বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর এখন পুরো দেশ। সব মানুষ। সংস্কারের আশা সবখানে।
Published : 18 Sep 2024, 07:28 PM
তুমুল এক ছন্নছাড়া সময় পার করছে বাংলাদেশের মানুষ। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী দোলাচলে চিন্তার পরিসর জুড়ে আসছে কতশত প্রশ্ন। আইনশৃঙ্খলা, নির্বাচন, শিক্ষা ব্যবস্থা, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা– সব মিলিয়ে শত ভাবনা-দুর্ভাবনা বোধের চৌকাঠে এখন। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার স্বাদ পেতে মরিয়া, অন্তর্বর্তী সরকার আছে সংস্কার নিয়ে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যার সমাধান-কৌশল নিয়ে কাজ করছেন তারা। তাদের হাতে তো কোনো কোন জাদুর চেরাগ নেই। রাতারাতি সব পরিবর্তনের সুযোগও নেই। তারা সময় চাইছেন, জনগণকে আশা দিচ্ছেন, ধৈর্য্য ধারণ করতে বলছেন।
সাধারণ মানুষ আশায় আছে আলোর, কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে পথ রোধ করে দাঁড়ায় অন্ধকার। হাত বাড়ায় গোলাপের দিকে, কাঁটা এসে লাগে। সুন্দরের প্রার্থনা করে সকাল-সন্ধ্যা, দস্যু এসে দাঁড়িয়ে যায় দুয়ারে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর এখন পুরো দেশ। সব মানুষ। সংস্কারের আশা সবখানে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের রেশ এখনো কাটেনি। একদিকে অন্তর্বতী সরকারের প্রাণপণ প্রচেষ্টা অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আকাশ সমান প্রত্যাশার চাপ। মাঝখানে আছে সুযোগসন্ধানীদের লম্পজম্প।
ফলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অস্থিরতা। ঘরে, বাইরে, অফিস-আদালতে, হাটে-বাজারে, মসজিদে-মন্দিরে, স্কুলে-ইউনিভার্সিটিতে– কোথাও স্বস্তি নেই। উবে যাচ্ছে যেন সহিষ্ণুতার শীতল ছায়া। ভেঙে পড়ছে প্রীতি-সম্প্রীতির বন্ধন। সবখানে কেবলই আগুন, কেবলই দগ্ধতা, কেবলই ক্ষত। শিক্ষাঙ্গনে এখনো স্বাভাবিকতা আসেনি। গতি ফিরেনি আইনশৃঙ্খলায়, অফিসপাড়ায়। পুলিশ আছে, পুলিশ নেই। ট্রাফিক আছে, ট্রাফিক নেই। ভাঙছে মন্দির, ভাঙছে মাজার। সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল তর্ক-বিতর্ক। কে কাকে বিশ্বাস করবে! দিনভর নানা খবর ভেসে বেড়ায় স্ক্রিনে। তবু আঙুলের ছোঁয়া বিশ্বস্ত লাগে না। মানুষে মানুষে বাড়ছে দূরত্ব, ক্ষোভ, ঘৃণা। প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের এক উন্মাদ স্পৃহা যেন সবখানে। তুমুল একা হয়ে যাচ্ছে মানুষ!
পৃথিবীতে অভ্যুত্থানের ইতিহাস ঘাটলে এমন চিত্র খুব অচেনা লাগে না। একটি বিপ্লবের পর গণমানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ডালপালা মেলে। দীর্ঘদিনের ছাইচাপা আগুন ফুলকি হয়ে উড়ে। বাগানের সব ফুল তখন শুধু লালরঙা মনে হয়। মানুষের আশা-ভরসা চৌহদ্দি মানে না তখন। স্বপ্ন দুলতে থাকে। বর্তমান দুলছে। ভবিষ্যৎ দোদুল্যমাণ। কী যে করি, কী যে করি– এই ভাবনায় সকাল গড়িয়ে সূর্য অস্ত যায়। তবু কূল মিলে না।
ইতিহাসের প্রথম ছাত্র আন্দোলন হয় চীনে, ১৬০ খ্রিস্টাব্দে। ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। আমরা ফরাসি বিপ্লব ও বোহেমিয়ান বিদ্রোহের কথা জানি। ১৮৪৮ সালের বোহেমিয়ান বিদ্রোহের সময়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে এক অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই আন্দোলনের কথাও ইতিহাসে আছে। তারা 'হোয়াইট রোজ' নামের একটি গ্রুপ গঠন করেন এবং নাৎসি শাসনের নির্মমতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য লিফলেট বিতরণ শুরু করেন। এভাবে ইতিহাসের পথে-প্রান্তরে ঘুরলে, আমাদের ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী অভ্যুত্থানের পাশাপাশি গ্রিনসবোরো অবস্থান ধর্মঘট, দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন, ভেলভেট রিভল্যুশন এবং খুব সাম্প্রতিককালের আরব বসন্তের কথা পাই। সবগুলো আন্দোলনের একটি অভিন্ন জায়গা হলো, মানুষের মনোজগতের বিপুল আকাঙ্ক্ষা। অনেক কিছুই তখন মানুষ করে ফেলতে চায়, ভেতরে ভেতরে এক অস্থির মানুষ হয়ে ওঠে তখন তারা।
বস্তুত, শাসকের বিরুদ্ধে জগদ্দল পাথরের মতো জমে থাকা আপামর জনতার ক্ষোভ যখন বাধ ভাঙে, তখন এ স্রোতের সামনে দাঁড়াবার শক্তি আর থাকে না। এ জল তখন নতুন আশ্রয়, নতুন নদী চায়, নতুন সাগর চায়। আমাদের জুলাই-অগাস্ট বিপ্লবের পরও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। সংস্কার চায় সবাই। পরিবর্তন চায়,নতুনত্ব চায়। রিকশা চালক থেকে সচিব, ব্যবসায়ী থেকে 'পাগল' সবার দাবীর জোয়ারে ভাসছে দেশ। প্রত্যেকেই তার স্বপ্নের মতো দেশ চায়। এ চাওয়া খুবই স্বাভাবিক, এ চাওয়ায় কোন ভুল নেই। মানুষ তার অধিকার তো চাইবেই, তার ন্যায্যতার কথা বলবেই। তাছাড়া বাধা বিপত্তিহীনভাবে বলতে পারার এ সুযোগ নেবেই না কেন!
এদিকে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মাত্র মাস দেড়েক অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়টা দেশের চলমান পরিস্থিতিকে অনুধাবন করার জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। জেন-জির ক্ষোভ তো শুধু আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে নয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার বিরুদ্ধে ছিল এ লড়াই। এ ক্ষোভ, প্রতিবাদ ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার বদ্ধমূল ধারণার বিরুদ্ধে, ক্ষমতার অচলায়তনের বিরুদ্ধে, দেশের প্রতিটি জায়গায় জমে থাকা অনিয়ম, অপশাসন আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে। ফলে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়টা আমাদের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে প্রত্যাশা নিয়ে পরিবর্তন শুরু হলো সে প্রত্যাশা যদি চলমান আলো-আঁধারের দ্বন্দ্বে হোঁচট খায় তবে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
এটা বলা বাহুল্য যে, চলমান সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করছে। যে তারুণ্য জীবনবাজি রেখে লড়েছে জুলাই অভ্যুত্থানে, পারিপার্শ্বিক অবস্থায় তারাও হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। বিভেদ দেখা দিচ্ছে নানান জায়গায়। ঐক্যের জায়গায় ভাঙনের অশনিসংকেত শোনা যাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি এখনো টালমাটাল অবস্থায়। এখনো আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যশূন্যতাসহ প্রশাসনিক সংকট চলছে। পাঠদান শুরু না হওয়ায় উঁকি দিচ্ছে সেশনজটের আশঙ্কা। প্রাথমিক, মাধ্যমিকের কারিকুলামে সংস্কার হয়েছে কিছু, সে সংস্কারের বাস্তবায়নে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষক এবং অভিভাবকরা। মামলা, হামলা, জবরদখল, দাবি-দাওয়া সবকিছু নিয়ে প্রকাণ্ড হুলস্থুল চলছে। স্বস্তি নেই কোথাও। রিকশাচালক থেকে পাগল-ফকির সবাই দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার। পথে বেরুলেই কোন না কোন আন্দোলনের দৃশ্য চোখে পড়ে। রাতারাতি সবকিছু পেয়ে যাওয়ার এক অলীক আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠছে মানুষের মনে। বিশেষ করে, তরুণ শিক্ষার্থীরা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। নিজেদের অসীম ক্ষমতাবান ভাবার, যা ইচ্ছে তাই করে ফেলার এক উন্মাদ, অসুস্থ মানসিকতা তাদের গ্রাস করছে ক্রমশ।
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শান্তি ও সহিষ্ণুতার চর্চা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। পরিবার থেকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এ পাঠ শুরু করতে হবে। সমাজে স্থিতিশীলতা তৈরিই আজকের বড় চ্যালেঞ্জ। মুক্তচিন্তার সুধীজনকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সবার দায়িত্ব রয়েছে। শুধু বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। পাড়া-মহল্লায় যুব সমাজকে সংগঠিত হয়ে শান্তি, শৃঙ্খলা স্থাপনে কাজ করতে হবে। সংকট নিরসনে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত সংলাপ কিংবা ভাবনা বিনিময়ের আয়োজন স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গ্রাম পর্যায়ে হতে পারে উঠান বৈঠক। রাতের খাবার টেবিল হতে পারে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও পরমত সহিষ্ণুতার পারিবারিক ক্লাস। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসতে পারে ধর্মীয় উন্মাদনা নিরসনে প্রীতিময় উদ্যোগ নিয়ে। উপাসনালয়গুলো হাত বাড়াতে পারে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রথম ক্লাসটিই হতে পারে পরমত সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার পাঠ নিয়ে। আমাদের গণমাধ্যমগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। গঠনমূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করতে পারে। সত্যি কথা হলো, যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে না আসলে আমাদের এগুনোর পথ মসৃণ হবে না।