Published : 31 May 2020, 04:07 PM
বৈশ্বিক মহামারীতে পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়। গবেষকদের ভাষায় প্রতি ১০০ বছর অন্তর এমন প্রলয়ঙ্কারী পরিবর্তন পৃথিবীর এক ধরনের আদিমতা বা অকৃত্রিম খেলা, অনেকটা পুনর্জন্মের মতো।
এই আমরাই এতকাল ধরে বলে এসেছি "চল সব করি একসাথে…." ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের ভয়ে আজ বলছি, "চল আজ থাকি দূরে দূরে…"। কিন্তু চাইলেই কি দূরে থাকা যায়? যেমনটি পারেনি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সকল শিক্ষার্থী ও সম্মানিত শিক্ষকগণ। করোনাকালে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন ক্লাস ও ল্যাব বন্ধ করে সেশনজট আর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষছে, ঠিক তখনই ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় এক দিনের জন্যেও ক্লাস বন্ধ না রেখে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। বিশেষ করে স্থাপত্য বিভাগ তাদের নিয়মিত থিওরি ও ডিজাইন ক্লাসের পাশাপাশি ডিজাইন ক্লাসের মূল্যায়ন পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে করে দেশের স্থাপত্য অঙ্গনে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে।
বিষয়টি পুরোপুরিভাবে বুঝতে গেলে আমাদের জানা দরকার স্থাপত্যের ডিজাইন ক্লাসে কিভাবে পড়াশোনা সম্পন্ন হয়। এখানে প্রতি সেমিস্টারে বিভিন্ন লেভেলের ছাত্রছাত্রীরা দুই বা ততোধিক প্রজেক্ট বা প্রকল্প পরিকল্পনা করে থাকেন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে থাকে শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর ধাপে ধাপে অসংখ্য দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে প্রতিটি বৈঠক প্রতিটি ছাত্র বিশেষে মৌলিক হয়ে থাকে। তাই এক্ষেত্রে ক্লাসের সকল ছাত্রের একসাথে অংশগ্রহণের মতো সামগ্রিক কোনো পদ্ধতির ব্যবহারের সুযোগ কম। তবে বৈঠকগুলো ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় একটি বিষয়। বিশেষ করে ফাইনাল বৈঠক বা ফাইনাল জুরিতে অন্যান্য লেভেলের ছাত্র ও শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ স্থাপত্য শিক্ষায় অনেকটা উৎসবে রূপ নেয়।
এখন প্রশ্ন হলো প্রযুক্তি যখন আমাদের এত সহজ সব ব্যবস্থা দিয়ে রেখেছে, তখন আমাদের ঘরে বসে কি হতাশার প্রহর গোনা মানায়! বরং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টার সুযোগ তৈরি করে।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়েই ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের পঞ্চম বর্ষের একদল শিক্ষার্থী তাদের ডিজাইন শিক্ষক সাবরিনা রহমানের অনুপ্রেরণায় অনলাইনে তাদের ফাইনাল প্রজেক্টের জুরি সম্পন্ন করেন। বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃত গুগলের মিটিং অ্যাপ "গুগল মিটের" মাধ্যমে পূর্ব নির্ধারিত সময়ে এই জুরি সম্পন্ন হয়। পুরো ব্যাপারটি সফলভাবে সম্পন্ন হয় অত্যন্ত ফলপ্রসূ পরিকল্পনার কারণে। যেহেতু জুরি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং সময়টি রমজান মাস হওয়ায়, ১৪ জন শিক্ষার্থীকে দুই দিনে ভাগ করে নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের ডিজাইনের বিষয় ছিল তাদের নিজ নিজ উপজেলায় ১০০ বেড বিশিষ্ট একটি উপজেলা হাসপাতাল ডিজাইন করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে মডেল বানানোর সুযোগ নেই বলে নকশা ও ত্রিমাত্রিক চিত্রই ডিজাইন প্রকাশ করতে সাহায্য করবে। প্রতিটি শিক্ষার্থী তাদের প্রজেক্টগুলোর পরিকল্পনার পূর্ব প্রস্তুতি, নকশা, পার্শ্বচিত্র, ছেদচিত্র ও ত্রিমাত্রিক চিত্রের মাধ্যমে প্রেজেন্টেশন তৈরি করেন, যা আগেই তাদের শিক্ষকের কাছে অনলাইনে জমা দেওয়া ছিল। এরপর পূর্ব নির্ধারিত সময়ে বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে গুগল মিটে জুরি শুরু হয়। অ্যাপসটি অত্যন্ত সহজ ও ব্যবহার বান্ধব হওয়াতে অনেকেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এমনকি স্টাডি লিভে থাকা বিভাগের একজন শিক্ষকও সুদূর জার্মানি থেকে প্রথমদিনের জুরিতে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বিভাগের অ্যালামনাই শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি শিক্ষার্থী গড়ে প্রায় ৪০ মিনিট করে সময় পান তার প্রকল্প উপস্থাপন ও প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য।
প্রথম দিনে দীর্ঘ চার ঘন্টার অভাবনীয় সাফল্যের পর দ্বিতীয় দিনে আকর্ষণ তৈরি হয় এক্সটারনাল জুরার, আর্কিটেক্ট মোহসেনা সিদ্দিকার উপস্থিতিকে নিয়ে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের স্থাপত্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল বিষয়ক ডিজাইন বিভাগে কর্মরত আছেন। দেশের অসংখ্য হাসপাতাল পরিকল্পনা ও পরিবর্ধন তার নকশায় হয়েছে। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বের অনেক জুরিতে উপস্থিত থেকে তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। তাই বিভাগের শিক্ষক ও সহকারী প্রধান সাবরিনা রহমানের অনুরোধে তিনি ২য় দিন অত্যন্ত সহজে অনলাইন জুরিতে তার মূল্যবান উপস্থিতির মাধ্যমে ছাত্রদের উপকৃত করেন। তিনি বিভাগের ছাত্রদের ডিজাইনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে এগুলোর সফলতা তুলে ধরেন। এমনকি একজন ছাত্রের ডিজাইনটি বাস্তবে কন্সট্রাকশন হওয়ার প্রপোজাল থাকায় তিনি ব্যক্তিগতভাবে পরবর্তী সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। বিভাগের সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষদের জন্য এটি ছিল একটি অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা। তাছাড়া পুরো আলোচনাটি রেকর্ড করা হয়, যা পরবর্তীতে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের হাসপাতাল ডিজাইন করতে অত্যন্ত সাহায্য করবে যার কোন অবকাশ নেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটি স্থাপত্য অঙ্গনে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। কেননা, বাংলাদেশে স্থাপত্য পড়াশোনায় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের এই অনলাইন জুরি সর্বপ্রথম হওয়াতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঠিক পুর্বপরিকল্পনার জন্য এই পুরো ব্যাপারটি সম্ভব হয়েছে বলে স্থাপত্য বিভাগ মনে করে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৫ সাল থেকেই তাদের নিজস্ব অনলাইন কার্যক্রমে আংশিক শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ এ বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। এরই সাথে মার্চ মাসের প্রথম থেকেই তারা অনলাইনে কিভাবে ক্লাস সম্পন্ন করা যায় এ বিষয়ে শিক্ষকদের অবগত করেন বিভিন্ন ট্রেনিং এর মাধ্যমে। শিক্ষকরা লকডাউন শুরু হবার পূর্বেই ছাত্রদের ডেমো ক্লাস নিয়ে পুরো বিষয়টির সাথে পরিচিত করান। এখানে উল্লেখ্য যে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে সকল শিক্ষার্থীর কাছেই স্মার্টফোন ও ল্যাপটপ অত্যন্ত সহজলভ্য। আর যাদের নেই তাদের জন্য রেকর্ডিং এর ব্যবস্থা আছে যা কিনা শিক্ষার্থীরা সুবিধামতো সময়ে দেখতে পারে। যেহেতু লকডাউনে কতদিন থাকতে হবে তা কারো জানা নেই তাই এই মূল্যবান সময়ে হতাশায় জর্জরিত না হয়ে সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকার জন্য অনলাইন ক্লাস ও জুরির কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক খায়রুল এনাম। তিনি আরো আশ্বস্ত করেন যে, শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে "Financial Aid during Crisis of COVID-19" নামে একটি নতুন ওয়েভার চালু করেছে।
তাই আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, পূর্বপ্রস্তুতি, সময় ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার, সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ইত্যাদি সব উপমা দিয়েই অনলাইন ক্লাস নিয়ে এক্সপেরিমেন্টকে যথোপযুক্ত ও যুগোপযোগী একটি পদক্ষেপ হিসেবে মেনে নেওয়া যায়। কোভিড-১৯ ভাইরাসের কাছে হেরে না গিয়ে বরং একে সাথে নিয়েই বাসায় থেকে কী করে স্থাপত্যের মত বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া যায় ড্যাফোডিলের স্থাপত্য বিভাগ যেন তারই এক বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।
সবাই বাসায় থাকুন ও সুস্থ থাকুন। ড্যাফোডিল স্থাপত্য বিভাগের পরবর্তী জুরিগুলো লাইভ টেলিকাস্ট করার পরিকল্পনা চলছে। সবাইকে সেখানে অংশগ্রহনের বিনীত আমন্ত্রণ রইল।