কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও পরিবেশ-ভাবনা

দানেশ মিয়া
Published : 29 April 2016, 09:56 AM
Updated : 29 April 2016, 09:56 AM

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনায় যে কোনো সচেতন নাগরিক বিচলিত ও মর্মাহত হয়েছেন। প্রতিদিন নানা ঘটনায় অনেক মানুষ প্রাণ দেয়। কেন প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ, তা ভাবার ফুরসত সব সময় আমাদের থাকেও না। কিন্তু বাঁশখালীর ঘটনায় অনেকেই থমকে দাঁড়িয়েছেন।

বিদ্যুৎ বাংলাদেশের ব্যাপক চাহিদার একটি। এর চাহিদার প্রবৃদ্ধিও বিদ্যুদ্বেগে বাড়ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে সরকারও মরিয়া। সাধারণত বিদ্যুতের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তির উৎপাদনে সরকারের প্রচেষ্টায় জনগণের বিরুদ্ধাচারণ করার কথা নয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশের কী কী ক্ষতি করতে পারে তা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পূর্বেই জনগণের বোধে আসা এবং ক্ষোভে ফোঁসে ওঠা, সরকারি বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ লড়াইয়ে লেগে পড়া– বিষয়গুলো ভাবিয়েছে।

দৈনন্দিন জীবনে জ্বালানি শক্তির ব্যবহার আমাদের সভ্যতা বিকাশের পক্ষে কাজ করছে। এই শক্তি মানুষের জীবন সহজ ও সাবলীল করার পাশাপাশি পরিবেশের উপরও ক্ষয়ক্ষতির ছাপ রেখে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা জানি, বায়ুমণ্ডলে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস তথা কার্বন-ডাই-অক্সাইড বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। জ্বালানি শক্তির ব্যবহারই এর মূল কারণ।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানি শক্তি ব্যবহার করতে হয় এবং সে জন্য যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, তা শক্তি-সম্পর্কিত মোট নির্গমনের প্রায় ৪০ শতাংশ। জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে কয়লা, যা মোট শক্তি ব্যবহারের প্রায় ২৩‍‌‌ শতাংশ। সমগ্র পৃথিবীতে ১৯০০ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত মূলত কয়লাই শক্তির প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানেও কয়লাই হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য উৎস।

২০০৭ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ৫০ হাজারেরও অধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর বিদ্যুৎ চাহিদা ৬০ শতাংশ বাড়বে বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে বিদ্যুতের চাহিদা মিটানোর জন্য কয়লাই হচ্ছে প্রথম পছন্দ।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখনও চীনে ৭৫ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ চাহিদা মেটায়। বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ২.৫ শতাংশ কয়লা থেকে আসে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ দামে সবচেয়ে সস্তা হওয়ায় এখনও পৃথিবীর অনেক দেশ এ রকম বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী প্রতিদিন ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ নতুন করে সংযুক্ত হয়েছে।

তথাপি, পরিবেশের ক্ষতির কথা ভেবে অনেক উন্নত দেশ কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস করছে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে তা বন্ধ করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। যেমন, ২০০৯ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ১৩৮টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ২০২৫ সালের মধ্যে তার কয়লাভিত্তিক সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিবে বলে পরিকল্পনা নিয়েছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতেও উন্নয়নশীল দেশগুলো বরং এ রকম বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এগিয়ে যাচ্ছে।

শক্তির উৎস ব্যবহারে পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতার ক্রম সাজালে যথাক্রমে পাওয়া যায় প্রাকৃতিক গ্যাস, মিথানল, ইথানল, তেল, কয়লা, চারকোল ও কাঠ। প্রথম উৎসটি পরিবেশের উপর প্রভাব বিবেচনায় তুলানামূলকভাবে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন। গবেষণায় দেখা গেছে, বায়োমাস, কয়লা, পারমাণবিক শক্তি, প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবেশগত ঝুঁকি আছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। পরিকল্পনা ও খরচের ঝুঁকি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বায়ু-দূষণের প্রভাব, ভূমি ও পানির উপর প্রভাব বিবেচনা করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অধিক পরিমাণে কার্বন-ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, বিষাক্ত ভারী ধাতু মারকারিসহ বিবিধ ক্ষতিকর কণা নিঃসরণের জন্য দায়ী। নাইট্রোজেন ও সালফারের অক্সাইডগুলো বায়ুমণ্ডলে গিয়ে সালফিউরিক এসিড ও নাইট্রিক এসিড তৈরি করে, যা বৃষ্টির মতো ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে, যাকে আমরা এসিড-বৃষ্টি বলি। এই এসিড-বৃষ্টি জীবদেহে ও কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

কয়লা শুধু পোড়ালেই যে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তা নয়, বরং কয়লা পরিবহনের সময়ও তা হতে পারে। সাধারণ হিসাবে বাঁশখালীতে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য প্রতি ঘণ্টায় ১০৫৬ টন কয়লা ব্যবহার করতে হবে যা প্রতি বছরের হিসেবে ৭.৯২ মিলিয়ন টন।

এই বিপুল পরিমাণ কয়লা খনি থেকে বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত সরবরাহ করা বিরাট একটি কর্মযজ্ঞ। অসতর্কভাবে কয়লা সরবরাহ করলে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং মিথেন নির্গত হতে পারে। এগুলোর মধ্যে কার্বন মনোক্সাইডের তাৎক্ষণিক প্রভাব হিসেবে মানবদেহের রক্তসংবহনতন্ত্রে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে তাপীয় দূষণ (থার্মাল পলিউসন) বড় একটি ঝুঁকি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পানির ব্যবহার করতে হয়। ব্যবহৃত গরম পানি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় না এনে পার্শ্ববর্তী কোনো জলাশয়ে ফেললে পানিতে অক্সিজেনের দ্রাব্যতা কমে যায়, পানির স্বাভাবিক ঘনত্বের পরিবর্তন হয়। এতে জলজ জীবের বৃদ্ধি ও প্রজননে ব্যাঘাত ঘটা এবং জলজ জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ বা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই জলজ জীব বিপদে পড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে থার্মাল পলিউশন পানির তাপমাত্রা ৯-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়িয়ে দিলে জলজ জীবের কী অবস্থা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে। ছয় বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬.২ শতাংশ থেকে ৬.৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে, যা একটি স্বাভাবিক উন্নয়নশীল দেশের জন্য কাম্য। আমরা জানি, একটি দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত উন্নয়ন ও পরিবেশের ঋণাত্মক সম্পর্ক কাজ করে। প্রদর্শিত স্কেচটি দেখলে বুঝা যাবে যে, বাংলাদেশ যতই মধ্যমেয়াদী আয়ের দিকে এগুচ্ছে, ততই পরিবেশের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। একটি দেশের উন্নয়ন-পরিবেশ সম্পর্কের এই রেখাই বলে দেয় পরিবেশসম্মত উন্নয়ন অর্জন আমাদের জন্য আরও অনেক দূরের বিষয়।

অর্থনীতির দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য বিদ্যুৎ একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তথ্যে দেখা যায়, মার্চ ২০১৬ তে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৪,৪২৯ মেগাওয়াট, কিন্তু উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ৮,১৭৭ মেগাওয়াট। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৩৭১ কিলোওয়াট-ঘণ্টা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ গত ১০ বছর আগে যা ছিল, তা বর্তমানে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৬ ভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।

তদুপরি, বাংলাদেশ এখনও শক্তি ব্যবহারের দিক দিয়ে পৃথিবীর মধ্যে দরিদ্রতম। কয়লা পরিবহন ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এর ব্যবহারে বায়ু, মাটি ও পানিতে কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে, তা ভেবে যদি বাঁশখালীর জনগণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করার জন্য আন্দোলন করে থাকে, তাহলে সরকারের তো খুশি হবারই কথা। কারণ বর্তমান সরকার জ্ঞানভিত্তিক সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষাসহ অনেক নদ-নদী শিল্প ও কল-কারখানার বর্জ্যে অনেক আগেই দূষিত নদীতে পরিণত হয়েছে। প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলের ফলে নদ-নদী, খাল-বিল প্রাকৃতিক অবস্থান হারাচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের হালদা ও কর্ণফুলীও সে পথ ধরেছে। এক পশলা বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম নগর জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

লক্ষণীয়, এসব পরিবেশগত বিপর্যয় দূর করার জন্য কাউকেই মরণপণ আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। তাহলে কী করে বুঝব যে, বাঁশখালীর ঘটনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ পরিবেশগত সচেতনতার পথ ধরে মরনপণ আন্দোলন করেছে? বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েও আমরা জনগণের পরিবেশ-সচেতনতার স্ফূরন দেখিনি। অথচ, ইতোমধ্যেই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক রিপোর্টে পরিবেশের বিরূপ প্রভাবের সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ নিয়েও আমাদের একই রকম আশঙ্কা আছে।

জনগণের পরিবেশ সচেতনতাও অনেকগুলো নিয়ামক নিয়ন্ত্রণ করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রচেষ্টা। বিভিন্ন শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু যে কোনো পরিস্থিতিতেই স্বতঃস্ফূর্ততা কাম্য, সেটা আন্দোলনের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত না হলে, সেখানে ঘোলা জলে মাছ শিকার করার একটা পাঁয়তারা আছে বলে ধরে নিতে হবে। সে রকম পরিস্থিতি কখনও জনগণের পক্ষে যায় না।

পরিবেশসম্মত উন্নয়নের সুযোগ পাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। পরিবেশ বাঁচানোর জন্য সংশ্লিষ্ট জনগণ আন্দোলন না করলেও, রাষ্ট্রের দায়িত্ব পরিবেশ সংরক্ষণ করে উন্নয়ন সাধন। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে পরিবেশ রক্ষায় রাষ্ট্রের উপর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বণ্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন'।

দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প নেই। বাঁশখালীর প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও সে রকম একটি উন্নয়ন-প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টায় জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের পরিবেশ-ভাবনা যথার্থ। কিন্তু উন্নত দেশের মতো সম্পূর্ণ পরিবেশসম্মত উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জও বটে।