Published : 24 Jun 2020, 09:21 PM
সারাবিশ্ব যখন করোনাভাইরাসের কারণে হিমশিম খাওয়া শুরু করলো তখনও কিন্তু আমরা নির্ভার। আমরা মানুষ হিসেবে আসলেই মানুষকে বেশি ভালোবাসি। কারণ, কোনও রকমের নিরীক্ষা-পরীক্ষা ছাড়াই অন্যের কথা বিশ্বাস করি। যেটার উদাহরণ এই লেখায় বারবার আসবে।
যেমন- তখন আমাদের মাথায় ছিল 'গরম' দেশে করোনাভাইরাস আসবে না। যদিও ততদিনে আরব দেশে এ মহামারী ছারখার করে দিচ্ছে। তবুও আমরা কিন্তু মোটামুটি নিশ্চিত করোনাভাইরাস আমাদের কিছু 'করবে' না।
যাই হোক। জানুয়ারি গেল। ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে, ব্যক্তিগত ভ্রমণ, কনসার্ট সব হল। মার্চেও তাই।
৮ মার্চের পরে প্রথম মৃত্যুর পর করোনাভাইরাস শুধু ত্রাস নয়- হয়ে গেল বাংলাদেশের জন্য স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে সময়ের শত্রু। কেন?
কারণটা খুব সহজ। এমনকি যুদ্ধে আমাদের হাত ধরা কেউ ছাড়াতে পারেনি। কিন্তু করোনাভাইরাস আমাদের আলাদা করে দিল। বাক্সেবন্দি জীবনের মতন চলে এলাম ঘরের জীবনে। রাস্তার হর্ন আর ট্রাফিকের যন্ত্রণায় থাকতে থাকতে হঠাৎ করেই নীরবতা চলে এল জীবনে।
সেই নীরব জীবনের বয়স এখন তিনমাস। কিন্তু সবকিছুরই কোনও না কোনও ভালো দিক আছে। তারমধ্যে অবশ্যই একটি হল হোম অফিস।
হোম অফিসের ব্যাপারটা বিশ্বজুড়ে অসম্ভব কিছু নয়। অনেকেই এই কাজ করেন। আমাদের দেশে এই ভূতটা চেপে বসে বিপদে পড়ার পর। বিষয়টাকে পনের দিন মনে করার পর যখন তা পহেলা বৈশাখ ছাড়িয়ে গেল তখনই সবার মাথায় চাড়া দিয়ে উঠল চিন্তার গাছ।
এভাবে কাজ বন্ধ থাকলে তো আর চলবে না। অতএব চললো হোম অফিস প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা। বিজ্ঞাপনী সংস্থা, টেলিকম, অনলাইন মাধ্যম, উন্নয়নধর্মী প্রতিষ্ঠান– অনেকেই সফল হয়ে গেলেন। কারণটা প্রযুক্তি। প্রযুক্তির কারণে ঘরে বসে ইমেইল, জুম মিটিং, প্রেজেন্টেশন তৈরি করা বিষয়টা আয়ত্তে চলে এল বটে।
জান বাঁচানো যেখানে মূল আপাতত সেটাও হাফ প্যান্টের ওপর স্যুট পরে করলে কোনও ক্ষতি নেই মোটেই। ফলে সেটাও হয়ে গেল। তাতে করে দুটো বিষয় হল বটে। আকাশটা কেমন যেন নীল হয়ে গেল। হর্নের শব্দটা মিস করলেও আর কানে যন্ত্রণা দিতে পারলো না। রোজ রোজ ভিড় ঠেলে অফিসে না গিয়ে- সকালে 'অন বাটন' এ ক্লিক করেই অফিস শুরু করা গেল।
যে রাস্তায় ধুলোর জন্য হাঁটা দায় ছিল- সেই রাস্তায় এখন সবুজ যেন হাত বাড়িয়ে থাকে। হোম অফিস বিষয়টা খুব খারাপ নয়ও বটে।
হোম অফিস বিষয়টিকে আসলেই গুরুত্বসহ নেওয়া যেতে পারে। কারণ ট্রাফিক নিয়ে যে অভিযোগ তা কমানো যেতে পারে হোম অফিস করা হলে। শিফট করে বা রোস্টার উপস্থিতি করে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আসলেও কাজ এগিয়ে নিতে পারে।
তাতে করে অফিসের ইউটিলিটি খরচও কমাতে পারে। তবে কোনোভাবেই মেধার ওপর যেন সেই কোপ না আসে। বরং দালানের একটি ফ্লোরের খরচ কমিয়ে আরও মেধাবী কর্মী যোগ করা যায়। তাতে বাতাসে দূষিত দ্রব্যও কম আঘাত হানবে– কারণ এসির ব্যবহার হবে কম।
অনেকদিন বাসায় থেকে এই গরমেও বিরতিহীনভাবে এসিতে থাকার অভ্যাস থেকে বের হয়ে এসেছেন অনেকে। ফলে হোম অফিসের কারণে শুধু রাস্তা নয়, রাস্তা, বাতাস, জীবন সর্বোপরী শ্বাস প্রশ্বাসের ওপর অনেকখানিই প্রকৃতির প্রভাব চলে আসছে।
এরমাধ্যমে কিন্তু বিকেন্দ্রিকরণও শুরু করা যেতে পারে। যাকে আমরা বলি- ডিসেন্ট্রালাইজেশন। হোম অফিসের বদৌলতে খুলনার ছেলেটা খুলনায় বসেই কাজ করবে। এখানে আসবে না। বরং দূরপাল্লার বাণিজ্য বাড়বে। প্রয়োজনে আসবে মাসে তিন-চারবার। ঢাকায় বাসা ভাড়া বা উঁচু দালানের প্রয়োজনীয়তা কমবে। লক্কর-ঝক্করবাস বা লেগুনা বিশ্রাম পাবে।
খুলনার রিকশা চালকও আসবে না ঢাকায়। সে খুলনার মানুষকে নিয়ে খুলনাতেই বেড়াবে। ছেলেটিও একদিন টাকা জমিয়ে খুলনাতে খামার করবে যেখানে কাজ করবে শহর-বিমুখী শ্রমিক। ব্যাপারটা মন্দ নয়।
প্রতিটা গ্রাম- প্রতিটা শহরের মানুষগুলো আবার নিজেদের মানুষ ফিরে পাবে। যে যার নিজের ঘরের পাশে সব চাহিদার কেন্দ্র গড়ে তুলবে। হোক তা স্কুল বা বইপড়ার লাইব্রেরি।
কোনো একদিন হয়ত এলাকার সাংসদও এলাকাতে ফিরে যাবে। ভোট কিনতে হবে না- ভোটার এমনিতেই চেনে নেবে এলাকার যোগ্য নেতাকে।
এভাবেই একদিন সারা বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে নিজের শেকড় পোক্ত করে।
আর হয়ত এভাবেই যে যান্ত্রিকতার কাছে মাথা নত করেছিল আধুনিক জীবন, সেই আধুনিক জীবনই আবার প্রযুক্তি দিয়ে যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
করোনাকালে এই প্রাপ্তিটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বরং যে যন্ত্রের ওপর ভরসা করেই জীবন যাবে ভাবছিল সেই যান্ত্রিকতার প্রভাব থেকে বের হয়ে শুধু প্রয়োজনে তাকে ব্যবহার করার যে লাইফস্টাইল এখন- সেটাই বেশি গ্রহণযোগ্য অনেকের কাছে।
তবে অফিসটা হোমে বলে সারাক্ষণই যে ঊর্ধ্বতন মনে করবেন কর্মীকে ল্যাপটপে বসিয়ে রাখা উত্তম – তা কিন্তু বড্ড নেতিবাচক ব্যাপার। সময়টা সাত বা আট ঘণ্টায় রেখে আর জরুরি চাহিদার ভিত্তিতে রাখলেই ভালো। ভুলে গেলে চলবে না, সময়টা হাহাকারের- সময়টা মন্দের। তারমাঝেও ভালো থাকার প্রয়াসে আবার নেতিবাচকের কালিমা কারও জন্য মঙ্গল নয়।
এই নতুন বর্তমানে সবাই ঘরে আনন্দে থাকুক এটাই হোক প্রার্থনা।