Published : 07 Sep 2021, 05:54 PM
৭৮ কোটি টাকা খরচ করে এক হাজার ২৭৬ কোটি টাকা মূল্যের নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে দেশের একমাত্র তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স। এখন যদি কেউ প্রশ্ন করেন, নতুন গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কারের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কত টাকা খরচ দেখাতো- এর উত্তর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে অচিরেই জ্বালানিখাতের বিশেষজ্ঞরা অতীতের পরিসংখ্যান ঘেঁটে অন্তত কাছাকাছি টাকার অংকটি জানাতে পারবেন। এখানে পাঠকের সুবিধার জন্য কেবল একটি উদাহরণ টানা হলো। দেশের ভোলায় একটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের বাজেট ছিল ৬০-৭০ কোটি টাকা। আর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বাজেট সেখানে দাঁড়ায় ২১০ কোটি।
কঠিন শিলায় গ্যাসের স্তর আছে কি, নেই– তা জানার জন্য সবচেয়ে জরুরী মাটির নিচে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপ। কয়েক দফায় যা দেখার সুযোগ হয়েছে লেখকের। দ্বিমাত্রিক জরিপ করতে বাপেক্সের খরচ হয় কিলোমিটার প্রতি ৪ লাখ টাকা। আর বিদেশি যেকোনও প্রতিষ্ঠানের খরচ কিলোমিটারে ন্যূনতম খরচ ১০ লাখ টাকা। থ্রিডি বা ত্রিমাত্রিক জরিপে খরচের পার্থক্য অবাক করার মতো। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের খরচ এ মুহূর্তে কিলোমিটার প্রতি ৯ লাখ টাকা। ভূ-কাঠামো অনুযায়ী যাতে কিছুটা তারতম্য ঘটে। তবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান থ্রিডি জরিপ করতে এক কিলোমিটারে খরচ করে কমপক্ষে ২৬ লাখ টাকা। তথ্য বলে, কখনো কখনো তা ৫০ লাখ টাকাও ছাড়িয়েছে। বাপেক্স সব মিলিয়ে টুডি করেছে ১৬ হাজার কিলোমিটার। আর থ্রিডি করেছে ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি।
এখন জকিগঞ্জে গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান ও উত্তোলনের অনুমিত হিসাব করতে আশা করি ঝামেলা হবে না পাঠকের। এসব হিসাব পুরোপুরি স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের বর্তমান বিদ্যুতের অর্ধেকেরও বেশি গ্যাস থেকে উৎপাদিত হলেও বাপেক্সের হাত ধরে গ্যাস উত্তোলনের আগ্রহ লক্ষণীয়ভাবে কম। বরং ২০১১ সালে আবিষ্কার করা গ্যাসক্ষেত্র সুন্দলপুরের সফলতা আর হাওর পাড়ে সুনেত্র ব্যর্থতার কিছুকাল পর বাপেক্সকে নিয়ে এক নতুন স্থবিরতা শুরু হয়। নতুনের বদলে পুরনো প্রমাণিত গ্যাসক্ষেত্রের আশপাশেই খননের উৎসাহ অনেক বেশিমাত্রায় দৃশ্যমান। খাতা-কলমে দেশে ১০ বছর আগে-পরের বিদ্যুৎ উৎপাদনের তালিকার বিপুল উন্নতির পরিসংখ্যান যেভাবে নির্দিষ্ট ও বিস্তৃত, দেশিয় খনিজ সম্পদ উৎপাদনের চিত্র ঠিক ততটাই করুণ। বিস্ময়করভাবে যতটা বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিত্য নতুন কেন্দ্রের ঘোষণা ও চুক্তি করা হয়, ঠিক ততোটা এ ব্যর্থতা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করা হয় না। এমন নথি পেট্রোবাংলাতে খুঁজলেই মিলবে যে তালিকায় বলা হয়েছে, গ্যাসের নিশ্চয়তা না পেলেও কোন কোন সম্ভাব্য নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পযন্ত সরকারি ৫০টি, রেন্টাল ২০টি ও পিপিপি ৭৫টি সহ মোট ১৪৮টি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। প্রমাণিত বাস্তবতা হচ্ছে, এর মধ্যে ১৪ হাজার ৬৪৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কমপক্ষে ১২১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে। বাকি ১৩ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার সুযোগও রয়েছে। এটাও এদেশে ইতিহাস যে, মাত্র ১০ বছরে ১৮ হাজার ৬০৬ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ যোগ হয়েছে জাতীয় গ্রিডে। ১ কোটি ৮ লাখ গ্রাহক ৩ কোটি ৭০ লাখে পৌঁছেছে। তবে এর পেছনে একটা 'বড় কিন্তু' স্পষ্টভাবে থেকেই গেছে। এ লেখায় সেই 'কিন্তু'র দায় মেটানোর চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।
পরিবর্তিত উন্নয়ন প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে বিপুল কর্মযজ্ঞ সূচিত হলেও, বিদ্যুৎ তৈরির জ্বালানি কী হবে- তা নিয়ে ছিল এক ধরনের বৈপরীত্য। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি জোগাড়ে পরিকল্পিত ও স্থিরভাবে দেশিয় উৎপাদন বাড়ানোর বদলে অনেক বেশি জোর দেওয়া হয়েছে বিদেশ নির্ভরতার ওপর। দিন যত গড়িয়েছে, ততোই দেশ থেকে তা বিদেশের দিকে ছুটে চলেছে। এ বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে পরিসংখ্যান টানলে। ২০১৬ সালে দেশিয় গ্যাস ব্যবহার করা হয় ২ হাজার ৭৫০ ঘনফুট। কিন্তু ৫ বছর পর বর্তমানে তা নেমে এসেছে ২ হাজার ৩৫০ ঘনফুটে। কমে আসা প্রায় ৪০০ ঘনফুট গ্যাসের জায়গা দখল করেছে বিদেশি এলএনজি। পেট্রোবাংলা বলছে, বর্তমানে দৈনিক ৮০০ থেকে সাড়ে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এটা স্পষ্ট যে, ক্রমান্বয়ে দেশিয় গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। অথচ ঠিক এসময় জাতীয় গ্রিডে কয়েক শ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ যোগ হয়। অবশ্য অভিযোগ উঠেছে, "মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়, বাকি ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়।" (প্রথম আলো-১৯ অগাস্ট ২০১৯)। আবার পত্রিকার প্রতিবেদন বলছে, বিদ্যুৎ না নিলেও গত পাঁচ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের বিল পরিশোধিত হয়েছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিল পরিশোধ করা হয়েছে গত অর্থবছরে- ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। বলা যেতে পারে, যেভাবে লেখক তার যুক্তি উপস্থাপন করতে চান, সেভাবেই তিনি তা সাজাবেন। কিন্তু এই অর্ধেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকা অথবা ৩১ হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ- রাষ্ট্রের বড় দায় হিসেবেই টিকে থাকছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের নেশা বা পাগলা ঘোড়া দাবড়ানোর বিপরীতে এ সময় আরও বড় একটি ঘটনা ঘটতে থাকে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে বাদ দিয়ে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে একের পর এক গ্যাস কূপ খননের চেষ্টা করা হয় এবং সেখানেও নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার বা খননের বদলে, পুরনো গ্যাসক্ষেত্রের কূপ সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর এ সময়েই ব্যর্থতার অভিযোগ ও অপবাদ দিয়ে তেল-গ্যাস উত্তোলনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে স্থবির করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ২০১০ সালের আগে বাপেক্স-কে যেমন বঞ্চিত করা হতো, আবারও সে ধারা ফিরে আসে।
অথচ এই সরকারের সময়ই বাপেক্স আশার আলো হয়ে উঠেছিল। ২০১১ সালে সুন্দলপুর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার সে সময়ের তৎপর বাপেক্সকে নতুন করে গতি দিয়েছিল। পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের যৌথ নেতৃত্ব এরপর নজর দিয়েছিল নেত্রকোনার সুনেত্র ও পাবনায়। সম্ভাবনা খুঁজে পায় খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সেমুতাংয়ের পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্রেও। ১৯৬০-এর দশকে বিদেশি কোম্পানি খনন করেও উপযুক্ত লাভের আশা না পাওয়ায় তা ছেড়ে গিয়েছিল। মনে পড়ছে, ২০১১ সালের শেষ দিকে পাহাড়ি চা-বাগানঘেরা নির্জন সেমুতাংয়ে কীভাবে গ্যাসের আলোয় আলোকিত হয়েছিল মানিকছড়ি। সে সময় গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা প্রায়ই পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের এ উন্নয়ন কাজে অংশ নিতেন, গাড়িবহরের সঙ্গী হতেন।
সেই সুবাদে তখন গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে যাওয়া ও রাত যাপনের সুযোগ পান পত্রিকা ও টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল- মোট চার বছরে বাপেক্স এর কাজে গতি আসে এবং পেট্রোবাংলা নতুন রিগ কেনার তাগিদ অনুভব করে। উন্নয়ন কূপ খননের জন্য বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র এ সময় বাপেক্সকে তাগিদ দিতে শুরু করে। বাপেক্সের কর্মীরা যখন রশীদপুর গ্যাসক্ষেত্রের থ্রিডি সিসমিক জরিপ করে তখন তা প্রতিটি সম্প্রচার মাধ্যমে ফুটে ওঠে। এর আগে ও পরে হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রের ১১ নম্বর কূপ, কখনো শ্রীকাইল, কখনো সুন্দলপুর, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবায় ছোটে গণমাধ্যমের বহর।
গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ব্যর্থতার খবরও সচিত্র প্রতিবেদনে আসে। রূপগঞ্জে নতুন গ্যাসের সন্ধান মেলে, টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে আসে সেই ছবিও। এ সময়কালে কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রের একটি কূপের নতুন স্তর থেকে তেল আবিষ্কারের খবর জানায় বাপেক্স। বিরোধীদলের মহাসমাবেশের দিন সেই খবর টেলিভিশনগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচারও করতে হয়েছিল। পরে অবশ্য তেল নয়, গ্যাস প্রাপ্তির নিশ্চয়তা মেলে। কয়েক দফায় ভোলার শাহবাজপুরে যান সংবাদকর্মীরা। সবশেষ দ্বীপ জেলা ভোলার উত্তর প্রান্তে ভেদুরিয়ায় আবিষ্কৃত হয় দেশের ২৭ তম গ্যাসক্ষেত্র, যা 'ভোলা নর্থ' নামে পরিচিতি। সেটিও বাপেক্সের কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফল। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার শাহবাজপুরে পুরনো ক্ষেত্রটি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে একই থানার মুলাইপত্তন গ্রামে এ কূপটিও খনন করা হয় বাপেক্সের ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে।
ভোলায় বাপেক্সের ত্রিমাত্রিক জরিপের ফল দেশের গ্যাস সম্পদের মজুদ সম্পর্কে নতুন আশা জাগায়। অথচ প্রায় প্রমাণিত ওই গ্যাসস্তরে খননের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে, বাপেক্সকে নয়। বাপেক্সের তুলনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের খরচ কতগুণ সে হিসাব লেখার শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। ফলে একদম অংকে আর বুদ্ধিতে কাঁচারা তুলনা করলে হতবুদ্ধি হবেন। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপুল আগ্রহের বিপরীতে বাপেক্সের প্রমাণিত গ্যাস মজুদের স্তরকে বিদেশিদের হাতে দিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠানকে নিরলসভাবে ব্যর্থতার বৃত্তে বেঁধে রাখার চেষ্টা বড় কষ্টদায়ক, তবে রহস্যজনক আর নয়। দেশের ২৮ তম হিসেবে জকিগঞ্জের গ্যাসক্ষেত্র উপহার আর ভোলার সম্ভাব্য বিপুল মজুদের নিশ্চয়তা দেওয়া বাপেক্সকে নিয়ে এবার নিশ্চয়ই সেই রহস্যের আঁধার কাটবে, নিজেদের প্রতিষ্ঠান ফিরে পাবে তার কর্মচঞ্চল পরিবেশ, যার হাত ধরে জ্বালানি নিরাপত্তার আপাত নিশ্চয়তা পাবে বাংলাদেশ- এ প্রত্যাশাই রইল।