লেখক মনে করছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র দখল কায়েমের প্রক্রিয়াটি বর্তমান শাসনামলে পরিপূর্ণ রূপ নিয়েছে।
Published : 21 Feb 2023, 09:47 PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে যেসব ছাত্র সংগঠন রয়েছে, সেগুলোকে আজকাল মূল রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন না বলে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’ হিসেবে বর্ণনার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাতে ছাত্র রাজনীতির হালচাল মোটেও বদলাচ্ছে না।
আর ছাত্র রাজনীতি বলতে এখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের রাজনীতিকেই বোঝানো হয়ে থাকে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসহ যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির সুযোগ রয়েছে, সেখানে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের একচ্ছত্র তৎপরতাই লক্ষ করা যায়। নিজেদের সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সংযুক্ত ছাত্র সংগঠনটি ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস ও ক্যাম্পাসের দখল নিয়ে ফেলে। অতঃপর যা করার- করতে শুরু করে তারা।
অনেক ক্ষেত্রে দখলদারির পালাবদলটা শান্তিপূর্ণভাবেই হয়ে থাকে। প্রতিপক্ষ সংগঠন তো জানে, তারা দখল বজায় রাখতে পারবে না। কেননা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে ‘প্রশাসন’ বলতে যা বোঝায়, সেটা আর তাদের সঙ্গে নেই।
যাহোক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র দখল কায়েমের প্রক্রিয়াটি বর্তমান শাসনামলে পরিপূর্ণ রূপ নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন কোনোভাবেই কার্যক্রম চালাতে পারছে না। অন্যান্য ছাত্র সংগঠন- যাদের তেমন ক্ষমতা বা প্রভাব নেই কিংবা প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় যারা নেই, তারা কিছু কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা অবশ্য করে থাকে। সময়ে সময়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটি দমন-পীড়ন চালিয়ে তাদের তৎপরতার সীমানাটাও দেখিয়ে দেয়। এ অবস্থায় শিক্ষাঙ্গনে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন আবার জড়িয়ে পড়ে আত্মকলহে। এর কারণ সংগঠনে কোনো মতাদর্শিক বিরোধ নয়; বরং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বখরাবাজি ইত্যাদি।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ প্রশাসনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তেও দেখা যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এ দু পক্ষকে আলাদা করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের দুষ্কর্মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রশ্রয়, এমনকি সহযোগিতা দেখা যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং তাতে নিবিড়ভাবে জড়িত শিক্ষকদের একাংশ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত হয়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে। আর এটা স্পষ্টভাবেই শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছে গোটা পরিস্থিতিকে। এতে যে শিক্ষার পরিবেশ ও মানের মারাত্মক অবনতি ঘটছে, তা অস্বীকারের সুযোগ নেই। এর পেছনে সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা আছে বলেই প্রতীয়মান।
কথাগুলো নতুন এবং আরও স্পষ্ট করে বলতে হচ্ছে এজন্য যে, বেশ ক'বছর ধরে ছাত্রলীগের ভেতর থেকে দেশের অনেক শিক্ষাঙ্গনে এমন সব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে যে, সেটা সব রেকর্ড ভেঙে নাগরিকদের কল্পনাকেও হার মানাচ্ছে। সম্প্রতি একইসঙ্গে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের একশ্রেণীর নেতাকর্মী এমনকি সাধারণ ছাত্রছাত্রীর ওপর তাদের মতো করে অভিযোগ তুলে যেসব অবমাননা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে- তেমন ধরন ও মাত্রার ঘটনা আর কখনো ঘটতে দেখা যায়নি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা যেসব ঘটিয়েছে, সেগুলো উদ্বেগজনক শুধু নয়; দেশের জন্য লজ্জাজনক।
ছাত্রলীগের নারী নেতাকর্মীদের একাংশ ইতোপূর্বেও অন্যের ওপর, এমনকি নিজেদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে আলোচিত হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলের 'গণরুমে' সংঘটিত ঘটনা সেগুলোকেও হার মানায়। এ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা হলে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ঘটনা তদন্তে কাদের নিয়ে কমিটি গঠনপূর্বক রিপোর্ট পেশ করতে হবে এবং কেমন শর্তে তদন্ত চালাতে হবে, সে নির্দেশনা দিয়েছেন। তারা মন্তব্যে বলেছেন- ঘটনাটি ‘এলার্মিং’।
যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনেরই তাতে হস্তক্ষেপ করে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কথা। বোধগম্য কারণে তা হচ্ছে না বলেই উচ্চ আদালতকে এমন উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী বলে অভিহিত করে বা সেরকম ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনাও কম উদ্বেগজনক নয়। জামায়াতে ইসলামী বা তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরকে তো এখনো নিষিদ্ধ করা হয়নি। আর নিষিদ্ধ হলেও কাউকে তাদের কর্মী বলে সন্দেহ বা চিহ্নিত করে নির্যাতন করাটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো ছাত্র সংগঠন বা তার কোনো অংশকে এমন ক্ষমতা কেউ দেয়নি। এটা আইনসম্মত নয়। অথচ অনেকদিন ধরেই এসব এমনভাবে ঘটছে, যেন এর একটা বৈধতা রয়েছে।
নির্যাতনের পর নির্যাতিতকে আবার তুলে দেওয়া হচ্ছে পুলিশের হাতে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চারজন ছাত্রকে এ প্রক্রিয়াতেই রাতভর নির্যাতন করে তাদের দুজনকে পাঠানো হয়েছে আইসিইউতে। ভাগ্য ভালো, এক্ষেত্রে কাউকে বুয়েটে একইভাবে নির্যাতিত হয়ে নিহত আবরার ফাহাদের ভাগ্য বরণ করতে হয়নি। বুয়েটের ওই ঘটনায় সবাই এত বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, ঘটনাটির তদন্ত ও বিচার করতে হয়।
ওই নির্যাতনে জড়িত ছাত্রলীগ সদস্যদের কয়েকজনের ফাঁসির আদেশ পর্যন্ত হয়েছে। তারপরও একই ধরনের ঘটনা ঘটাতে ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মীর হাত কাঁপছে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় আবার দেখা যাচ্ছে, তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছাত্রের ব্যাপারে বরং আরো আক্রমণাত্মক এবং বলছে যে, বাংলা নামের বলে ছাত্রটিকে মেরে ফেললেও কিছুই যাবে আসবে না। তাকেও কিন্তু ভুল করে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে নির্যাতনের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল।
গত এক দশক বা এক যুগে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের হাতে সংঘটিত শত শত অপরাধের ঘটনার উল্লেখ এখানে করা যাবে এবং দেখা যাবে, এর একটি 'প্যাটার্ন' রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই অবশ্য দুটি কথা বলা হয়ে থাকে ছাত্রলীগ এবং এর মূল সংগঠনের ভেতর থেকে।
প্রথমত বলা হয়, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং অভিযোগ পাওয়া গেলে সব ঘটনারই তদন্ত ও উপযুক্ত শাস্তি বিধান করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত উল্লেখ করা হয়ে থাকে ছাত্রলীগের অতীত গৌরবময় ভূমিকার কথা। ১৯৪৮ সালে এমনকি আওয়ামী লীগেরও আগে ছাত্রলীগের জন্ম এবং স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে এ সংগঠনের ভূমিকা তো কেউ অস্বীকার করে না। এমনও বলা হয়ে থাকে, ছাত্রলীগ তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে মূল সংগঠন আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ধারায় জড়িয়ে রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এসব বলে পরবর্তীকালে সংগঠনটির যে চরিত্র বদল হয়েছে, তা কি আড়াল করা যাবে?
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ কী ভূমিকা রেখে চলেছে এবং বিশেষত বর্তমান শাসনামলে কী রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে, সেটা তো কারো অজানা নয়। এ নিয়ে আলোচনাও কম হয়নি। মাঝে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকার কথা বলেও তার এখনকার কর্মকাণ্ডকে আড়াল করা যাবে না। ক্ষমতার সঙ্গে একইভাবে সম্পর্কিত থেকে তার প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অতীতে কখন কী করেছিল, কী সব অপরাধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল- সেসব বারেবারে উল্লেখ করেও কি ছাত্রলীগের এখনকার অপরাধকে বৈধতা দেওয়া বা হালকা করে দেখানো যাবে? আমরা এমনও দেখেছি, সাধারণ ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা স্বতঃস্ফূর্ত ও জনসমর্থনধন্য আন্দোলন দমনেও ছাত্রলীগ ‘ক্যাডাররা’ ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটার পক্ষে আবার সাফাই গেয়েছে। এ নিবন্ধ তৈরির দিনও সংবাদপত্রে খবর রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি নতুন ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের একাংশ। এমনভাবে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব ঘটাচ্ছে, যেন সে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের।
এর পেছনে রয়েছে শুধু শিক্ষাঙ্গন নয়, বরং সারাদেশে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম এবং তা ধরে রাখার চেষ্টা। এর সঙ্গে ছাত্র ও যুব নেতৃত্বের সহজে অর্থবিত্ত বানানোর প্রবণতারও সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমরা দেখেছি, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নমূলক কাজের ওপর চাঁদাবাজির চেষ্টা ঘিরে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে একযোগে সরিয়ে দেওয়া হয় তাদের পদ থেকে। মাঝে এ সংগঠনের কর্মকাণ্ড মূল রাজনৈতিক দলের জন্যও এতটাই বিব্রতকর হয়ে পড়ে যে, তাদের কাজ কিছুদিন স্থগিত রাখতে হয়েছিল।
তাতে অবশ্য ছাত্রসমাজের কোনো ক্ষতি হয়নি, কারণ ছাত্রলীগ বা এ ধরনের সংগঠন কোনোভাবেই আর সাধারণ ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করছে না এবং সেটা অনেকদিন ধরে। এমন আশাবাদেরও কোনো সুযোগ নেই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদল হলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনটি শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। কোনোভাবে কোনো ইতিবাচকতা এলে সেটা নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে। তবে আপাতত এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। আসলে ভ্রাতৃপ্রতিম বা অঙ্গ সংগঠন যাই বলা হোক- অবক্ষয়প্রাপ্ত জাতীয় রাজনীতির সরাসরি প্রভাবেই ছাত্র সংগঠনের এমন চরিত্র দাঁড়াচ্ছে। তারাও মূল দলের ‘ফুট সোলজার’ বা লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সানন্দে। অবস্থাটি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এর ফলস্বরূপ ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে বিরক্তি ইতোমধ্যে তীব্র এবং অনেকে এটা বাতিলেরও পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। সেটা শেষ পর্যন্ত ঘটবে কিনা, তা বলা মুশকিলের। তবে এমন দাবি উঠে যাওয়ার পেছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বড় ভূমিকা রাখা ছাত্রলীগের যে বিরাট ‘অবদান’ রয়েছে, তা অস্বীকারের সুযোগ নেই।