Published : 16 Dec 2020, 08:13 PM
মনোরম সুইজারল্যান্ড, ছবির চেয়েও সুন্দর। মাঝরাতে নির্জন নিশ্চুপ চারধার। রাজধানী বার্ন শহরের এক বিশাল ভিলার সামনে খুব সন্তর্পনে এসে দাঁড়াল একটা গাড়ি, সন্তর্পনে নামলেন তিনি। গোপনে তাকে জানিয়েছেন বাড়ির বাসিন্দা – "আজই এসে দেখা করো। সন্ধ্যায় আমি ব্যস্ত আছি, মাঝরাতে এসো।"
অভিজ্ঞ ডিপ্লোম্যাট তিনি, 'মাঝরাত'- এর ইঙ্গিতটা বুঝেছেন নিমেষেই, তাই এত সতর্কতা। দ্রুত কিছু কথা হল, বিদায় নিলেন তিনি আগের মতোই সন্তর্পনে।
বাড়িটা সুইজারল্যান্ড এর ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের, আর যিনি তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি রক্তেমাংসে সম্পূর্ণ বাঙালি, একাত্তরে সুইজারল্যান্ডের পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ছাব্বিশে মার্চে বাঙালির ওপরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার খবর সারা বিশ্বে বোমার মত ফেটেছে, অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি।
বয়সে প্রবীণ এক পাঞ্জাবি পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত, কবি মানুষ, উর্দু কবিতা লেখেন আর তাকে ছেলের মত স্নেহ করেন।, তার কবি মনে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতের ষোলই ডিসেম্বর নির্ভুল ধরা পড়েছে। ডেকে বললেন – "পাকিস্তান ইজ ডেড। কোনো দুশ্চিন্তা করোনা, যা ভালো বোঝো করো।"
তারপর একদিন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের ওই আহ্বান। ততদিনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে, ভেতরে-বাইরে যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে জাতির তাজ তাজউদ্দিনের সতর্ক হাতে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্বপ্নের ভাঙ্গা নাওখানা। মাঝরাতে আবার তিনি একটা খাম গোপনে পৌঁছে দিলেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায়- পদত্যাগ করে প্রবাসী সরকারে যোগ দেবেন ভেবেছেন। ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে সেই খাম পৌঁছে গেল দিল্লীতে, সেখান থেকে সোজা তাজউদ্দিনের হাতে। আবার কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে সুইজারল্যাল্যান্ডের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হয়ে তাজউদ্দিনের নির্দেশ পৌঁছালো তার হাতে- "পদত্যাগ করোনা। পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করো".
এইবার তিনি হাত দিলেন রত্নখনিতে। যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত ইয়াহিয়া বিভিন্ন ফন্দি করছে, প্ল্যান করছে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে পাঠাচ্ছে সেই দেশের সরকারের সাথে দেন-দরবার করতে। সেই সাথে আছে জাতিসংঘের কর্তাদের সাথে গোপন দেন-দরবার। অত্যন্ত গোপন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই দলিলগুলো ফটোকপি করে তিনি মাঝরাতে পৌঁছে দিলেন ভারতীয় রাষ্ট্রদুতের বাসায়- ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে সেই খাম পৌঁছে গেল দিল্লীতে, সেখান থেকে তাজউদ্দিন। আবার কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে সুইজারল্যাল্যান্ডের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হয়ে তাজউদ্দিনের নির্দেশ পৌঁছালো তার হাতে- "সাব্বাস! পাঠাতে থাকো, পদত্যাগ করোনা।"
চলতে থাকলো মাঝরাতে খাম চালাচালি।
যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্ল্যান জানাটা অসম্ভব জরুরি, এর ওপরেই জয়পরাজয় নির্ভর করে প্রায় সময়। খুনি ইয়াহিয়ার সমস্ত গোপন প্ল্যান পৌঁছে যাচ্ছে তাজউদ্দিনের কাছে, পৌঁছে যাচ্ছে ক্রমাগত ও অনতিবিলম্বে মাসের পর মাস, কল্পনা করা যায়! তাজউদ্দিনের অনেক সফল সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল সঙ্গোপন এই ফ্রন্টের এই নি:সঙ্গ সেনাপতির ওই অনন্য অবদান যা আর কারো কাছ থেকে পাওয়া যেতনা। সম্মুখ-সমরের চেয়ে এই সংবাদ-ফ্রন্ট মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তারপরে এক সেই সুখের নভেম্বর। তাজউদ্দিনের নির্দেশ এল- "এবার মনের সুখে নিশ্চিন্তে পদত্যাগ করতে পার, পাকিস্তানের পরাজয় ও আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত হয়েছে।"
স্বাধীনতার পর তিনি সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, বর্ণাঢ্য তার জীবন বলে শেষ করা যাবে না।
একাত্তরের রণাঙ্গনের গোপন ও নি:সঙ্গ কিন্তু সফল সেনাপতির নাম ওয়ালিউর রহমান। ঝিনাইদহ জেলা, কাঁচেরকোল গ্রামের সন্তান তিনি । ১৯৭১ সালে সুইজারল্যান্ড এর পাকিস্তান দুতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি, একজন প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা। এখনো বেঁচে আছেন। টরন্টোতে বাংলা টিভি কানাডা-তে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, বাংলা টিভিকে ধন্যবাদ।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১১টি সেক্টর ছিল। আসলে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র এবং বিশ্ব-কূটনৈতিক অঙ্গন- এই দুটো মিলে আমরা ১৩টি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলাম।