Published : 08 Jun 2020, 06:20 PM
বার বার সাবধান করার পরও আমাদের দেশের মানুষ মানেননি। এখনো কথা শুনছেন না। এই মনস্তত্ব বোঝা মুশকিল কিন্তু কঠিন কিছু না। এ প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগে বলতে চাই কে ভালো আছে, কারা নিরাপদ আসলে? কেন আপনি আপনারা বুঝতে পারছেন না এই মহামারীর কোনো ঔষধ নাই? থাকলে আপনার কি মনে হয় মোর্শেদ খান পত্নীকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতেন? দেশত্যাগ করতেন সালমান এফ রহমানের ভাই? এরা তো তাও লিগ্যাল যাত্রা করেছে। মাথার ওপর হুলিয়া নিয়ে ভেগেছে দুই ভাই, শিকদারদের বংশদণ্ড তথা বংশগৌরব। আপনি এটাও জেনে রাখেন পরিস্থিতি বুঝে আরো বহু মানুষ উড়াল দেয়ার জন্য দিন গুনছে। সে সংখ্যা কত হতে পারে হয়তো আমাদের ধারণাও নাই। এই ভাগার বা ভেগে জান বাঁচানোর দেশগুলো কি নিরাপদ বেহশত? একটুও না। বিলেত ইউরোপ যে চড়া মূল্য দিয়েছে তা আমরা চোখে দেখেছি। কিন্তু আমরা অন্ধ তাই আমাদের চোখ খোলেনি।
একটা বিপজ্জনক প্রবণতা আছে আমাদের। নিজের দোষ পরের ওপর চাপানো। 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে' এই প্রবাদটি আর কোনো ভাষায় আছে বলে শুনিনি। দেখবেন কি অনায়াসে চিকিৎসা সেবা, ডাক্তার-নার্স আর সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে করোনাভাইরাসের দায়মুক্ত হচ্ছে মানুষ। তারা মুখে মুখে ডাক্তার-নার্সদের স্যালুট জানাচ্ছে বটে, প্রশ্ন করলেই শুনি ডাক্তার ভালো করে দেখেননি, নার্স সেবা দেয়নি তাই মারা গেছে। সরকারের বিরুদ্ধে যে কি কঠোর মনোভাব সেটা টের পেতে বুদ্ধি প্রয়োগেরও দরকার পড়ে না। সব দোষ নন্দ ঘোষের বলে যে কথাটা চালু তার একটু পরিবর্তন করে বলবে সব দোষ হাসিনা ঘোষের। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন , এখন একাধিক সেলিব্রেটি নেতা, মানুষ করোনাভাইরাসে শয্যাশায়ী। এদের একজন গণস্বাস্থ্যের জাফরুল্লাহ সাহেব আর একজন প্রাক্তন মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সামাজিক মিডিয়া বলে দেয় মানুষ কার আরোগ্যের জন্য ব্যাকুল। অন্যজন মারা যাক এ কথা বলছে না বটে কিন্তু কি চাইছে তা তাদের ভাষা আর আর না বলা কথাতেই স্পষ্ট। বলাবাহুল্য এর জন্য সরকারি দলের কর্মকাণ্ড দায়ী। দায়ী তো তাদের নেতারা। এককেন্দ্রিক ক্ষমতা আর বিপুল টাকা পয়সা কামানো নেতাদের কেউই জনগণের মনের ভাষা বোঝেনি। এই দুর্দিনে একজনও মাঠে নাই। ডি.এল রায়ের কবিতার মতো, তাই শুয়ে শুয়ে কষ্টে বাঁচিয়া রহিল নন্দলালের কেউ নাই। না আওয়ামী লীগ, না বিএনপি, না অন্য কারো অন্য কোনো দলের। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের রাগ গিয়ে পড়ছে সরকারি দলের ওপর। অথচ এক বিশাল সংখ্যক চোরের দলকে ইতোমধ্যে সাইজ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অতীতে কখনো এতগুলো জনপ্রতিনিধি গ্রেপ্তার বা আটক হয়েছে? না শাস্তি পেয়েছে? তারপরও মানুষ তাদের ওপর অসন্তুষ্ট।
বলছিলাম জনগণের কথা। স্বাধীনতা বিষয়টি নিজেই স্বাধীন। কাজেই যার যা খুশী ভাবতেই পারে। কিন্তু তারা একবারও ভাবেন বা ভাবেন না তারা কি করছেন? আমাদের দেশ না সিঙ্গাপুর না মালয়েশিয়া। আওয়ামী নেতারা মুখে যাই বলুক তারাও ভালো জানে সে পথ পাড়ি দিতে আরো অনেক সময় লাগবে। এই উন্নয়নশীল নামের মূলত দরিদ্রসীমার দেশে সরকার এ পর্যন্ত যা করেছে তা কি সত্যি কম? মীর্জা ফখরুল বা ড. কামাল হোসেন চোখ বন্ধ করে তা বলতে পারেন। কিন্তু বিবেক থাকলে আপনি ভালো করে তাকিয়ে দেখুন সরকার কী কী করেছে। তার বিনিময়ে মানুষ সরকারকে কী উপহার দিয়েছে? এমন দেশে বিজিএমইএ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। তাদের ওপর আমাদের আয় রোজাগার নির্ভরশীল। কিন্তু নেত্রী রুবানা হকের আচরণ কি করোনাভাইরাস সহায়ক না বিরোধী? একবার তিনি শ্রমিকদের ডেকে এনে সংক্রমণ বাড়ালেন তারপর ফেরত পাঠিয়ে তা দ্বিগুণ করলেন। এখন বলছেন ছাঁটাই করবেন। সরকারের দিক থেকে কঠিন হতে না পারা আর ব্যবস্থা না নেয়া হচ্ছে গাফেলতি। কিন্তু এত উঁচু স্তরের একজন ব্যবসায়ী নেতা এমন আচরণ করেও পার পায় কীভাবে? সমাজ কি এতটা অন্ধ আর বোবা যে এগুলো গায়ে মাখে না, চোখে দেখে না?
মানুষজন জানাজা থেকে বিয়ে, বিয়ে থেকে বাজার, গণপরিবহন কোথাও নিয়ম মানে না। খবরে দেখি বাজারে মাইক্রোফোন হাতে ঘুরে বেড়ানো রিপোর্টাররা প্রশ্ন করলে কেউ বলে, মাস্ক আছে এইমাত্র পকেটে রাখছি। কেউ বলে কথা বলার জন্য খুললাম মাত্র। কেউ বলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তাই পরি না। যদি তাই হয় আপনি শেষ নিঃশ্বাস ডেকে আনতে বাইরে আসেন কেন? ঘরে থাকেন। মানুষের এমন সব কথা শুনলে আপনার মাথা গরম হতে বাধ্য। যুবক তরুণ-তরুণীরা তো ঈদের আগে বলে দিয়েছে আমরাই এন্টি ভাইরাস আমাদের কিছু হবে না। কারো মতে ঈদ বড় না করোনাভাইরাস বড়? মুশকিল হলো আমরা এখন রোমের পাদ্রীর চাইতেও বড় খ্রিস্টান বা আরবের চাইতেও খাঁটি মুসলমান। এই ধরনের গোয়ার্তুমি জাতিকে কোনদিকে নিয়ে গেছে বা কি আছে সামনে তা এখন আর বলে বোঝাতে হবে না।
আর একটা প্রবণতা হলো সত্য অস্বীকার করে অন্ধ বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করা। ভাবছেন শুধু দেশে? আমাদের সিডনির ঘটনা শুনুন। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে পরিবেশ, কদিন ধরে কেসের সংখ্যা প্রায় শূন্য। কিন্তু সরকার এখনই সব খুলতে নারাজ। তারা টেস্ট কেইস হিসেবে বাড়ি-ঘরে সর্ব্বোচ্চ পাঁচ জনের অনুমতি দিয়েছে। ব্যাস। উৎসবের নামে এক এক পরিবার যতজন ডেকেছিল ততজন ফাইন বা জরিমানা খেয়েছে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় এক লাখ করে। আর বাড়ির কর্তার জরিমানার যা পরিমাণ তাকে এই টাকা শোধ করতে হবে আগামী দশ বছরে। জেনে অবাক হবেন না ভারতীয়-পাকিস্তানি, আরবীয় কেউ তা করেননি করেছে বঙ্গসন্তানের দল। এমন জাতিকে বাগে রাখা সহজ? দেশে সরকারের কোন কথাটা মানুষ মন দিয়ে শুনেছে বা মেনেছে? যারা বলেন গরীব, দরিদ্র মানুষেরা কি করে মানবে, তাদের কথায় আবেগ যতটা, যুক্তি তত নাই। এরা সাহায্য পেয়েছেন। প্রচুর অনুদান পাচ্ছেন। আর তারা যদি বাধ্য হয়ও তারা কিন্তু তেমন ভাবে আইন ভাঙেনি যেভাবে বাজার হাটে নিয়ম ভাঙছে টাকা পয়সাওয়ালা মানুষজন। আপনি বাজারে গেলেই দেখবেন কারা গিজগিজ করছে সেখানে? গরীবেরা না পকেটে টাকা নিয়ে ঘোরা মানুষেরা? বাজার সব দেশে, সব জাতিতেই খোলা। যখন পরিস্থিতি খারাপ ছিল আমরা এখানে বাজারে যেতাম চোরের মতো। কোনো রকমে দরকারি জিনিস কিনেই দৌড় লাগানো বা গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরায় মনে হতো কেউ মাল চুরি করে নিয়ে ফিরছে। তেমন কোনো দৃশ্য আছে বাংলাদেশে? ড্যাম কেয়ার মনোভাবের ফলে যে মাশুল দিতে হচ্ছে আর হবে সেটা ঠেকাতে ঘরে থাকার এখনো কোনো বিকল্প নাই।
এ লেখা যখন লিখছি তখন মন্ত্রী বীর বাহাদুরও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। প্রাক্তন-বর্তমান কোনো মন্ত্রী-মিনিস্টার, আমলা বা ব্যবসায়ী, সুধীজন বা গরীব-হতদরিদ্র কাউকে ছাড়বে না এই করোনাভাইরাস। চট্টগ্রামে আমার দিদির বাড়ির উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী মারা গেছেন করোনাভাইরাসে। তার নার্স পত্নী ও হাসপাতালে। মারা গেছেন প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব কায়কাউস রানার বড় ভাই আমার শ্রদ্ধাভাজন বন্ধুসম অগ্রজ কবি আহমেদ খালেদ কায়সার। কিন্তু সময়টা এমন কেউ কারো কাছে যেতে পারবে না। এটা নিষ্ঠুরতা বা অমানবিকতা না। এর কারণ আপনি একা না যাবার মাধ্যমে পরিবার পরিজনসহ দেশের মানুষকে রাখবেন নিরাপদ। এখন যারা যাবেন তাদের এই একাকী যাত্রা করুণ হলেও ইতিহাস। করোনাভাইরাস থেকে মরতে মরতে ফিরে আসা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনই প্রথম বলেছিলেন, 'তৈরি থাকো মানুষ। তোমার প্রিয়জনদের গুডবাই বলতে হবে'। তখন আমরা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এটাই সত্য। নিকটতম প্রতিবেশী বা নিকটতম মানুষকেই আজ নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী করে দিয়েছে এই মহামারী।
বাংলাদেশে এখন পিক টাইম। জনগণ যদি তা না বোঝেন তবে কেউ কাউকে বাঁচাতে পারবেন না। মানুষ তুমি সংযত আর সাবধানী হতে শেখো।