Published : 30 Jun 2021, 03:55 AM
জন্ম শতবর্ষে প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিবাদন। এ মহান প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হিসেবে জ্ঞানের আলোর স্পর্শ পেয়েছি। রসায়নে সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও পেশাগত পরিচয়ের সুবাদে যুক্ত হতে পেরেছি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় থেকেই সক্রিয় থেকেছি ছাত্র আন্দোলনে। ১৯৭১ সালে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাভূত ও বিতাড়নের জন্য। সময়টি ছিল স্বপ্ন ও সাহসের, অনন্য উদ্দীপনা ও আবেগের। পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। কিন্তু বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে, জলাভূমি কিংবা লোকালয়ে পাশে ছিল সহযোদ্ধারা। তাদের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আন্দোলনের সহকর্মী, বেশিরভাগ অচেনা-অজানা কৃষক-শ্রমিক-শিক্ষক কিংবা সশস্ত্র বাহিনী বা অন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এক মোহনায়, এক কাতারে সামিল করেছিল। 'মিলেছি আজ মায়ের ডাকে…' এটাই ছিল পরম সত্য। মুক্তিযুদ্ধকালের অস্ত্র জমা দিয়ে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসি- কার্জন হলের রসায়ন বিভাগের অঙ্গনে পা রাখি- সহপাঠী ও অন্যদের অভিনন্দনে সিক্ত হই। তারপর পায়ে হেঁটে ক্যাম্পাসের এদিক সেদিক ঘুরে ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিন ও বটতলার শহীদ স্মরণে আয়োজিত একাধিক সভায় যোগ দিই- আনন্দ-বেদনার অনুভূতি তখন। ছাত্র আন্দোলনের সাথীদের সঙ্গে পুনর্মিলন। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র মধুর ক্যান্টিনের মধুসূদন দে নেই। তাকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ পাকিস্তানের সামরিক জান্তা হত্যা করেছে। এই বর্বর হানাদার বাহিনী হত্যা করেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দু শ জন শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও অফিসার-কর্মচারীকে। স্বাধীনতার জন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এত বিপুল সংখ্যক লোকের আত্মদানের নজির মিলবে না। ছাত্রসমাবেশের ঐতিহাসিক দুইটি স্থান কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার ও বট গাছটিও নেই- পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী 'অমিত বিক্রমে' এ দুটি স্থানকে ভয়ঙ্কর শত্র হিসেবে চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাস পরিণত হয়েছিল 'অপারেশন সার্চলাইট' নামের প্রচণ্ড এক ভূমিকম্পের এপিসেন্টারে, যার প্রতিটি ধূলিকনাতেই মিশে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ ও বিজয়ী যোদ্ধাদের পদচিহ্ন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর সময় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর আহ্বানে পরাধীন ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল। খিলাফত আন্দালনও চলছিল এ আন্দোলনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে। পূর্ব বাংলার অগ্রণী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রভাব পড়ে। তখন ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে অমুসলিমদের প্রাধান্য। ১৯৪০ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব উপস্থাপন করলে পূর্ব বাংলার মুসলিমদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ দেখা যায়। একইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতাও তৈরি হয়। কিন্তু ১৯২১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণভাবে বিরাজ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
১৯৪৬ সালের অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে উপমহাদেশের নানা স্থানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয়। কলঙ্কিত অধ্যায় 'দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' নিয়ে আসে অশেষ যন্ত্রণা-কষ্ট। বিহার এবং নোয়াখালীতেও দাঙ্গা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ভিন্ন চিত্র। সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা মানবিক গুণাবলীর অপরূপ নিদর্শন রেখে দুবৃত্তদের ক্যাম্পাস থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছেন। বাংলাদেশে 'ছাত্ররাজনীতি: ঐতিহাসিক পর্যালোচনা' নিবন্ধে সৈয়দ মুনির খসরু ও তাহমিদ জামি লিখেছেন, 'মুসলিম লীগ বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থনে ছাত্র ও যুবকদের উৎসাহিত করতে সক্ষম হয়… তবে ছাত্র কর্মীদের একটা বড় অংশ সামাজিকভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে; বিশেষত ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ আর ১৯৪৬-৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দাঙ্গাবিরোধী শক্ত অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে।' [সূত্র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- নতুন যুগের সন্ধানে, পৃষ্ঠা ৮৭]
অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : সেকাল-একাল' নিবন্ধে লিখেছেন, ১৯৪৫-৪৬ সালেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু কোনো মুসলিম ছাত্র বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছে, এমন অভিযোগ মেলেনি। [সূত্র: সরদার ফজলুল করিম, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ। পৃষ্ঠা ৬৭]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের খ্যাতিমান শিক্ষক ড. অমিয় দাশগুপ্তের কন্যা ড. অলকনন্দা প্যাটেল 'পৃথিবীর পথে হেঁটে' গ্রন্থে লিখেছেন, 'কমনরুম রাজনীতির আলোচনায় সরগরম থাকত। আবদুর রাজ্জাক, মনজুরুল হক, সমররঞ্জন সেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। তিনজনেই পড়াচ্ছেন। প্রথম দু'জন মুসলিম লীগ, তৃতীয়জন গান্ধীবাদী- দেশ বিভাগে মত নেই। আলোচনা উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হতো, ঘোর বিবাদ দু'পক্ষে, কিন্তু বন্ধুত্বে এর আঁচ পড়েনি। [পৃষ্ঠা ১০৩]
ড. ফকরুল আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : নতুন যুগের সন্ধানে' গ্রন্থে 'ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি ও উচ্চশিক্ষা' নিবন্ধে লিখেছেন, 'কংগ্রেস ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করলে পূর্ববঙ্গের ছাত্ররাও সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে উত্তরোত্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং তারা স্বাধীনতার জন্য জনগণকে প্রস্তুত করে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া (যেমন ১৯৪৩ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ও মুসলমান ছাত্ররা হকিস্টিক নিয়ে একে অপরকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া করে) সেই সব আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, যাতে স্বাধীনতা প্রত্যাশী ও ব্রিটিশ শাসনে ক্লান্ত যুবকদের ঐক্যের প্রতিফলন ঘটে।' [পৃষ্ঠা ৬৮]
সাবেক ছাত্রনেতা ও গবেষক শেখর দত্ত এই নিবন্ধের লেখকের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় বলেছেন, 'অধ্যাপক সত্যেন বসু, অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদার, ড. মোহাম্মদ শহীদুলা, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী মোতাহার হোসেন, মুনির চৌধুরী প্রমুখ খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছেন। এখানে এসেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তারা কেবল অসাম্প্রদায়িক মানবিক গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন না, অন্যদের মাঝেও তা সহজে ছড়িয়ে দিতে পারতেন। সঙ্গত কারণেই বঙ্গভঙ্গ ও তা রদের প্রেক্ষাপটে যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছিল, তা ক্রমে দূর হয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ মহান প্রতিষ্ঠান যে দ্রুতই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনভুক কর্মচারীদের অধিকার আদায়, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, সামরিক শাসনের লৌহ নিগড় থেকে মুক্তি, গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি বাতিল করে গণমুখী ও বৈজ্ঞনিক শিক্ষানীতি চালু প্রভৃতি দাবিতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে- সেটা মোটেই আকস্মিক ছিল না।'
১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ক্রমে মুসলিম ছাত্র-শিক্ষক সংখ্যা বাড়তে থাকে। একইসঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে মুক্তিবুদ্ধির চর্চাও বাড়ে। অসাম্প্রদায়িক আদর্শ তারা হৃদয়ে ধারণ করে। বিশেষ করে এগিয়ে আসে ছাত্র সমাজ। ইসলামী রাষ্ট্রের পরিবেশেও তারা উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সামনে আনে। স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে। ক্রমে শ্লোগান ওঠে- জয় বাংলা। পিন্ডি না ঢাকা ঢাকা, ঢাকা ঢাকা। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা। সবকিছুর কেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নীতি ও কৌশল প্রণয়নে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মিলনস্থল ডাকসু অফিস ও মধুর ক্যান্টিন। মধুসূধন দে-র ধর্মীয় পরিচয় পাকিস্তানি শাসকদের মাথাব্যথার কারণ ছিল, কিন্তু ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক সবার তিনি আপনার জন- প্রিয় মধুদা। একজন চা-সিঙ্গারা বিক্রেতাকে ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে টপ টার্গেট রাখায় তাই বিস্ময়ের কিছু নেই।
তখন ছাত্র সংগঠনগুলোকে কাজ করতে হয়েছে চরম বৈরি পরিবেশে। কারণ শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে শাসকরা কখনও কখনও প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। ১৯৪৯ সালে তরুণ ছাত্রনেতা আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কম বেতনভুক কর্মচারীদের পাশে দাঁড়ালে তার ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ষাটের দশকেও একাধিকবার সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার কারণে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তীব্র দমনীতির মধ্যেও ছাত্রসমাজ একাট্টা ছিল শিক্ষা ইস্যু থেকে শুরু করে স্বাধিকার তথা বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্য সামনে রেখে।
কেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজ বৃহত্তর স্বার্থের ইস্যুতে এমন অবস্থান নিতে পেরেছিল? সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উচ্চ শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে পূর্ব বাংলার নানা প্রান্ত থেকে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হতো। তাদের অনেকেই ছিল মধ্যবিত্ত-নিুবিত্ত এমনকি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, এটা সহজে তারা ধরে ফেলতে পারে। শিক্ষা, চাকরি, সেনাবাহিনীতে নিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য সহ নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য তাদের ক্ষুব্ধ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দেয়। তাদের পেছনে ছিল ব্যাপক জনসমর্থন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার কার্যকর প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তারা এখানের মানুষের প্রত্যাশা ধরতে পারে নাই, চায়ও নাই। উগ্র ধর্মান্ধতার আদর্শ দ্বি-জাতিতত্ত্ব দিয়ে সবাইকে চুপ রাখার কৌশল অনুসরণ করে, যা ব্যর্থ হয়।
জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকা আমাদের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মহল শুরু থেকেই মেনে নিয়েছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং নানা পেশায় সংযুক্তদের অনেকেও ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে আস্থা রেখেছে এই প্রতিষ্ঠানের ওপর। তৎকালীন ইকবাল হল, আমতলা বা বটতলা এবং মধুর ক্যান্টিনের মত স্থানে সাধারণ মানুষ এসেছে দলে দলে। কলকারখানায় শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য নিষ্পত্তিতে সহায়তা চেয়েছেন তারা, যার অনেক ঘটনার স্বাক্ষী আমি নিজেও। এর কারণ সহজেই বোধগম্য। ড. ফকরুল আলম লিখেছেন, '…এই কালপর্বে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি একই সূরে বাঁধা ছিল।' [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : নতুন যুগের সন্ধানে, পৃষ্ঠা ৬৯]
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বড় আঘাত আসে বাংলা ভাষার ওপর। উর্দু চাপিয়ে দিলে শিক্ষা ও চাকরি জীবনে কী ভয়ংকর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে, সেটা এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকরা সবার আগে উপলব্ধি করে। তারা আন্দোলনের ডাক দেয়, ঐতিহাসিক আমতলা যার সূচনা কেন্দ্র। সলিমুলাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ তখন মুখে মুখে উচ্চারিত নাম। প্রাদেশিক আইন সভা ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অভ্যন্তরে জগন্নাথ হলের একটি অংশে অবস্থিত। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। শহীদ স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, যা প্রায় সাত দশক ধরে বাঙালির আনন্দ-বেদনায়, সাহস-সংকল্প-শপথে মিলন কেন্দ্র হয়ে আছে।
আইয়ুব খান গণতন্ত্র ধ্বংস করে সামরিক শাসন জারি করলে প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় আমতলা থেকে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বায়ত্তশাসনের ৬-দফা দাবি প্রদানের কারণে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করা হলে তার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর নেতৃত্বে গোটা পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ গর্জে ওঠে। জনগণও তাতে বিপুলভাবে শরিক হয়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির প্রবল আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানের বিশাল সমাবেশে থেকে ডাকসু সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদ তাকে 'বঙ্গবন্ধু' হিসেবে ঘোষণা করেন। উপস্থিত লাখ লাখ মানুষ দুই হাত তুলে তার প্রতি সমর্থন জানায়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্রদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ডাকসু নেতারা যে লাল-সবুজ-সোনালী পতাকা উত্তোলন করেন, দেড় মাস পর মুজিব নগরে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করার সময় যা স্বীকৃতি হয় জাতীয় পতাকা হিসেবে।
রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাধারণ ও উচ্চতর শিক্ষার প্রতিষ্ঠান করে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকরা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের মূলনীতি অনুসরণে সংকল্পবদ্ধ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, এমন অর্জনের ঘটনা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা, রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসার কথা ছিল। কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে এ দিন প্রত্যুষে তিনি নিহত হন। এ সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজ দমে যায়নি। ক্ষোভ-প্রতিবাদে তারা গর্জে ওঠে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মাত্র দুই মাস ৮ দিন আগে বঙ্গবন্ধু গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগ নেতৃত্ব মধুর ক্যান্টিন থেকে প্রথম মিছিল বের করে। ক্যাম্পাসের দেয়াল ভরে ফেলে 'নিষিদ্ধ শ্লোগান' জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু এবং এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে লিখে। ৪ নভেম্বর ঐতিহাসিক বটতলা থেকে শোক মিছিল যায় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে। ঘাতকরা হুমকি দিয়েছিল বটতলা থেকে এক পা বাইরে বাড়ালেই ব্রাশ ফায়ারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। কিন্তু ছাত্রসমাজ সেটা উপেক্ষা করে। ওই দিনেই জাতির পিতা, রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার নিন্দা ও শোকপ্রকাশ করে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম সিনেটে। এই মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্র ইসমত কাদির গামা, মাহবুব জামান ও অজয় দাশগুপ্ত (এ নিবন্ধের লেখক) সিনেট সদস্য হিসেবে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্ম শতবর্ষে এ অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সকলের প্রতি জানাই কুর্নিশ। বিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জেনোসাইডের এপিসেন্টার। শতবর্ষ আমরা উৎযাপন করছি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে। আমাদের প্রিয় এ প্রতিষ্ঠান কেবল ঐতিহ্যের স্মৃতিচারণ নয়, নব নব অর্জনের গৌরব অর্জন করবে, মুগ্ধ করবে জগৎবাসীকে- এটাই প্রত্যাশা।