Published : 01 Jun 2021, 09:43 PM
এক
কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ নিরঞ্জন রায় সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে একটি চমৎকার কলাম লিখেছেন। ভারতের মাথাপিছু ১৯৪৭ মার্কিন ডলারের গড় আয়কে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় এখন ২২২৭ মার্কিন ডলার। এটি এখন পশ্চিমা এবং ভারতীয় মিডিয়ায় একটি আলোচিত বিষয়। নিরঞ্জন রায় তার লেখাটিতে মাথাপিছু গড় আয়ের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন। তবে তার সাথে অর্থনীতির 'অ'-ও না বোঝা আমিও একমত- বাংলাদেশের মত একটি দেশ যখন মাথাপিছু গড় আয়ে ভারতের মত একটি বৃহৎ অর্থনীতির অমন গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটারে ছাপিয়ে যায়, তখন তা সঙ্গত কারণেই অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক বিশ্লেষকদের নজর কাড়তে বাধ্য।
দুই
সম্প্রতি আরেকটি খবর মিডিয়ায় শিরোনাম হয়েছে। এই প্রথমবারের মত কোন দেশকে ঋণ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশটি আমাদের বন্ধুপ্রতিম শ্রীলংকা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ অনুরোধ জানান। তার সূত্র ধরে পরবর্তীতে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনর যোগাযোগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের সাথে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালকদের সভায় প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। বিষয়টি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে শ্রীলংকাতেও। সেখানকার একটি শীর্ষ দৈনিকের শিরোনামটি হচ্ছে, 'স্টেপিং আপ ইন শ্রীলংকাজ আওয়ার অব নিড'।
পত্রিকা মারফত জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ তিন মাসের জন্য শ্রীলংকাকে সহজ শর্তে ৫০০ মিলিয়ান মার্কিন ডলার ঋণ দেবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন ফুলে-ফেপে ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, তখন কোভিডে পর্যদুস্ত পর্যটন-নির্ভর শ্রীলংকার রিজার্ভ গিয়ে ঠেকেছে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তলানীতে, যা দিয়ে তারা সর্বোচ্চ তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। অথচ এ বছরই তাদের শোধ দিতে হবে ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক ঋণ। এ দু:সময়ে বন্ধুর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বিষয়টি নিয়ে আমি ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সেখানে একজন কমেন্ট করেছিলেন, '…সামনে আমরা পাকিস্তানকেও ঋণ দেব'।
তিন
সম্প্রতি একজন সুহৃদ পাকিস্তানের দ্য ইন্টারন্যাশনাল নিউজের একটা আর্টিকেল আমার সাথে শেয়ার করেছেন। এটি অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে মে মাসের ২৪ তারিখে। কলামটির লেখক বিশ্ব ব্যাংকের একজন সাবেক পরামর্শক। লেখাটিতে তিনি পাকিস্তানের অর্থনীতির হাল-হকিকত বিশ্লেষণ করেছেন। অবাক ব্যাপার স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতিটি সরকারই নাকি বিদেশ থেকে আর্থিক অনুদান গ্রহণ করেছেন। আজ থেকে বিশ বছর আগেও জিডিপিতে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অনেক পেছনে। আর ২০২০-এ এসে বাংলাদেশের জিডিপি দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ। লেখক ধারণা করছেন, দুই দেশের অর্থনীতির এমন গতিপ্রকৃতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০-এ পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছেও সাহায্যের হাত পাতবে।
২০০০ সালে পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। আর গত বিশ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি ৭০০ শতাংশ বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের দ্বিগুণ। লেখাটিতে বাংলাদেশের এই অর্থনীতিক মিরাকেলর নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যার অন্যতমটি হচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের টেকসই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
চার
১৯৯৮ সালে আমি লন্ডনের রয়েল লন্ডন হাসপাতালে কাজ করছিলাম। সে সময় বাংলাদেশের প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় শেখ হাসিনার সরকার। সে বছর দেশে বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল। লন্ডনে আমি কাজ করতাম প্রফেসর পারভিন কুমারের অধীনে। 'কুমার অ্যান্ড ক্লার্ক' খ্যাত বিশ্বে সর্বাধিক প্রচলিত মেডিসিনের টেক্সট বইটির কল্যানে প্রফেসর কুমারকে পৃথিবীর যেকোনও দেশের যেকোনও মেডিসিন শিক্ষার্থীরাই অন্তত নামে চেনেন। ভারতীয় বংশোদ্ভুত প্রফেসর কুমার একদিন আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে জানতে চাইলেন- বন্যায় দেশে আমার আত্মীয়-স্বজনরা সবাই ভালো আছেন কিনা। তারপর ব্রিটিশ ভদ্রতায় জানতে চাইলেন ডিপার্টমেন্টের ডাক্তাররা বাংলাদেশের জন্য কিছু অনুদান সংগ্রহ করে দিলে আমার তাতে আপত্তি আছে কিনা।
আমি প্রফেসর কুমারকে বিনয়ের সাথে জানিয়েছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেবারই প্রথমবারের মত জানিয়ে দিয়েছেন, "আমরা এখন সক্ষম জাতি। আমরা আমাদের দুর্যোগ নিজেরাই সামলাতে পারি। আমাদের আর দানের দরকার পড়েনা।"
শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন প্রফেসর কুমার। দুই চোখে তার অশ্রু। মনে হচ্ছিল যেন, এই গর্বটি আমার চেয়ে অনেক বেশি তার। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ দেখতে এসেছিলেন প্রফেসর পারভিন কুমার। নিয়তির পরিহাসে তখন অবশ্য ক্ষমতায় বিএনপি সরকার। প্রফেসর কুমারের বাংলাদেশ দর্শন তেমন স্মরণীয় হয়নি, যেমনটি তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। সে নিয়ে লেখা যাবে অন্য কোন সময়ে।
পাঁচ
কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে মাঝে ভালোই ঝামেলায় পড়েছিল বাংলাদেশ। ভারতে হঠাৎই কোভিড সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভ্যাকসিন রপ্তানিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিতে বাধ্য হয় সে দেশের সরকার। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে আমাদের ভ্যাকসিন রোল আউট, কারণ ভারতীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে কোভ্যাকসিন কোয়ালিশন থেকেও ভ্যাকসিন প্রাপ্তিটা আপাতত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অবশেষে কিছুটা স্বস্তি। চীন থেকে পাওয়া যাবে দেড় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন, দাম প্রতি ডোজ ১০ ডলার করে। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ক্রয় সংক্রান্ত জাতীয় মন্ত্রীসভা কমিটি এ ক্রয় প্রস্তাবটি অনুমোদন দিয়েছেন। চীনা ভ্যাকসিনের দাম পড়ছে ইতিপূর্বে কেনা কোভিশিল্ডের দ্বিগুণ। আমার খুব কাছের মানুষ সাইফ আহমেদ তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, "ভারতীয় ভ্যাকসিন কেনার সময় অনেকে ঐকিক নিয়মের অংক কষে শিখিয়ে ছিলেন- এতে কার কত লাভ, অথচ দুর্ভাগ্য এই যে এখন দ্বিগুণ দামে ভ্যাকসিন কেনার সময় তারা পাটিগণিত করতেও ভুলে গেছেন।"
ব্যাপারটি যে আমার নজরে পড়েনি তা নয়। তারপরও ভেবেছি ভ্যাকসিনই যেখানে পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে না হয় ১০ ডলারই সই। বলা যায় না, এই ১০ তো ২০ বা ৩০-ও হতে পারতো।
ছয়
আমাদের ভ্যাকসিন সংকটে চীন আমাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। উপহার হিসেবে এরই মধ্যে পাওয়া গেছে ৫ লাখ ডোজ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন। আমাদের গর্বিত বিমানসেনারা প্লেন চালিয়ে চীন থেকে নিয়ে এসেছে সেসব ভ্যাকসিন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন সামনে উপহার হিসেবে আসবে আরো ৬ লাখ ডোজ। বন্ধুর বিপদে বন্ধু পাশে দাঁড়াবে এমনটাই প্রত্যাশিত। যেমন বাংলাদেশ দাঁড়িয়েছে শ্রীলংকার পাশে। যেমন- আমরা গত বছর দাঁড়িয়েছিলাম জরুরী স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী নিয়ে চীনের পাশেও, যখন তারা কোভিড মহামারীতে বিপদে ছিল। তবে আমার খুব কষ্ট লেগেছে যখন দেখলাম চীনা উপহারের কার্টুনের গায়ে লাল বড় হরফে লেখা 'চায়না এইড'। আমার প্রজন্মইতো এখন দান নিতে ভুলে গেছে। আমার সুকন্যা-সূর্য্যরা তো জানেইনা দান নেওয়া কাকে বলে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো সেই কবেই দান নেওয়াকে 'নাল অ্যান্ড ভয়েড' করে দিয়েছেন।
সাত
চীন থেকে সামনে যখন আবারো উপহার হিসেবে আসবে ভ্যাকসিন, আমি প্রত্যাশা করবো সেসব কার্টুনের গায়ে আর লেখা থাকবে না 'চায়না এইড'। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সম্প্রতি জাতিসংঘের এক ভার্চুয়াল সেমিনারে জানিয়েছেন বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীনকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। কাজেই সামনে যখন আমাদের নিজেদের ঘামের টাকায় কেনা চীনা ভ্যাকসিন দেশে আসবে আমার প্রত্যাশা তখন সেসব কার্টুনে লেখা থাকবে 'বাংলাদেশের জনগনের ঘামের টাকায় কেনা'।