Published : 16 Jun 2020, 12:48 PM
বাজেট নিয়ে কোনো আলোচনায় আমি তেমন উৎসাহ বোধ করি না। অর্থনীতি বুঝি না। বাজেটও বুঝি না। লক্ষ কোটি টাকার হিসাব, জিডিপি, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়গুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে যায়। দীর্ঘদিন, বলা যায়, বছরের পর বছর ধরে দেখে আসছি, প্রতি বছর সংসদে বাজেট পেশ করা হয়। কয়েকদিনের আলোচনা শেষে তা পাস হয়। নতুন অর্থবছর শুরু হয়। শেষ হয়। এটা যেন একটি রুটিন। অর্থ বছরের শুরু কেন মধ্য বছর থেকে হয়, কেন বছরের শুরুতেই নয়, এসব নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এসব গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে ভাবার জন্য দেশে অনেক মাথা মোটা বা মাথা ভারী মানুষ আছেন তারা এসব নিয়ে ভাবেন, লেখেন, বলেন। কিন্তু তাতে লাভ কী হয় তা-ও আমি বুঝতে পারি না।
যারা বাজেট পেশ করেন তারা মনে করেন সেরা বাজেটই তারা দিয়েছেন। তাদের বাজেট গণমুখী। তাদের বাজেট বাস্তবায়ন হলেই মানুষের জীবন থেকে সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। আবার, যারা টেবিলের অন্য দিকে থাকেন, তারা কোনো বাজেটেরই প্রশংসা করেন না। তাদের কাছে বাজেট গণবিরোধী এবং গরিব মারার কল। গরিব মানুষ কি জানেন, বাজেটে তাদের নিয়ে টানাটানির কথা? বাজেটের কারণে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।
এবার একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্য বাজেট পেশ করা হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, এবারের বাজেট গতানুগতিক হবে না। করোনা-ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ সামগ্রিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের যে দুর্বলতাগুলো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে তা মোকাবিলার অভিপ্রায় এবারের বাজেটে প্রতিফলিত হবে। কিন্তু তা হয়েছে বলে মনে হয় না। আমরা উন্নয়নের চমক থেকে চোখ সরাতে পারছি না। মানুষ এবং মানুষের জীবন নয়, আমাদের আগ্রহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে। আমরা স্থায়ী স্বস্তির কথা ভাবি না, সাময়িক চোখ জুড়ানোতেই আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। আমাদের নজর পরিসংখ্যানে, গুণগত মানের দিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। উন্নয়ন নিয়ে আমাদের গর্বের, দর্পের শেষ নেই। আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নত দেশের কাতারে নাম লেখানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছি। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন মান নিয়ে আমাদের কোনো উদ্বেগ নেই। মানুষ খেতে পারছে, সবার পরনে কাপড় আছে – এটাই যেন আমাদের উন্নয়ন দর্শন।
শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নিয়েও আমরা এক ধরনের ছেলে ভোলানো গল্প করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়। পথে ঘাটে মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ আমাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে স্থান পায় না। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন বছর বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে একটি সার্টিফিকেট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছে না। মানব সম্পদ তৈরি না করে এই যে শিক্ষিত বেকার তৈরির কারখানা আমরা খুলেছি, এর পরিণতি কী?
আমাদের দেশে মেডিকেল কলেজের সংখ্যাও এখন অনেক। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। কী লাভ হচ্ছে তাতে? মানুষ কী প্রয়োজনীয় এবং মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে? অনেক মানুষ বিনাচিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। কেউ আবার চিকিৎসা নিয়েও মারা যাচ্ছে।
আমাদের স্বাস্থ্যখাতে বাজেটে বরাদ্দ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম। তারমানে স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টি আমাদের কাছে অবহেলার, উপেক্ষার। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি সবসময় উপেক্ষা করা হয়। জীবন-মৃত্যুর বিষয়টি আমরা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছি। করোনাভাইরাসের হামলায় আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যে কতটা ভঙ্গুর, বেহাল সেটা স্পষ্ট হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কম। তারপরও লুটপাট ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বদলে কিছু মানুষের মোটাতাজা হওয়ার পথ সুগম হয়েছে। আমাদের সব লক্ষ্য মুনাফাকেন্দ্রিক, সেবাকেন্দ্রিক নয়।
এবার বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কিছু বেড়েছে। কিন্তু এই সামান্য বৃদ্ধি জনকল্যাণ নিশ্চিত করবে বলে মনে হয় না। আসলে, বাজেটের রাজনৈতিক দর্শনটা যতক্ষণ পরিষ্কার না হবে ততক্ষণ বাজেটে নামমাত্র বরাদ্দ বাড়িয়ে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।
করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য বাজেটে দশ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ছাড়া থোক বরাদ্দ কি কোনো সুফল দেবে? থোক বরাদ্দ বিষয়টি এমনিতেই গোলমেলে। বলা হয়ে থাকে, থোক বরাদ্দ মানে থোক দুর্নীতি। আমরা ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পাই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি আমাদের। শুনতে ভালো লাগে। প্রশ্ন হলো, কোন দুর্নীতিবাজের জেল-ফাঁসি হয়েছে? কোন অনিয়মর তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেছে? কোন তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে?
এই যে আমরা উন্নয়নের বড়াই করি, সেটা কিসের জোরে, কিসের ভিত্তিতে? পরিসংখ্যান কপচে কেউ কেউ আনন্দ পান। অথচ দেখুন, পরিসংখ্যান কী বলছে? রোগীর অনুপাতে ডাক্তারের সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম। মালদ্বীপের মতো দেশে প্রতি দশ হাজার রোগীর জন্য ডাক্তার আছেন ২২.৩ জন, আমাদের চিরশত্রু পাকিস্তানে ৯.৭ জন, শ্রীলংকায় ৯.৫ জন, মিয়ানমারে ৮.৬ জন, ভারতে ৭.৭ জন, নেপালে ৬.৫ জন। আর বাংলাদেশে মাত্র ৫.২ জন।
আমাদের দেশে এমবিবিএস ডাক্তার ও ডেন্টিস্টের সংখ্যা মোট ৮৬ হাজার ৮০০ জন। এরমধ্যে সরকারি চাকরিতে আছেন ২০ হাজারের মতো। তার মানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতি ১০ হাজার রোগীর চিকিৎসা পাওয়ার জন্য ডাক্তার আছেন মোটে ১.২ জন।
করোনাভাইরাসের আক্রমণ না হলে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের মারাত্মক সব ঘাটতির বিষয়গুলে হয়তো এত প্রকটভাবে সামনেও আসত না। নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করে অনেক চিকিৎসকের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতেও দ্বিধা করা হয়নি। আমাদের কিছু চিকিৎসকের হয়তো সংবেদনশীলতার চেয়ে অর্থের 'খাই' বেশি। কিন্তু সৎ, মানবিক চিকিৎসকও তো আছেন। তাদের জন্য আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র কী আলাদা করে কিছু ভাবে?
ব্যর্থতা বা দোষ আড়াল করার জন্য ঢাল ব্যবহারে আমরা ওস্তাদ। যেমন এখন বলা হচ্ছে, উন্নত ধনী দেশগুলোই যেখানে ধুঁকছে, সেখানে আমরা তো তুলনামূলক ভালোই আছি।
আমি বুঝতে পারি না, আমাদের চোখ সবসময় শুধু উপরে ঘোরে কেন? কেন আমরা আমাদের মতো বা আমাদের চেয়ে ছোট দেশগুলোর দিকে তাকাই না? এটা কি আমাদের এক ধরনের হীনম্মন্যতা? ছোট অর্থনীতির দেশগুলো কীভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফল হলো, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এগিয়ে থাকলো – সে দৃষ্টান্ত কেন আমাদের সামনে আসে না?
চীনের প্রতিবেশী দেশ ভিয়েতনাম। ৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষের এই দেশটিতে একজনও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেননি। রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩২৮ জন। সবাই সুস্থ আছেন। ভিয়েতনাম নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও তেমন উন্নত নয়। তাহলে তারা কীভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফল হলো? তাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে দ্রুত এবং সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ। ভিয়েতনাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার অপেক্ষা না করে সৃজনশীল কৌশল গ্রহণ করেছে। বাইরের দেশগুলোর ডেটা থেকে নিজেদের দেশের পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, সেটা কল্পনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে সরকার একটুও গড়িমসি করেনি।
আমরা পারি না, কারণ আমাদের মাথায় সবকিছু থেকেই ফায়দা লোটার বিষয়টি আগে আসে!
ছোট দেশ কিউবা। আমেরিকা এই দেশটিকে ধ্বংস করার জন্য কতো চেষ্টা-অপচেষ্টাই না করেছে, করছে। অথচ স্বাস্থ্যসেবায় কিউবার কী বিস্ময়কর সাফল্য! কিউবার স্বাস্থ্যসেবার মান বহু ধনী দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিউবায় রোগীকে ডাক্তার খুঁজতে হয় না, ডাক্তারই রোগীর দোরগোড়ায় হাজির হয়। কিউবায় সবার জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে রোগ আসার আগেই তা ঠেকিয়ে দেওয়া হয় অর্থাৎ চিকিৎসার বদলে প্রতিরোধক দৃষ্টিভঙ্গি।
আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা কী কেউ কিউবার নাম শোনেননি? তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় 'কিউবা মডেল'-এর কথা ভাবা হয়নি কেন? সম্ভবত ওই মডেলে গেলে বালিশ-কাণ্ড, পর্দা-কাণ্ড এবং মাস্ক-কাণ্ড ঘটানোর সুযোগ কম।
বাজেটের আয়-ব্যয়ের বড় বড় অংক আমাকে দিশেহারা করে তোলে। কিন্তু আমি তেমন একটি বাজেট এবং বাজেট বক্তৃতার অপেক্ষায় আছি, যাতে লক্ষ হাজার কোটি টাকার অংকের হিসাবের সঙ্গে মানুষের কল্যাণচিন্তাও ঠাঁই পাবে। বাজেট যে আমার জন্যও সেটা না বুঝলে আমি কীভাবে বাজেট ভাবনায় মশগুল হবো?