Published : 10 Oct 2021, 03:18 AM
বিলেতে আমার দ্বিতীয় যাত্রা বহুদিক থেকেই আমাকে সমৃদ্ধ করছে। আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে (সোয়াস) কলোনিয়ালিজমের ওপর একটি সেন্টার আছে যা একাডেমিক দিক থেকে পাশ্চাত্যের পুরনো এবং বনেদী প্রতিষ্ঠান, যা ঔপনিবেশিকতা নিয়ে পড়ায়, প্রশ্ন করে, চিন্তা বা, গবেষণা করায়।
সোয়াস, উপমহাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে ব্রিটেনের একটি অগ্রসর গবেষণা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে ভারত, বাংলাদেশের ওপর অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, এমনকি বাংলা ভাষা নিয়েও পণ্ডিত আছেন। যারা কেউ কেউ শিক্ষক, শিক্ষক স্থানীয় আবার কেউ কেউ আমার অ্যাকাডেমিক পিয়ার। তাদের সাথে আলাপে, সংযোগে, চিন্তা বা, গবেষণা কিভাবে করতে হয়, নিজ বিষয়ে কিভাবে ও কোন ভাষায় লিখতে হয়, যুক্তিকে কিভাবে বিচার-গ্রহণ-বর্জন করতে হয়, শব্দ বাছাই এবং লেখায় তার প্রয়োগ করতে হয় ইত্যাদি জানার এবং বোঝার আমার বিস্তর সুযোগ হচ্ছে। আমার কিছু কিছু ছাত্রছাত্রী এটি নিয়ে আমার কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। উল্লেখ্য, যে এটি মূলত আমার অভিজ্ঞতার বয়ান। যা আমি শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত ভাষায়, তাদের প্রবণতাগুলোর সাথে মিলিয়ে উপস্থাপন করেছি। দু-একজনের সাথে আমার ফোনালাপ হয়েছে। এখানে কিছুটা বিস্তারিত আকারে দেয়া হলো। একেবারে প্রাথমিক জায়গা থেকে শুরু করেছি, যাতে সবার বুঝতে সুবিধা হয়:
১. কথা বা, লেখা এই দুইপ্রকারে আমরা নিজেদের চিন্তা প্রকাশ করি। অ্যাকাডেমিতে কথার চাইতে লেখার বিচার হয় বেশি; কারণ, এটাই অ্যাকাডেমিক সংস্কৃতি; কথা বলার সময় সাধারণত আমাদের প্রতিটি শব্দ নিয়ে আলাদা করে ভাববার সময় থাকেনা; কিন্তু, লিখবার সময় আপনি চাইলে প্রতিটি শব্দ, এমনকি দাঁড়ি, কমা নিয়ে পর্যন্ত বহুক্ষণ, বহুভাবে ভাবার সময় পান। তাই লেখার শক্তি বেশি এবং এর মূল্যায়ন প্রক্রিয়াও বেশ শক্ত। বিদ্যালয়ে, কথায় বড় হবার সুযোগ কম (এখানে শুধু কথা দিয়ে চিড়ে ভেজে না), বড়ত্বের প্রমাণ দিতে হয় কাজে, বা, সরলার্থে, লেখায়। আপনার লেখাই বলে দেবে আপনি চিন্তা করতে পারেন কিনা, বা, আপনার কাজগুলো হয় কিনা।
২. এমন কোন কাজের বিচার করার সময়, উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পরিসরে, সাধারণ বানান থেকে শুরু করে ব্যাকরণ হয়ে যুক্তি তথা প্রচলিত নানা তত্ত্ব, তথ্য ও মতবাদের ভিত্তিতে আপনার লেখার প্রতিটি বাক্য, শব্দ এমনকি দাঁড়ি, কমা পর্যন্ত মূল্যায়িত হতে পারে। বিদ্যালয়ে যত উপরের দিকে উঠবেন তত বানান, ব্যাকরণ এর গুরুত্ব ক্রমশ কমতে থাকে। কারণ, ধরে নেয়া হয় যে নিচের শ্রেণিগুলোতে আপনি এইসব বিষয়ে ইতিমধ্যে কৃতবিদ্য হয়ে গেছেন। উপরের দিকে বেশি গুরুত্ব পায়– আপনার বিষয় উপস্থাপনা, শব্দ বাছাই এবং প্রয়োগ, কোন বিষয়ে বিদ্যমান যুক্তি বা, বয়ানগুলো সম্পর্কে আপনার জানাশোনা, সেগুলোর সাথে আপনার যৌক্তিক এনগেজমেন্টের ধরন (আরো খুলে বললে, কে কে কী কী বলল তা কি শুধু আপনি সরলভাবে উল্লেখ করেই ক্ষান্ত দেন, নাকি নানা প্রতিযুক্তির নিরিখে ক্রিটিক্যালি এনগেইজ হতে পারেন)। পরিণত বুদ্ধিবৃত্তিকতার জগত, সরল চিন্তার জগত নয়; ওই জগতে যুক্তিসিদ্ধ, এবং প্রতিযুক্তি মোকাবেলায় সক্ষম লেখাই প্রশংসার যোগ্য। বাকিগুলো পরিত্যাজ্য।
৩. আমার এক ছাত্র তার এক লেখায় লিখলেন, 'বাঙালি একটি আইনপ্রেমী জাতি'। আইনের একটি সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে তার এই অকস্মাৎ নিয়ে আসা বাক্য আমাকে বেশ বিস্মিত করলো। জানতে চাইলাম, এই বাক্য ব্যবহারের কারণ কী? তিনি বললেন, স্যার আমরা কি আইনকে ভালোবাসি না! আমি বিস্মিত এবং কিছুটা হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আইনের প্রতি আমাদের প্রেম কোথায়, কবে দেখলেন? হ্যাঁ, আমরা মূলত আইন মানি; কিন্তু, সেটা পৃথিবীর অধিকাংশ জাতির বেলাতেই সত্য। আইন মানা বলা, আর আইনের সাথে প্রেম করা বলার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে। আইন যদিও ক্ষমতার খুব কাছের একটি বিষয় তারপরেও আইন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কখনো পড়েনি, কখনো জানেনি। কারণ তার প্রয়োজনই পড়েনি। সহজ করে বললে, বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ যারা আমাদের প্রায় ৯০ শতাংশ তারা নেহায়েত বিপদে না পড়লে কখনো আইনের দ্বারস্থ হন না। আমাদের পার্লামেন্ট প্রতি বছর যে গণ্ডায় গণ্ডায় আইন পাস করে, আমাদের গ্রামের কৃষক, শ্রমিকরা সেসব বিষয়ে কিছুই জানেন না। কারণ, তাঁদের জানার তেমন প্রয়োজন পড়েনা। পড়েনি কখনো। গ্রামদেশে কথায় কথায় মামলা দেবার কিছু মানুষ থাকে; যারা তাদের এই স্বভাবের জন্য হয়তো ভয় এবং সমীহ পান, কিন্তু, লোকে এই স্বভাবের কারণেই তাদের অপছন্দ করে। ঘন ঘন মামলা করা, আইনের আশ্রয় নেওয়াটি এখনো আমাদের দেশে একটা ট্যাবু। বাঙালির ইতিহাস দেখেন, আমরা যত আন্দোলন করেছি, তার অনেকগুলো আইন অমান্য করে, কোন কোন কালাকানুন বাতিলের দাবিতে। বাঙালির ইতিহাস আঁতিপাঁতি করে খুঁজলে, আইনের প্রেমে বাঙালি কোন আন্দোলন করেছে এমনটা পাওয়া অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিন। এই অবস্থায়, উনি যা লিখেছেন, অর্থাৎ, বাঙালিকে আইনপ্রেমী বলা, তা ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ হলেও, ঐতিহাসিকভাবে মিথ্যা, অনাবশ্যকভাবে বাজে কথা হয়েছে।
৪. মানুষের কমনসেন্সের সাথে মিলে যায়, কিন্তু, তাত্ত্বিকভাবে এবং এপিস্টেমোলজিক্যালি ভুল এমন কিছু বললে আপনি সহজে ধরা পড়বেন না। কমনসেন্সের সাথে মিলে গেলে লোকে সাধারণত সেই তথ্য আর খুঁজে দেখে না, যাচাই বা, ভ্যারিফাই করে না। এই জাতীয় কিছু ভুল আমি দেখেছি জুরিস্প্রুডেন্স নিয়ে। কেউ কেউ এমন বলেন, যে বৃষ্টি পড়া, গ্রীষ্মের গরম, চন্দ্র-সূর্যের আলো এগুলো হচ্ছে আইনের দর্শনে বহুল পঠিত প্রাকৃতিক আইন (Natural Law)। এটা লোকের কমনসেন্সের সাথে মিলে যায়। ফলে কেউ আর পড়েও দেখে না যে এইগুলো মারাত্মক ভুল। এই বিষয়গুলো হচ্ছে প্রকৃতির আইন (Law of Nature); জুরিস্প্রুডেন্সে প্রাকৃতিক আইন (Natural Law) বলতে এইগুলোকে বোঝানো হয় না। প্রাকৃতিক আইনের আলোচনার পরিসর মূলত (একমাত্র নয়) 'মানব প্রকৃতি' নিয়ে, যার কেন্দ্রে আছে 'হিউম্যান রিজনিং'। এর সাথে রোদবৃষ্টি, গরম, ঠাণ্ডার তেমন কোন সম্পর্ক নাই। নিশ্চিত হতে যেকোন আইনশাস্ত্রের ভালো বইয়ে প্রাকৃতিক আইন নিয়ে লেখা প্রথম ৫ পাতা পড়ে দেখতে পারেন।
৫. নিরেট ইতিহাসের বর্ণনায় আপনি এমনকি মনের ভুলেও কোন জরুরী তথ্য যদি উল্লেখ না করেন, তা হলে তা বিভ্রান্তি ছড়াবে। এটা তথ্যটাকেই অপ্রয়োজনীয় করে ফেলতে পারে। যেমন, ধরেন কলোনিয়াল ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে বাংলাদেশ হচ্ছে প্রথম দেশ যে স্বাধীন হয়েছে Right to Self-determination এর মাধ্যমে। 'কলোনিয়াল ফ্রেমওয়ার্ক' এই শব্দযুগল বা, এর সমার্থক কোনকিছু একেবারেই উল্লেখ না করে যদি আপনি একই বাক্য লেখেন, তাহলে এই লেখার যতগুলি অর্থ দাঁড়ায় তার সবকয়টা ভুল।
৬. অনেকে লিখতে গিয়ে ধান ভানতে শিবের গীত শুরু করেন। যেমন আপনি, লিখছেন সমুদ্র আইন নিয়ে, ধরা যাক, এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোনে উপকূলবর্তি রাষ্ট্রের অধিকার নিয়ে। সেই আলাপ আপনি শুরু করলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত তা দিয়ে; এই বাক্য বিষয়বস্তুর খুব নিকটবর্তী কোন তথ্য না। যারা এই লেখা পড়বে, তারা এইসব প্রাথমিক তথ্য জানেন, এটা ধরে নেয়াই শ্রেয়। এই ধরনের দূরবর্তি বাক্য দিয়ে কেউ আলাপটি শুরু করলে, বোঝা যায়, তিনি তার চিন্তাকে গুছিয়ে আনতে পারেননি। আপনাকে শুরু করতে হবে বিষয়বস্তুর ভেতর থেকেই। নচেৎ অনাবশ্যকভাবে বলা প্রলাপ, আপনার আলাপের সৌন্দর্য, যুক্তি দুটোই নষ্ট করে দিতে পারে।
৭. কেউ কেউ ভাষায় দখল এবং দক্ষতা বেশি দেখাতে গিয়ে প্রচুর সংস্কৃতমূল তৎসম এবং তদ্ভব শব্দ ব্যবহার করেন। এতে ভাষার শক্তি, সৌকর্য এবং গাম্ভীর্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, সংস্কৃতমূল শব্দগুলো যেসব অর্থ বহন করে, যে ভাব প্রকাশ করে, সেগুলো সেই স্থানেই বসা উচিত। অন্যকোথাও নয়। এইখানেও ফাঁকি হয়ে যেতে পারে। সেটা এই কারণে যে, অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালির কাছে, এক-দুইটি ইংরেজি অভিধান থাকলেও, বাংলা থেকে বাংলা অভিধান, অনুমান করি, অনেকের বাসাতেই থাকে না। কারণ মাতৃভাষা হওয়ায় আমরা ধরেই নিই যে আমরা ভাষাটি জানি। বাংলায় যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে সেগুলোর অর্থ জানতে আপনাকে একটি বাংলা অভিধানের সাহায্য নিতে হবে। শুধু কোন একটি শব্দ দেখেশুনে পছন্দ হয়ে গেলে, তার অর্থ সম্পর্কে এবং প্রয়োগের স্থান সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে আপনি যদি যত্রতত্র তা ব্যবহার করতে শুরু করেন তাহলে দৃশ্যত ভাষার ব্যঞ্জনা বাড়তে পারে, কিন্তু আপনি আরেক জায়গায় প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলবেন। সেটা হচ্ছে যুক্তি। লেখায় যেকোন শব্দ আমরা ব্যবহার করি এক বা, একাধিক যুক্তিকে ধীরে ধীরে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্যে। এখন সেটি করতে গিয়ে যদি আপনি, আপাতসুন্দর তৎসম শব্দ বসিয়ে শব্দমুগ্ধতা বাড়ানোতে মনোযোগ ঢেলে রাখেন, তাহলে তা তলে তলে আপনার মূল যুক্তিকে হাস্যকর বানিয়ে ফেলতে পারে। যেমন ধরা যাক, আপনি লিখলেন, 'আইনের বিভাময় আকাশে প্রজ্ঞার শিরস্ত্রাণ জুড়ে দিলেন' এই বাক্যটি। খেয়াল করেন- বিভা, প্রজ্ঞা, শিরস্ত্রাণ এই শব্দগুলো বাক্যটির মাঝে একটি কাব্যিক ধাঁচ এনেছে (যদিও এটা কবিতার লাইন হিসেবে ঠিক হলো কিনা, সেই আলাপ এখানে অবান্তর)। কিন্তু, এটা বাক্যটিকে অস্পষ্ট, অযৌক্তিক একটি রূপ দিয়েছে। যেকোন অবজেক্টিভ এবং লজিকাল অবস্থান থেকে এই বাক্যটিকে অনেকগুলো প্রশ্ন করা যায়। যেমন- আইনের আকাশ কি বিভাময়? কোন যুক্তিতে? শিরস্ত্রাণ তো মাথায় পড়ানোর জিনিস এটা আকাশে পড়ানো যায় কিভাবে? প্রজ্ঞার আবার শিরস্ত্রাণ হয় নাকি? ইত্যাদি। লক্ষ্য করুন, আলোচ্য বাক্যটিতে ওই তিনটি শব্দের ব্যবহার হয়তো এর শ্রুতিগ্রাহ্যতা বাড়িয়েছে, কিন্তু, একই সঙ্গে এগুলো এর অর্থের অস্পষ্টতাও বাড়িয়েছে; ফলে এটি কোন প্যারায় বসলে তা ওই প্যারার যুক্তিকেও অস্পষ্ট, দুর্বল করে দিতে পারে। যারা আইন নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন তারা জানেন, কোন আইনে অস্পষ্ট ধারা থাকলে তা একধরনের 'অ্যাবিউজ' সুযোগ তৈরি করে; এইজাতীয় অস্পষ্ট কথায়ও একটি 'বেনেফিট অব ডাউট' নেয়ার সুযোগ থাকে। তা হচ্ছে, শব্দমুগ্ধতায় আমরা এতোটাই ডুবে থাকি যে, যুক্তিই যে হয় নাই, বা, ট্র্যাশ হয়েছে, সেটা কারো নজরেই পড়ে না। আইনের একটি নিজস্ব ছন্দ আছে; বাইরে থেকে ছন্দারোপ করলে, এই নিজস্ব ছন্দ নষ্ট হয়।
৮. কারো আবার গালভরা এবং কঠিন (এবং সম্ভবত সেই কারণেই অপ্রচলিত) ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে গভীর আগ্রহ আছে। যেমন- Paradigm, sociopolitical, systematic, symbiotic, dimension ইত্যাদি। এই শব্দগুলোর অর্থ এতো ব্যাপক যে এদের ভেতর বহুকিছু ঢোকানো সম্ভব। এগুলো ব্যবহারের অর্থ হচ্ছে, আপনি এতো বেশি কিছু মিন করছেন যে, আপনি সুনির্দিষ্ট কিছুই বলছেন না। কোন বিষয়ে আপনার অনেকক্ষণের গভীর ভাবনা না থাকলেই আপনি কোন প্রশ্নের উত্তরে এমন অস্পষ্ট কথা বলবেন।
৯. আইনের সাথে রাজনীতি হাতেহাত রেখে চলে। আইনের কিছু রাজনীতি আছে, আবার রাজনীতিরও আইন আছে। কিন্তু, আইন এবং রাজনীতি এক নয়; নানাভাবে সম্পূরক মাত্র। বিভিন্ন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে, বা, তার ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আমরা দেখবো কোন কোন প্রশ্ন বা, ইস্যুর রাজনৈতিক বৈধতাই তার আইনি বৈধতাকে নিশ্চিত করেছে। পলিটিকাল লেজিটিমেসির অবস্থান প্রায় সময়ই আইনের উপরে স্থান পায়, নিচে নয়। একথা আন্তর্জাতিক আইনের বেলায়ও সত্য। এই বিষয়টি ভালোভাবে না বুঝে রাজনৈতিক সাফল্যকে আইনের লেন্স দিয়ে দেখার এবং ব্যাখ্যা করার ঝামেলা আছে। স্রেফ রাজনীতিও যে যেকোন দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমধান দিতে পারে, তার এক অসাধারণ উদাহারণ রেখে গিয়েছিলেন, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবার পর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎকারে কুশল বিনিময়ের পর তাঁর প্রথম বাক্যটিই ছিল, 'আপনি আমার দেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছেন কবে?' এই বাক্যটি আলাপের প্রথম বাক্য হওয়াটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার এক দারুণ দৃষ্টান্ত। ইন্দিরা তার সচিবদের সাথে আলাপের কোন সুযোগই পাননি। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে তার সম্মতি দেন। দুই প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ থেকে সব ভারতীয় সৈন্যকে চলে যেতে হয় দ্রুতই। ওই সময়ে এটা নিয়ে কোন আইন ছিল না; থাকলেও বোধ করি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এতো দ্রুত কাজ হতো না।
১০. অনেকের বলায় এবং লেখায় প্রচুর রেফারেন্স থাকে, বিভিন্নজনের কোটেশন থাকে। এটা জরুরী জিনিস। এখন, এই কোটেশনগুলোর সাথে আপনার এঙ্গেজমেন্টের ধরনটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি নবীশ হন অর্থাৎ আন্ডারগ্রেড ছাত্রছাত্রী হন তাহলে সাদামাটাভাবে কে কে কী কী বলেছে তার একটা বর্ণনা দিলেই চলবে। কিন্তু, যদি আপনি স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বা, আরো উঁচু ক্লাসের শিক্ষার্থী হন, তাহলে এঙ্গেজমেন্টের ধরনটি হতে হবে ক্রিটিকাল। মানে হচ্ছে, আপনার আলোচ্য বিষয়ে আপনি ৫০ জনের (আরো কম, বেশি হতে পারে) কথা বা, কাজ নিয়ে আলাপ জমাতে পারেন। কিন্তু, ওই ৫০ জনের চিন্তাকে বিভিন্ন অবস্থান থেকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, সেই এঙ্গেজমেন্টের বা, বয়ানের মধ্য থেকে নিজের চিন্তাকে বা, অবস্থানকে তুলে আনতে পারাটা হচ্ছে মুন্সিয়ানা। এর চেয়ে আরেক ধাপ ওপরের কাজ হচ্ছে ৫০ জনের চিন্তা বা, মতকে, অথবা জ্ঞানজগতে কোন প্রতিষ্ঠিত মতবাদ বা, ডক্ট্রিন বা, স্কুল অফ থটকে, ক্রিটিকাল এঙ্গেজমেন্ট এবং সুচিন্তিত মেথডোলজি এবং থিওরেটিকাল ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে ভুল প্রমাণ করা; নিজের চিন্তাকে এসবের বিপরীতে প্রতিষ্ঠিত করা। বলাবাহুল্য যে, এগুলো ভীষণ কঠিন কাজ। এটা পেরেছিলেন কার্ল মার্ক্স, এটা পেরেছিলেন সিগ্মুন্ড ফ্রয়েড, কিংবা, ভিটগেন্সটাইন। । এদের কাজগুলোই কথা বলে– এরাই জিনিয়াস।