Published : 24 Jul 2021, 07:28 PM
আড্ডা কিংবা অনুষ্ঠানে সচরাচর যাই না এখন। অনেক সময় আড্ডা বা অনুষ্ঠানে অনেকে নিজেরাই আসেন। তবে শহীদ মিনারে যেতে হয়। চলে যাবার পর কেউ আর আমার কাছে আসে না, এমন কি আমিও আসবো না। কেউ কেউ চলে যাওয়ার আগে শহীদ মিনার ছুঁয়ে যান। আমি সেই কান্নাছোঁয়া শহীদ মিনারকে স্পর্শ করতে যাই। এবারও গিয়েছিলাম। লকডাউন আর করোনাভীতির এ সময়ে নিরব নির্জন শহীদ মিনারে দূর থেকে দেখলাম ফকির আলমগীরকে। শহীদ মিনারের নির্জনতার মতো 'সখিনা'দের জন্য রেখে গেলেন একজীবনের সব শূন্যতা। 'গান' স্যালুটের বিয়োগান্তক বিউগলের কান্না তাকে স্পর্শ করেছিল কিনা আমরা কেউই জানি না। এরপর 'পৃথক পালঙ্কে' চড়ে এসেছিলেন শহীদ মিনারে, আর শেষযাত্রায় তাকে রেখে আসা হলো খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে। শান্তিবাগ থেকে তালতলা খুব একটা দূরে নয়। ফকির আলমগীরের গানে আছে- 'মৌচাকের আগে, মালিবাগের পিছে বন্ধু আমার শান্তিবাগে ঘর বানাইছে। সেই ঘরেতে থাকবো দুইজন আমায় জানাইছে'। মানুষ একটা সত্যই খুব বেশি জানে। ঘর বদলে যায়। বদলে যাওয়ার পর সে একা ছিল, আবারও একলা হয়।
ফকির আলমগীর খুব একটা বদলাননি। কলেজ জীবনে যখন ছাত্র ইউনিয়ন এর সাথে জড়িত হয়েছিলেন, ছাত্র ইউনিয়ন ঠিক সেই সময়ে বদলে গিয়েছিল, রাশিয়া আর চীনপন্থি মতাদর্শ সারা পৃথিবীর বাম রাজনীতিকে দ্বিধাবিভক্ত করেছিল। কিন্তু মানুষের কথা বলার আগ্রহ তখন থেকেই তারমধ্যে তৈরি হয়েছিল। গণসংগীতের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের কালে, যখন তিনি জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) পড়তেন তখন জড়িয়ে পড়েন 'ক্রান্তি' শিল্পী গোষ্ঠির সাথে। ১৯৭১ সালে যোগ দিয়েছিলেন 'স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে।' ১৯৭৬ এ গড়ে তোলেন 'ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠি' যা তার নামের সমার্থক ছিল।
স্বাধীনতার আগে পরে সংগীতের বাঁকবদল হচ্ছিল খুব দ্রুত। পাশ্চাত্য ধারার বাদ্যযন্ত্রের সাথে দেশের লোক সংগীতের সুরের ধারার মিশেল আর বিদেশি রক, জ্যাজ কিংবা ব্লুজ গানের বাংলাকরণের ধারাটা এদেশে 'পপ' (পপুলার সং) গান হিসেবে ধুন্দুমার জনপ্রিয় হতে থাকে। স্বাধীনতার পর মূলত যে পাঁচজন শিল্পী (ফাইভ ম্যান আর্মি) পপ গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান, ফকির আলমগীর তাদের ভেতর একজন। ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ আর আজম খান মারা গিয়েছেন আগেই। ফকির আলমগীরের বিদায়ের পর জীবিত থাকলেন শুধু ফেরদৌস ওয়াহিদ। জীবিত থাকা সব কিছু নয়, বেঁচে থাকাটাই আসল। ফকির আলমগীর বেঁচে থাকবেন বাংলার সংগীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে।
বদলে যাওয়া সময়ের যাত্রায় গণসংগীত থেকে পপ গানের জগতে এলেও গণসংগীতকে কোন না কোন ফর্মে- হতে পারে সেটা পপ ফর্মে বা দ্রুত লয়ের গানে রূপান্তর করে অনেকটা 'সহজিয়া' গান হিসেবে মানুষের অন্তরে গেঁথে দেওয়ায় তার জুড়ি ছিল না। ফকির আলমগীরের প্রথম দিকের গানে পপ ফর্মটাই প্রবল ছিল যেখানে জনপ্রিয় হওয়ার আকুতিটাও প্রবল বলে মনে হয়। যেমন- "ধরি ধরি, সন্ধানও করি- নাগাল পাইলে তারে ছাইড়া দিতাম না/ কৃষ্ণারও প্রেমে এত যে জ্বালা সখি আগেতো জানতাম না", অথবা আহমদ ছফার লেখা- "ঘর করলাম নারে, আমি সংসার করলাম না। আউল বাউল ফকির সেজে ভিখ নিলাম না।" কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়- "মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না…।"
সম্পর্ক মানুষের হৃদয়ে ভাঙচুর আনে। কোন একদিন মন ভেঙ্গে হয়তো কেউ চলে গিয়েছিল। চলে যাওয়া মানুষটার জন্য ফকির আলমগীর একটা গান করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সুরের আরেক দিকপাল আলাউদ্দীন আলীর সুরে। চেয়েছিলেন দেশের অনেক মানুষের মতো চলে যাওয়া সেই মানুষটাও যেন গানটা শোনে- 'হঠাৎ কোন পথে, দেখা হলে দুজনাতে/ সঙ্গী যদি রয় তোমার সাথে/ পুরোনো পরিচয়ে দাঁড়াবো না/ নতুন আশার ঘর ভাঙবো না'। আসল প্রেম মানুষকে হয়তো ভদ্র আর বিনয়ী করে তোলে ব্যক্তিজীবনে। এরপর তিনি পপ গানের সাথে গণসংগীতকে জড়িয়েছিলেন, প্রতিবাদী হয়েছিলেন এদেশের অগণিত 'সখিনা' ও তার প্রেমিকের জন্য।
সেই এক দিন ছিল। সখিনাকে নিয়ে তিনি এক যুদ্ধে নেমেছিলেন। হয়েছিলেন সখিনাদের ভাগ্য ফেরানোর জন্য নিবেদিত 'রিক্সাচালক'! এই গানে আকুতি করে বলেছিলেন মহাজনের পাওনা টাকা শোধের জন্য 'ব্যাবাক ফসল' তুলে দিচ্ছেন তাদের গোলাতে। দুঃখের আকুতি নিয়ে গিয়েছিলেন সুরে- "ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে/আমি অহন রিস্কা চালাই ঢাকার শহরে!" এর পর সখিনাকে ভিন্ন ভিন্ন গানে ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। যেমন- 'মোর সখিনার কপালের টিপ মুইছা গেছে ঘামে/ কইতে বুকটা ফাইট্টা যায়, ভোরবেলা সে চইলা যায়, ইট ভাঙ্গনের কামে।" অথবা 'চল সখিনা দুবাই যামু, দ্যাশে বড় দুঃখরে…।"
দেশের দুঃখ ভুলতে সখিনারা 'দুবাই গিয়ে কী করে বা কোন বিপদে পড়ে তা সমাজের সব মানুষই জানে। হয়তো গানে গানে তিনি বলতে চেয়েছিলেন সখিনাদের যেন পেটের ভাতটা জোটে অথবা নিজেরা তা যেন জোগাতে পারে। কিন্তু এতকিছুর পর সেই সখিনা যখন চলে যায় অন্য কারো ঘরে তখন সেই আকুতিও চলে আসে গানে- 'সখিনা তোর বিয়ার খবর পাইছি বাড়ি গিয়ারে, পাইছি বাড়ি গিয়া/ তুই না হয় আমার ছিলি/ আর কিছু নয় না পারছিলি/ মরতেও কী পারলি না তুই গলায় দড়ি দিয়ারে…।" স্বাধীনতা কি সখিনাদের মুক্তি এনে দিয়েছিল? সেই প্রশ্নও আছে তার গানে, "বাংলাদেশের শিখা অনির্বাণ, ধিকিধিকি জ্বলেরে/ কান্দে সখিনা বানু রে…"। হয়তো সখিনাদের শেষ সান্তনার নাম কান্না।
হয়তো তিনি সান্তনা খুঁজতেন গানের ভেতর। পপ বা চটুল গানে যে প্রবণতা দেখা যায়। যেমন- "পার্বতীপুর ইস্টিশানে/দেখা হলো তোমার সনে/বার বছর পর/মনে হলো করছো তুমি ভুল মানুষের ঘর গো…"; হয়তো সেটা গীতিকারের সান্তনা কিংবা গায়কেরও উপলব্ধি। গান ছাড়া গায়কের আর কোন গন্তব্য থাকে না।
সখিনার সিরিজের মতো আরও কিছু গানে ফকির আলমগীরের সরব উপস্থিতি ছিল। যেমন- কালো কালো মানুষের দেশে/ওই কালো মাটিতে/নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি/লাখো কবিতার অন্তঃমিল/শুভ হোক তোমার জন্মদিন…।"
এই গান তিনি ম্যান্ডোলাকেও শুনিয়েছিলেন। আজীবন সরব ছিলেন জন হেনরিকে নিয়ে- 'নাম তার ছিল জন হেনরি, ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন।" পপ গানের সাথে সাথে খেটে খাওয়া মানুষের কথাও তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তার গানে। মেহনতি মানুষের গানও ছিল তার কণ্ঠে। পয়লা মে আসলেই বিভিন্ন টেলিভিশনে তাকে সরব দেখা যেত।
ফকির আলমগীর জন্মেছিলেন ১৯৫০ এর ২১ ফেব্রুয়ারি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরেই তিনি চলে গেলেন। ৭১ বছর বয়স হয়েছিল তার। শান্তাহার জংশনে তার সাথে আর কোনদিন দেখা হবে না। আনমনে ঘোমটা খুলে কেউ আর তার দিকে তাকিয়ে থাকবে না। আমাদের হৃদয়ের জংশনে তার গানের ট্রেন কখনো থামবে না।
ব্যক্তিগত
প্রিয় ফকির আলমগীর আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়াটা হলো না। স্বাধীন দেশে যখন ছাত্রলীগ দুই ভাগ হয় (১৯৭২)তখন আপনি শিল্পী হিসেবে গান গাইতে গিয়েছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের সভায়। আপনি সেটা করতেই পারেন। কোন এক লেখায় সেটা আমি লিখেছিলাম আপনার গানের রেফারেন্সসহ। আপনি রেগে গিয়েছিলেন। যতবার দেখা হয়েছে আপনি অভিমানটা ভাঙ্গেননি। আমি আপনার মতো করে কথা বলতে পারি (মিমিক্রি) সেটাও আপনি জানতেন এবং আপনার অভিমান বাড়তো। আপনার মতো আরেক মুক্তিযোদ্ধা গায়ক আজম খান এর মৃত্যুর পর আমার লেখা পড়ে আপনার খানিকটা অভিমান ভেঙ্গেছিল। একদিন টেলিফোন করে বলেছিলেন, "শিল্পীদের বয়স হয় নারে। সবাই বোঝে না দুই একজন বোঝে। শিল্পীরা না আসুক কারো কারো উচিত তাদের কাছে যাওয়া।"
আপনার কাছে যাওয়ার আর কোন পথ খোলা নেই প্রিয় ফকির আলমগীর। আপনি যেখানে গেছেন সেখানে কী সখিনার কপালের টিপ ঘামে মুছে যায়? কৃষ্ণার প্রেমে সেখানেও কী অনেক জ্বালা? সেখানেও কী কাল্লু মাতবররা ঘর ভেঙে নিয়ে যায় প্রিয় মানুষকে? সেখানেও কি থাকে হাহাকার- 'কোন পথে দেখা হবে তার সাথে'? মনভাঙা কান্নাটা কি সেখানেও ফিরে আসবে? সেখানে কী সখিনার সাথে দেখা হবে আপনার? সখিনার মাধ্যমে চিঠি পাঠালে আপনি ক্ষমা করবেন আমাকে?
না করলেও ক্ষতি নেই। গানের পাখিরা গানটাকেই গন্তব্য মনে করে। কোন বৃক্ষে বসে সে পরিবেশন করেছিল সেটা তারা মনে রাখে না। আপনি যেখানেই যান না কেন, সব ভুলে গেলেও দরাজ গলায় মাঝে মাঝে গেয়ে উঠবেন-
আজও বাংলার আকাশ বাতাস দুঃখে শোকে উদাস হয়
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়…।