Published : 06 Aug 2020, 10:58 PM
অগাস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাময় শোকাবহ মাস। ১৫ অগাস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত দিবস। দৃশ্যত ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টে দেশিয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে সেই সময়ের কিছু সামরিক কর্মকর্তা হত্যা করেন।
প্রশ্ন জাগে কেন সেদিন তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল? এটা কি শুধু মুজিব হত্যা? মুজিব তার দেশের সাড়ে সাত কোটি (তখনকার দিনে) জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে জীবনের সোনালী দিনগুলো উৎসর্গ করেছিলেন নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে। সহ্য করেছিলেন বছরের পর বছর কারাভোগসহ অমানুষিক নির্যাতন। তিনি দেশের আপামর জনসাধারণকে দেশের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন এবং সবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে ফাঁসির সেলে তৈরি ছিলেন প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দেওয়ার জন্য। সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মুজিবকে কেন হত্যা করা হল তার উত্তর ইতিমধ্যে জনগণের জানা হয়ে গেছে।
হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ঘাতকচক্র ও ঘটনার বেনিফিসিয়ারিদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, স্বীকারোক্তিমূলক দম্ভোক্তি, খুনিদের বিচারকাজে বাধা সৃষ্টি এবং হত্যাকারীদের দফায় দফায় পুরস্কৃত করার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়, কারা ছিলেন এই জঘন্য ঘটনার পেছনে। বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে (১৯৯৬-২০০১ এর জুলাই পর্যন্ত এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় বাদে) বেশিরভাগ সময় রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীদের বাঙালিত্ব, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং পাকিস্তানি ভাবধারার সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর পুনর্বাসন প্রচেষ্টা চলে। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে এই হত্যাকাণ্ডের আসল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ খুনিরা চেয়েছিল শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এবং এ দেশকে পুনরায় সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যাতে কোনো প্রতিবন্ধক না থাকে সে জন্য বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তার পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মীদেরও হত্যা করা হয়। আর এ নিয়ে আদালতে যাতে কেউ প্রশ্ন বা বিচার চাইতে না পারেন সে লক্ষ্যে সংসদে পাস করা হয়েছিল ইন্ডেমনিটি (দায়মুক্তি) আদেশ বিল।
স্বস্তির কথা হলো এ দেশের জনগণ সব নেতিবাচক অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়ে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরিকে আবার ক্ষমতায় বসিয়েছে। আর একই উত্তরসূরির নেতৃত্বে বর্তমান সরকার আদালতের রায়ে হত্যাকারীদের বিচারের রায় প্রায় বাস্তবায়ন করেছে। কতিপয় খুনি দেশের বাইরে পলাতক থাকায় তাদের শাস্তি বাস্তবায়ন করা যায়নি। অবশ্য ঘটনার নেপথ্য নায়কদের অনেকেও বিচারের আওতার বাইরে রয়ে গেছেন, হয়তো আপাত তথ্য-প্রমাণের অভাবে।
ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার দাবি, বিচারপ্রক্রিয়া শুরু এবং ঘটনার নায়কদের নেতিবাচক দিকগুলো প্রকাশের প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু লোক প্রশ্ন তোলেন, 'দেশের স্থপতি, অতুলনীয় যার জনপ্রিয়তা তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরপরই উচ্চকণ্ঠে কেন প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হলো না?' তারা এটাই বোঝাতে চান যে, পঁচাত্তর সাল নাগাদ বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা এতই কমে গিয়েছিল, যে কারণে তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে কারো চোখে এক ফোঁটা জল আসেনি। কেউ প্রতিবাদ পর্যন্ত করেননি!
আসলে কি তাই হয়েছিল ? মূলত এ ধরনের মন্তব্য যারা করেন তারা বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেন না এবং তার জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বকে খাটো করে তার মর্যাদাকে নিচে নামাতে চান। দেশের সচেতন দেশপ্রেমিক মানুষ জানেন সেদিন কী হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে সেদিন 'অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর' অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল দেশব্যাপী। সে সময়ের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডের আকস্মিকতায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রথমেই বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে আসলেই হত্যা করা হয়েছিল কী না? ঘটনার কথা শুনে মুষ্টিমেয় দালাল, সুবিধাভোগী উচ্চাভিলাষী রাজনীতিক ও একাত্তরে পরাজিত শক্তির দোসররা ছাড়া সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বোবা-কান্নার মতো দীর্ঘশ্বাস দেখা গিয়েছিল। অনেকেই প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে উঠেই বিক্ষিপ্ত হলেও বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম, বরগুনা, কিশোরগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকাসহ আরও কিছু স্থানে বিক্ষোভ-মিছিল ছাড়াও প্রতিরোধ প্রক্রিয়া চলছিল। এই প্রতিবাদ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া শত শত লোক সামরিক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন ভোগ করেছেন সারা দেশে। প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন অনেকে। তবে তা সামরিক জান্তার ভয়ে প্রচার পায়নি।
সেদিনের মানুষের মনের অবস্থা প্রসঙ্গে বোঝা যায় কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্ধৃতি থেকে। শিল্পী হাশেম খানের কথা: "জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে? প্রথম বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম মনে ও চিন্তায়। একেই বলে আঘাত। বাংলাদেশের মুক্তিদাতা যাঁকে আমরা সম্মান দিয়েছি জাতির পিতারূপে, বঙ্গবন্ধু নামে, তাঁকেই হত্যা করেছে কয়েকজন সাধারণ সৈন্য? ঘুম থেকে উঠে এমন একটি খবর যা বেতারে বার বার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সেদিন সেই মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল এতদিন পর ভাবতে গিয়ে শুধু বলতে পারি মানুষের মনের অবস্থা কখনো কখনো এমন হয়, যা শুধু অনুভবই করা যায়, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, … সেদিন তাৎক্ষণিক মুহূর্তে যাকেই পেয়েছি, আমার মনের অবস্থা জানিয়েছি। অনেকেই বিশ্বাস করেনি, আমি খামোকাই এসব অশুভ চিন্তা করছি।"
আমিরুল ইসলামের স্মৃতি থেকে: "সেদিন স্তব্ধ মৃতপুরীর মতো এই নগর। হিংস্র, রক্তপিপাসু হায়েনার দল কোথাও কোথাও ভীরু সন্ত্রাসীর ন্যায় ট্যাংকের বহর লইয়া ছুটিতেছে। শোকগ্রস্ত নগরবাসী কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না। কি করিব, কোথায় যাইবে? অকস্মাৎ সকল কিছু বিমূঢ় হইয়া গিয়াছে। যেন মরণ আসিয়া নীরব করিয়া দিয়াছে এই জনপদ। এ কী বীভৎস নারকীয় পরিবেশ? কে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া পথের দিশা দেখাইবে, কে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করিবে আগামী দিনের কর্মপন্থা?"
কলেবরের কথা ভেবে উদ্ধৃতি বাড়ালাম না। তবে এসব উদ্ধৃতিতে একটা কথা পরিষ্কার, বাঙালি জাতির মনটা একদিকে কোমল প্রকৃতির, আর একদিকে সংগ্রামী ও প্রতিবাদী চেতনাসমৃদ্ধ। কিন্তু প্রতিবাদ, সংগ্রামের জন্য যথাসময়ে কর্মপন্থা নির্ধারণ ও উপযুক্ত নেতৃত্বের ডাক পড়া চাই। এদেশের জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে বিভিন্ন প্রয়োজন- পরিস্থিতিতে ডাক শুনেছেন বঙ্গবন্ধুর, পেয়েছেন তার যথাযথ নির্দেশনা। তার অবর্তমানে বিশেষ করে ৭৫ এর ১৫ অগাস্টের পরমুহূর্তে প্রতিবাদী চেতনার মশাল জ্বালানোর মতো বজ্রকণ্ঠ সমৃদ্ধ, মুক্ত নেতা দেশে ছিলেন না। ছিল না আকস্মিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সমন্বিত প্রস্তুতিও।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানসহ যে কজন জাতীয় পর্যায়ের নেতা ছিলেন, যারা অবস্থার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কলাকৌশল নির্ধারণ এবং সাধারণ নেতাকর্মীসহ জনগণের মধ্যে গতিসঞ্চারী নির্দেশনা দিতে পারতেন, তারা বন্দি অথবা ঘেরাও হয়ে কড়া পাহারায় ছিলেন। তাদের কথা, নির্দেশ-উপদেশ, সাধারণ নেতা-কর্মীদের কানে পৌঁছানোর মতো পরিবেশ বা উপযুক্ত কোনো মাধ্যমও ছিল না। এখনকার মতো এতগুলো টিভি চ্যানেল বা সংবাদমাধ্যম, দ্রুত যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন কিংবা ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও ছিল না তখন। এটাতো ঠিক যে, রাজধানীর মূল কেন্দ্র গণভবন, রেডিও, টিভি এবং সংবাদপত্র কবজা করা গেলে সমগ্র দেশই বিভ্রান্তিতে ডুবে যাওয়া স্বাভাবিক। শত্র"রা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পাল্টা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে এমন সবগুলো দিক বন্ধ করেই তাদের অপারেশন শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চলাকালে আদালতে একজন সাক্ষী বলেছেন, "বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে দায়িত্বরত সৈনিকদের সকালে নতুন গুলি দেওয়ার কথা বলে, তাদের আগের গুলিগুলো নিয়ে গেছে ঘাতকের দল, যাতে প্রতিরোধ সেখান থেকেও না আসে।" এতেই বোঝা যায়, ওরা কী রকম প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নেমেছিল এবং সরকারি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে তাদের লোকজনের কী রকম অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।
এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও অনেকে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে, "দেখা যাক উনি কি বলেন', 'অমুক নেতার নির্দেশ ছাড়া আমি কিছু করতে পারি কী না' এ জাতীয় দুশ্চিন্তা কিংবা আসল ঘটনার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে দোটানায় পড়েছিলেন।
অনেকেই বঙ্গবন্ধু ছাড়াও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু ও শীর্ষ নেতাদের বন্দিত্বের খবর পেয়ে নিজের জীবনের মায়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কেউ কেউ খন্দকার মোশতাকের নির্দেশ ও সশস্ত্র সৈন্যদের বন্দুকের নলের মুখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় যোগ দিয়েছিলেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। এ ছাড়া সামরিক-বেসামরিক ক্ষেত্রে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, আওয়ামী লীগ নামধারী ও মুজিব কোট লেবাসধারী অনেকেই ঘাতকচক্র ও হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীদের সঙ্গে নোংরা সখ্য গড়ে তোলায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।"
এভাবে সময় ক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে যে সহিংস ঘৃণা ও বিদ্রোহের আগুন জ্বলছিল তা নিস্তেজ হয়ে অহিংস রূপ লাভ করে। কিছু অদূরদর্শি, দুর্বল চিত্তের আওয়ামী লীগ নেতার ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক মোশতাক চক্রের মন্ত্রিসভায় যোগদানের ফলে পরিস্থিতি ঘাতকচক্রের অনুকূলে যায়। অনেকেই মনে করেছিলেন, এমনকি গ্রাম পর্যায়ে অনেক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাও ভেবেছিলেন যে, একদল বিভ্রান্ত সৈনিক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও পরিস্থিতি, সরকার আওয়ামী লীগেরই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাজেই বঙ্গবন্ধু হত্যার শোক নিজেদের বয়ে বেড়াতে হলেও ঘাতকরা হয়তো রেহাই পাবে না। স্বাধীনতার অর্জনগুলো বৃথা যাবে না।
পরবর্তীকালে এ ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তানপন্থি, মোশতাকচক্র ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ষড়যন্ত্রের এটা যে চরম পরিণতি একথা যখন সবাই বুঝতে পেরেছিলেন তখন ক্ষমতাকাঠামোর সার্বিক পরিস্থিতি ঘাতক ও সুবিধাভোগীদের অনুকূলে চলে গিয়েছিল। তারপরও যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার কথা অনেকে জানেন। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামেও প্রতিরোধ-প্রক্রিয়া শুরু হয়। চট্টগ্রামের তৎকালীন ছাত্র-যুব নেতাদের মধ্যে শামসুদ্দিন আহমদ, এম জাফর, এম এ মান্নান, রেজাউল করিম চৌধুরী, কাজী আবু তৈয়ব, আকম শামশুজ্জামান, চৌধুরী মাহবুবুর রহমান, আনোয়ারুল আজিম, রফিকুল ইসলাম, খোকন নন্দী, চন্দন লালা, হরিসাধন দে বর্মণসহ আরো কিছু ছাত্র-যুব নেতা পরষ্পর যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রে হামলা চালিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ঘটনার পরদিন এবং তৃতীয় দিন এম এ জাফর ও গণপরিষদ সদস্য ডা. ফয়েজ আহমদের নন্দনকাননের বাসায় পরপর দুটি বৈঠকে বিস্তারিত আলাপ হয়। প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে শক্তি-সামর্থের কথা বিবেচনায় ডা. ফয়েজ সেদিন সম্মত না হওয়ায় বেতার আক্রমণ বাদ দেওয়া হয়। তবে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সিটি কলেজ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ১৫-২০ জনের মিছিল বের করা হয়। মিছিল রিয়াজউদ্দিন বাজার আমতল এলাকায় গেলে পুলিশি আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর পর থেকে একাধিক জায়গায় বৈঠকে আন্দোলনের কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। কয়েকশ ছাত্র, যুব নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা পৃথকভাবে সংগঠিত হন মুক্তিযোদ্ধা এস এম ইউসূফ, মৌলভি সৈয়দ আহমদ ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর (প্রাক্তন মেয়র) নেতৃত্বে ও পরামর্শে। তারা স্থানীয়ভাবে কিছু তৎপরতা চালিয়ে পরে বৃহত্তর প্রতিরোধ পরিচালনার লক্ষ্যে কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য আগরতলা যান। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখানকার কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসেন প্রতিরোধ যোদ্ধারা। এ সংগ্রামে আরো যুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ ইউনুছ, জামাল আহমদ ওরয়ে ফকির জামাল, অমল মিত্র, জসীম উদ্দিন খান, শিশির দত্ত, সুকুমার দত্ত, এম এন ইসলাম, গোলাম রব্বান, আনোয়ারুল আজিম, আবু সাঈদ সর্দার, এনামুল হক দানুসহ অনেকে। এদের মধ্যে অনেকে কয়েক বছর ধরে জিয়া সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে পলাতক জীবন-যাপনে বাধ্য হন। অনেককে কারাগারে নিয়ে চরম নির্যাতন করা হয়েছে। ১৯৭৫ এর সেপ্টেম্বরে পটিয়া থেকে গ্রেপ্তার মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিব রোড থেকে গ্রেপ্তার মৌলভী সৈয়দ আহমদের আত্মীয় সৈয়দ মাহমুদুল হক প্রমুখ এ লেখকের কাছে তাঁর ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
চট্টগ্রামের তৎকালীন যুবনেতা, মুক্তিযোদ্ধা মৌলভি সৈয়দ আহমদ অনুসারীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার লক্ষ্যে গিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। ১৯৭৭ সালের আগস্টে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের পুশব্যাক করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে। সেনানিবাসে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয় তাকে ৭৭ সালের ১১ অগাস্ট। বরগুনার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক সামরিক কর্তৃপক্ষের আদেশ নিষেধের তোয়াক্কা না করে মহকুমা পুলিশ অফিসারসহ অন্য অফিসারদের নিয়ে বিদ্রোহে অংশ নেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ১৫ আগস্ট থেকে সপ্তাহব্যাপী প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সরব রাখে বরগুনা শহর। কিশোরগঞ্জে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে ঘটনার দিন সকালে। পুলিশি তৎপরতায় মছিলকারীরা আত্মগোপনে চলে যান। প্রসঙ্গত; তখন ঘোষণা করা হয়েছিল মৃত ব্যক্তির (বঙ্গবন্ধুর) নামে কোনো রাজনীতি করা যাবে না। পঁচাত্তর পরবর্তী কয়েক বছর ধরেই যেখানেই মিছিল স্লোগানের আয়োজনের খবর পাওয়া গেছে সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গিয়ে হাজির।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রথম ২১ বছরের মধ্যে ৭১ এর পরাজিত শক্তি জামায়াত শিবিরসহ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর যে রকম সদম্ভ উত্থান দেখা গেছে, তাতে স্পষ্ট যে, নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে সহযোগিতা করেছেন হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীরা, যাঁরা পরবর্তীকালে বিভিন্ন দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন আওয়ামী লীগ থেকে বিভিন্ন সময় বেরিয়ে যাওয়া হীনমন্য সুযোগসন্ধানী, কথিত বৈজ্ঞানিক ও অতিবাম লেবাসধারী বর্ণচোরা রাজনীতিক। এরা কখনো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে লুটপাট এবং সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য ক্ষমতার সিঁড়ি নিষ্কণ্টক করার নীল নকশা বাস্তবায়নে মদদ দিয়েছেন। এ সমস্ত গোষ্ঠি বারবার চাপা দিয়ে রাখতে চেয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও তার আদর্শকে লালন করার ইতিহাসকে। বাধা দিয়েছে তার উদ্দেশ্যে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে।
খন্দকার মোশতাকসহ ঘাতক ও সুবিধাভোগীদের অনেকে এখন নেই। খুনিদের কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে। সাফল্যজনকভাবে এগিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজও। দেশের নানা রকম সমস্যা-সংকট কাটিয়ে সরকার দেশকে ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের ধারায় চালিত করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও প্রযুক্তিসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার। তারপরও সময়ে সময়ে কিছু অঘটন বর্তমান আওয়ামী লীগ, সরকার ও প্রশাসনের জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করছে। দুর্নামের ভাগী হচ্ছে সরকার।
বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠছে সরকারি দল ও প্রশাসনের অভ্যন্তরে কুচক্রীদের ছোট বড়ো প্রতিনিধিরা পরিচয় গোপন করে সরকারি দলের ছদ্মবেশে, প্রগতিশীলতার পোশাকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা দল ও সরকারের শুভাকাঙক্ষী সেজে ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠার চেষ্টা করছে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে কবজা করে উন্নয়নের যাত্রাপথে কৌশলে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার জামায়াত-শিবির কর্মীদের ছাড়িয়ে আনার জন্য দলের ভেতর থেকে কিছু লোকের চেষ্টা-তদবিরের কথাও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সহযোগী সংগঠনের মধ্যে অন্য মতের লোকজন ঢুকে পড়েছেন বলে মন্তব্য করেছিলেন।
বর্তমান সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও দলের মধ্যে খারাপ লোক ঢুকেছে বলে একাধিকবার মন্তব্য করেছেন। তারপরও বিগত সময়ে মূল দলসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনে জামায়াত-শিবির-বিএনপি সমর্থিত লোকজনের অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। কিছুদিন পরপর দলে বা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী একেকটা অঘটনের খবর প্রকাশ পায়, আর তখনই আলোচনায় আসে অনুপ্রবেশকারীরা এজন্য দায়ী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও দলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জন্য ঢুকে পড়া লোকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পর্যন্ত অসৎ লোকদের পুনর্বাসনের মতো উদ্বেগজনক খবর প্রায় সময় বের হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পঁচাত্তর পূর্ববর্তী সময়ের কথা স্মরণ করা জরুরি। তখন সরকারের ভেতরে বাইরে যে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছিল তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা গেছে সে সব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা অনেকটা পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে। আর সেই কুচক্রীদের দেখা গেছে পরবর্তী সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে।
মনে রাখতে হবে বিগত তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে না পারা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরধীদের বিচার ঠেকাতে না পারা এবং জঙ্গীবাদী তৎপরতার বিস্তার বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট মহল সরকারের ওপর চরম ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে দলের ভেতরে বাইরে দুর্নীতিতে বাধাগ্রস্ত সুবিধাবাদী মহলও নিজেদের হীন স্বার্থে ওই মহলের সঙ্গে আঁতাত করতে পারে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য।
প্রসঙ্গত ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টসহ বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে ধ্বংসের চেষ্টার কথা ভোলার নয়। আরো একাধিকবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এস এম কিবরিয়া ও আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো নেতাদের হত্যার ঘটনাও উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। অতীতে অনেক প্রগতিশীল নেতা, লেখক-সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের নির্মূলের চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানেও যে তারা বসে নেই তা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলোর আস্ফালন দেখেই বোঝা যায়। আর এদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নামধারী বর্ণচোরা কেউ যে নেই-তা কী কেউ বলতে পারে?
সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে সাম্প্রদায়িক ও সুবিধাভোগীদের দূরভিসন্ধি সম্পর্কে সজাগ থেকেই নিজস্ব রাজনীতি এগিয়ে নিতে হবে-যাতে একটুখানি ভুলের কারণে দ্বিতীয়বার ১৫ অগাস্টের কিংবা ২১ অগাস্টের মতো আঘাত হানার সুযোগ কেউ না পায়। ১৯৭৫ পরবর্তী পরিস্থিতির কথা স্মরণ রেখে এবং অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে সতর্ক থেকে দলীয় কাঠামো, নিষ্ঠাবান কর্মীবাহিনী, জনআস্থাশীল সংগঠন ও তা স্থায়ী করার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে বর্তমান নেতৃত্বকে।
মনে রাখতে হবে ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য যেমন শুধু মুজিব হত্যা ছিল না, তেমনি ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল কোনো নেতা-নেত্রী কিংবা সরকারকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টাও তাদের একার ক্ষতি ডেকে আনবে না। বরং এরকম কিছু ঘটলে তা গোটা জাতিকে যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখার পরিবেশ তৈরি করবে।