যবহার। এই ডিজিটাল যুগে শক্তির ব্যবহার ছাড়া কোনো নগর গড়ে উঠতে পারে না, মেগাসিটি তো নয়ই। আমরা তো আর ঢাকাবাসীকে প্রস্তরযুগে ফিরে যেতে বলতে পারি না, তাহলে মুঠোফোনগুলো তো আর চলবে না, তাই না!

আপনি যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকান দেখবেন তারা কতখানি এনার্জি হাংরি। উন্নয়নের একটা প্রধান শর্তই হলো ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন যার অন্যতম প্রধান উপাদান বিদ্যুৎ। দিল্লি, ইসলামাবাদ কিংবা লন্ডন-টোকিও-নিউইয়র্ক-টরন্টো কী পরিমাণ আলো ঝলমলে! কত কত শক্তিই না তাদের লাগছে! আর আমার হতদরিদ্র ঢাকা! হায়রে, এক ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে তো পরের ঘন্টায় নাই! এভাবে কি উন্নয়ন হয়? 'অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে'?

দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ হাল কেন হলো, কীভাবে হলো সে প্রশ্ন করে আর লাভ নেই। বরঞ্চ এর থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজাই বুদ্ধিমানের কাজ। সরকারী হিসাবে দেখা যায়, আমাদের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগই প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে করা হয়। এছাড়া তেল (৯%), কয়লা (৫%) এবং জলবিদ্যুৎ (৬%) ব্যবহার করা হয় শক্তির উৎস হিসেবে। জলবিদ্যুৎ ছাড়া বাকী সবগুলো উৎসই প্রচলিত ফসিল জ্বালানী। অর্থাৎ এদেরকে কোনো-না-কোনোভাবে দহন করে শক্তি উৎপাদন করতে হয়। আর এইসব রাসায়নিক দহন বিক্রিয়ার অপরিহার্য উৎপাদ হলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য 'গ্রিনহাউজ গ্যাস'। এইসব গ্যাস বায়ুমন্ডলে মিশে দিয়ে তার তাপধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ সূর্য থেকে যে পরিমাণ শক্তি পৃথিবীতে এসে আবার ফিরে যায়, তার কিছুটা এইসব গ্যাস ধরে রাখে। ফলশ্রুতিতে জলবায়ু ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে যার জন্য সমুদ্রের উচ্চতা বাড়বে এবং তার প্রধান শিকার বাংলার দুখী মানুষ। দেশের উপকূলীয় অংশ (সুন্দরবনসহ দক্ষিণবঙ্গের একটা বড় অংশ, কিন্তু বাকলা উপদ্বীপ নয়) দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। আমাদের দেশের ১৬% ভুমি যদি হারিয়ে যায় তো তার বাসিন্দাদের কী হবে? তারা তো আর বসে থাকবে না, তারা স্থানান্তরে এমনকি দেশান্তরেও চলে যাবে। এই জনপ্রবাহ কিন্তু কিছুতেই ঠেকানো যাবে না, কাজেই একে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে সেটা নীতিনির্ধারকদের মাথায় রাখতে হবে এখন থেকেই। উষ্ণায়নের ফলে মাছের প্রজনন বিঘ্নিত হবে, শস্যের পরাগায়ণ বিঘ্নিত হবে। ফলে খাদ্যশস্যে টান পড়বে। সারা বিশ্বেই এই প্রভাব পড়বে। বিশ্বের উষ্ণায়নজনিত সমস্যাকে যতই আমরা এড়িয়ে যেতে চাই না কেন, কিংবা 'উন্নত বিশ্বের দাতা দেশগুলির শিখিয়ে দেয়া মুখের বুলি' বলে গাল পাড়ি না কেন, আমাদের মানতেই হবে যে 'সত্য যে কঠিন, কঠিনের ভালোবাসিলাম'। মরুভূমিতে চোখ কান বুজে কি আর ঝড় এড়ানো যায়!

ফসিল বা জীবাস্ম জ্বালানী, অপরপক্ষে, অপরিসীমও নয়। বাংলাদেশে আবার তা অপ্রতুলও বটে। এখনই গ্যাসের যা ঘাটতি তাতে না রান্না করা যায় নির্বিঘ্নে, না গাড়ি চালানো যায়, না শিল্পকারখানায় ব্যবহার করা যায়। সরকার 'গ্যাস রেশনিং' চালু করতে বাধ্য হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানী একসময়ে শেষ হবেই। কাজেই তখন বিদ্যুৎ কীভাবে উৎপাদিত হবে সেটা এখন থেকেই ভাবা উচিত। সরকারও ভাবছে। কারণ আমরা দেখছি সরকারী 'পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানে' বলা হয়েছেঃ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫% এবং ১০% আসবে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে যথাক্রমে ২০১৫ ও ২০২০ সাল নাগাদ।

নবায়নযোগ্য শক্তি কী? এ ধরনের শক্তি প্রকৃতিই আমাদের নিরন্তর দিয়ে চলেছে, এর উৎস অনিঃশেষ। এর উৎপাদ হিসেবে কোনো গ্যাস নির্গত হয় না (আমরা সরাসরি এসব উৎস থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারি)। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হলো পানি, জোয়ার-ভাঁটা, বায়ু, সৌরশক্তি, ভূগর্ভস্থ তাপ, বায়োগ্যাস ইত্যাদি। এসব উৎস পরিবেশ বান্ধব, এদের স্থাপনজনিত খরচ বেশ বেশী হওয়া সত্ত্বেও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ছাড়া এদের আর কোনো খরচ নেই। কারণ এদের জন্য কোনো জ্বালানী কিনতে হয় না, প্রকৃতিতেই তারা আছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপরোক্ত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ২০১৫ সাল নাগাদ মোট প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট এবং ২০২০ সাল নাগাদ মোট প্রায় ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে নবায়নযোগ্য উৎস হতে। আমার ছাত্র মওদুদুর রহমান ও অন্যান্যেরা একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছে, বিভিন্ন নবায়নযোগ্য খাত থেকে কতখানি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারে। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের প্রধান কয়েকটি খাত – সৌরশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস ও বায়োগ্যাস এবং বায়ুশক্তি – থেকে আমরা কী পরিমাণ বিদ্যুৎ পেতে পারি, তা গণনা করা হয়েছে ঐসব খাতসমূহের সম্ভাবনার বিশ্বাসযোগ্য মান খতিয়ে দেখে। অর্থাৎ কোনো একটি খাত থেকে ২০১৫ বা ২০২০ নাগাদ কত শক্তি আমরা পেতে পারি, কিংবা ঐ খাতে বার্ষিক অর্থলগ্নীর হার বা ঐ খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হার বিবেচনায় এনে ঐ খাত থেকে প্রাপ্তব্য শক্তির একটি প্রত্যাশিত মান হিসাব করা। তাদের উক্ত হিসাব নিচে সারণি আকারে দেওয়া হলো।

২০১৫ ২০২০
(মেগাওয়াট) (মেগাওয়াট)
সৌরশক্তি — ৩৭৬ — ১৪৮০
জলশক্তি — ২৫০ — ৩০০
বায়োমাস ও বায়োগ্যাস — ৬০ – — ১২০
বায়ুশক্তি — ৬ — ১০০

[সূত্র: আইসিসিইবি কনফারেন্স, ২১-২৩ জুলাই ২০১১, বন, জার্মানি।]

এই হিসাবটি আমাদের দেখায় যে, সৌরশক্তিই আমাদের প্রধান ভরসা। কারণ অন্যান্য খাত থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ হয় ততোটা নির্ভরযোগ্য নয়, নতুবা তাদের প্রযুক্তি ততোটা উন্নত হয়নি, কিংবা বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের দেশে সৌরশক্তি যথেষ্ট অবাধ এবং মোটামুটি প্রাচুর্যময়, বাজারে 'সোলার হোম সিস্টেমে'র চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে, সরকারও নতুন আবাসিক ভবনে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। সৌরশক্তির সমস্যা হলো এর রূপান্তর দক্ষতা বা কনভার্সন এফিসিয়েন্সি খুব কম। তাছাড়া প্রচুর জায়গাও লাগে, আমরা তো আর ধানক্ষেত বাদ দিয়ে সোলার সেল দিয়ে মাঠের পর মাঠ ছেয়ে দিতে পারি না! তাছাড়া খরচটাও বেশি। আমাদের দেশীয় একটি কারখানায় সেদিন দেখলাম একটি সোলারসেলের দাম ১৪০ টাকা চাইছে আর ক্ষমতা মাত্র ১ ওয়াট-পিক! বেশ দামী! আমাদের দেশে, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে, বায়ুশক্তি একটা বড় উৎস হতে পারে, যদিও এই সেক্টরটি এখন পর্যন্ত যথেষ্ট অবহেলিত। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, যথার্থ বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত গবেষণার অভাবই উইন্ডমিলের ব্যাপারে আমাদের ব্যর্থতার কারণ। সাধারণভাবে, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নবায়নযোগ্য শক্তির সমস্যাগুলো হলো – খরচ বেশী, প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের অভাব, খোলা জায়গার অভাব, বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক গবেষণার অভাব, যান্ত্রিক দক্ষতা কম, অন-গ্রিড বিদ্যুতের অভাব, মানসিকতার প্রতিবন্ধকতা, প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তা, তথ্যের অপ্রতুলতা, সরকারী গা-ছাড়া মনোভাব। বর্তমান সরকার একটি 'সাস্টেইনেবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি' করার ঘোষণা দিয়েছিল। এরকম একটি কর্তৃপক্ষ না থাকায় নবায়নযোগ্য শক্তির খাতে নানান বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। একটা সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে আমাদের দেশে বিদ্যুতের যে পরিমাণ ঘাটতি বর্তমানে রয়েছে, খুব নিকট-ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য শক্তি তা পূরণ করতে পারবে বলে মনে হয় না। তার কারণ উপরোক্ত সমস্যাবলি যার থেকে সহজে উত্তরণের কোনো পথ নেই। কিন্তু আমাদের বলতে গেলে কালই লাগবে অন্তত ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাব্যতা বিচার করলে দেখা যায়, এই পরিমান 'বেজ-লোড' বা বুনিয়াদি লোড দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসগুলোর আপাতত নেই। ২০২০ সাল নাগাদ মোট ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এই খাত থেকে পাওয়ার ব্যাপারটা অসম্ভব নয়, কিন্তু খুবই উচ্চাভিলাষী তো বটেই।

এবার আসা যাক পরমাণু শক্তির বিষয়ে। পদার্থের পরমাণু এক বিপুল শক্তির ধারক ও বাহক। আইনস্টাইন এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁর বিখ্যাত ইকুয়েশন E = mc2 এর মাধ্যমে। ওঁর পর লিও শিলার্দ, এনরিকো ফের্মি, এবং অন্যান্যের গবেষণায় পরমাণুর শক্তি উন্মোচনের ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়। রাসায়নিক দহন ও পারমাণবিক বিক্রিয়ার প্রকৃতিই আলাদা – দহনে দুটো অণুর ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পার্থক্যের সৃষ্টি হয় কিন্তু পরমাণুর অভ্যন্তর ঠিক থাকে; কিন্তু নিউক্লিয় বিক্রিয়ায় পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের বিন্যাসে অদলবদল হয়। রাসায়নিক দহন ঘটে ১০^-৮ সেন্টিমিটার স্কেলে, কিন্তু পারমাণবিক বিক্রিয়ার স্কেল ১০^-১৩ সেন্টিমিটার। একটা ক্ষুদ্র পরমাণুর মধ্যে লুকিয়ে আছে অকল্পণীয় শক্তি, ভাবা যায়! ১ গ্রাম পদার্থ যখন আইনস্টাইনের উপরোক্ত সমীকরণ অনুযায়ী বিশুদ্ধ শক্তিতে রূপান্তরিত হয় তখন তা থেকে ২৫ গিগাওয়াট-ঘন্টা বিদ্যুৎ শক্তি পাওয়া যায় – এই শক্তি ২১ কিলোটন টিএনটি বোমার সমতুল কিংবা সাড়ে পাঁচলক্ষ গ্যালন গাড়ির তেলের সমতুল। কী বিপুল শক্তির আধার এই পরমাণু!

পরমাণু বিক্রিয়া দু'রকমের – ফিশন ও ফিউশন। ফিশন প্রক্রিয়ায় একটি তেজস্ক্রিয় পরমাণুকে নিউট্রন কণা দিয়ে আঘাত করলে সে ভেঙ্গে দু'টুকরো হয়ে দুটো মাঝারি সাইজের পরমাণু তৈরি করে আর তৈরি করে কিছু অতিরিক্ত নিউট্রন। এই নিউট্রনগুলো আরো কিছু তেজস্ক্রিয় পরমাণুকে আঘাত করে চেইন রিয়্যাকশন শুরু করে। ইউরেনিয়াম-২৩৫ এরকম একটি মৌল যা ফিশন বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। এই পদার্থটির ১ গ্রাম পরিমাণ থেকে ফিশন প্রক্রিয়ায় একদিনে ১ মেগাওয়াট শক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে ফিশনের থেকে বেশী শক্তি পাওয়া যায় ফিউশন বা গলন বিক্রিয়ায় যেখানে হাল্কা মৌল গলে গিয়ে তৈরি করে মাঝারি মৌল। ৪টি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলিত হয়ে ১টি হিলিয়াম তৈরি করে আর তৈরি করে প্রচুর শক্তি। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রে এই বিক্রিয়াই প্রতিনিয়ত চলছে। সূর্যের অভ্যন্তরে প্রতি সেকেন্ডে ৪০ লক্ষ টন পদার্থ শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

সামান্য জিনিস থেকে যখন বিপুল শক্তি পাওয়া যায় এবং তার থেকে কোনো কার্বন-ডাই-অক্সাইডও নির্গত হচ্ছে না, তখন সেই উৎস তো বিজ্ঞানীদের কাছে আকর্ষণীয় হবেই। কিন্তু সমস্যা হলো নিউক্লিয় চুল্লির সেফটি নিয়ে। নিউক্লিয় বিক্রিয়ায় নিঃসৃত গামারশ্মির বিকিরণ অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় ও ক্ষতিকারক এবং এর পারমাণবিক বর্জ্য দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যসমস্যার সৃষ্টি করে। চেরনোবিলের ভয়াবহ বিষ্ফোরণ এবং সাম্প্রতিকালে জাপানের ফুকুশিমায় যে মানবিক বিপর্যয় হতে যাচ্ছিল তা মানুষের মনে একটা আতংকের সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ ছাড়া আর কোনো উৎসই আমাদের নিকট-ভবিষ্যতে ২০০০ মেগাওয়াট বা তার বেশী শক্তি দিতে পারবে না। যেটা সম্ভব হলে আমাদের কালকেই দরকার, অত্যন্ত আশু প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলি তাদের উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে পারমাণবিক বিদ্যুৎই ব্যবহার করেছে। কারণ উন্নত বিশ্বের শহরগুলো এতোটাই এনার্জি-হাংরি যে আর কোনো উৎসই তাদের এই উৎকট শক্তি-ক্ষুধার ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে অপরাগ। সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তো শক্তি লাগবেই। আপনি নিজেই বিবেচনা করুন দেশপ্রতি রিয়্যাক্টরের সংখ্যা দেখে – জাপান (৫৩), জার্মানি (১৭), দ. কোরিয়া (২০), ভারত (১৭), ফ্রান্স (৫৯), দ. আফ্রিকা (২), স্পেন (৮), যুক্তরাজ্য (১৯), কানাডা (১৮), যুক্তরাষ্ট্র (১০৪), মেক্সিকো (২)। ইউরোপিয় ইউনিয়নভুক্ত অধিকাংশ দেশ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ছোট দেশেই আছে ২০টি রিয়্যাক্টর। কী পরিমাণ শক্তি তাদের দরকার, ভাবা যায়! এই সব উন্নত দেশ, বিশেষ করে জার্মানি, কিন্তু উন্নতির পথে পরমাণুর শক্তিতেই ভরসা রেখেছে। যথেষ্ট উন্নত হবার পর এখন তারা অন্য উৎসের কথা ভাবছে। আমাদের এমনই অবস্থা, তাতে নবায়নযোগ্য শক্তির যথাযোগ্য বিকাশ লাভ পর্যন্ত হয়ত অন্ধকারেই থাকতে হবে।

প্রকৃতি তার নক্ষত্রসমূহে পরমাণু শক্তিকেই ব্যবহার করছে, বিজ্ঞান আমাদের এই শক্তিকে চিনিয়ে দিয়েছে। এখন প্রকৌশলবিদ্যা আর প্রযুক্তির কাজ হবে এই শক্তি ব্যবস্থাকে কীভাবে আরো দক্ষ ও নিরাপদ করা যায়। এমন নয় যে এই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সীমা আমরা ছুঁয়েছি। প্রচুর গবেষণা করলে অবশ্যই এই শক্তিকে আমরা আরো শান্তিপূর্ণ ও দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারব।

আামদের দেশে রূপপুর পরমাণু প্রকল্প আমাদের বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। দেশীয় পরিস্থিতিতে ঘন জনবসতি, ভূমিকম্প, ঝড় ও বন্যা পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের অন্তরায়। কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প শক্তির উৎস কিন্তু খুব বেশী নেই। অপেক্ষাকৃত কম খরচে, অধিকতর দক্ষতায়, সামান্য পদার্থ থেকে এতো বিপুল শক্তি আমরা আর কোথাও থেকেই পাই না। কিন্তু এর থেকে বিপদটাও কম নয়, যদিও প্রাযুক্তিক গবেষণা একে অনেকখানি কমিয়ে রাখতে সক্ষম। পার্শ্ববর্তী দেশেও তো একাধিক রিয়্যাক্টর আছে, কোনো কারণে সেখানে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লে আমরাও কিন্তু সমানভাবে আক্রান্ত হব – তেজস্ক্রিয়তা তো আর পাসপোর্ট মেনে চলবে না! কাজেই নিজের দেশে পরমাণু চুল্লি না রেখেও কিন্তু আমরা খুব একটা নিরাপদ নেই! পাশের দেশকে তো আর আমি বলতে পারিনা যে তোমার উন্নয়ন বন্ধ রাখো। পরমাণু বিদ্যুৎ কিংবা বিকল্প বিদ্যুতের উৎস খোঁজার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসও খুঁজতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে নেপালের প্রচুর জলবিদ্যুতের সম্ভাবনাকে (শোনা যায়, এই 'সম্ভাবনা' প্রায় ৪০,০০০ মেগাওয়াট!) কাজে লাগানো যেতে পারে।

কিন্তু পরমাণুর অন্দরমহলে শক্তির যে অফুরন্ত ভান্ডার আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকা বোকামিই হবে। কেননা আমাদের সামনে দুটি মাত্র বিকল্প আছে – হয় সুইচ টিপব-আলো জ্বলবে-পাখা ঘুরবে, নচেৎ প্রদীপ ও হারিকেন জ্বালিয়ে নিওলিথিক অন্ধকারে আলোহীন নগরে বসে 'ডিজিটাল বাংলাদেশের' দূরাগত স্বপ্ন দেখতে হবে।

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী : বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।