Published : 18 May 2020, 08:23 PM
প্রিয় বিশ্ববাসী,
বর্তমানে কোভিড-১৯-এর কারণে বিশ্ব যে মহাসংকটকাল পার করছে, তা প্রাথমিকভাবে একটি ভাইরাস বা একটি রোগের সাথে সংগ্রাম হলেও, শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রাম রূপ নেবে একটি অর্থনৈতিক সংগ্রামে, যার শুরু ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। এই সংগ্রাম ক্রমাগত ঘনীভূত হতে থাকবে এবং বিশ্বব্যাপী নেমে আসবে এক অর্থনৈতিক মহাবিপর্যয়। এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন দেশে বিবিধ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আমরা যদি প্রচলিত অর্থনিতির রীতিনীতি আমলে আনি, তাহলে বিবিধ পদক্ষেপ নেয়া হবে এটাই স্বাভাবিক।
তবে একটি যৌক্তিক প্রশ্ন আসতেই পারে, তা হল, অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে কেন এত তাড়াহুড়া? কোভিড ১৯-এর সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে না এনেই সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে দেয়া হচ্ছে কেন? বিভিন্ন পদক্ষেপে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তেই অর্থনীতির চাকা না ঘোরালে, এ চাকা আর কোনোদিন ঘুরবে না — হয়তো সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রচলিত অর্থনীতির বিধিবিধান এই দিকনির্দেশনাই দিয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে এসে অর্থনীতির বিকল্প-তত্ত্ব অনুসন্ধানের কি কোনো সুযোগ ছিল না? করোনা ভাইরাস বিশ্বের অর্থনীতিকে যে বাস্তবতাকে দেখিয়ে দিয়ে গেল, তাতে হয়তো এটাই ভাবা উচিৎ ছিল যে অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রচলিত বিধিবিধানে যাই থাকুক না কেন, তার বাইরে এসে নতুন কাঠামোর অর্থনীতির খোঁজ করাটাই হবে যৌক্তিক। অর্থাৎ পুরাতন অর্থনীতি-তত্ত্বের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে নিরীক্ষণের মধ্যে দিয়ে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা।
করোনাভাইরাসের গতিপ্রকৃতি আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি এবং আমরা জানি না যে শেষ পর্যন্ত এই ভাইরাসটি কোথায় গিয়ে থামবে। এমন কি আমরা এও বুঝে উঠতে পারিনি, আক্রান্ত মানুষের উপর শারীরিক এবং মানসিকভাবে এই ভাইরাসটি ভবিষ্যতের জন্য কী প্রভাব রেখে যাচ্ছে? সুস্থ হবার পরেও আক্রান্তরা ভবিষ্যৎ কোনো শারীরিক বা মানসিক ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাচ্ছে কি না। এসবের কোনো কিছুকেই বিবেচনায় না নিয়ে, যে কোনো মূল্যে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এতে যদি মিলিয়ন-মিলয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে তাতেও কোন সমস্যা নেই- বিশ্বনেতারা হয়তো এমনই ভাবছেন।
অনেকের মনেই প্রশ্ন, করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ না করে, অর্থনীতিকে অধিক গুরুত্ব দেয়া কি এতটাই জরুরি ছিল? আমরা চাইলে কি বৈশ্বিক সম্মিলিত উদ্যোগে নির্দিষ্ট সময়ে, ধরে নেয়া যাক ৩ অথবা ৪ মাসের মধ্যে এই ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না? আমাদের বিশ্বনেতারা কি চেষ্টা করেছেন সমন্বিত উদ্যোগ এবং প্রায় অভিন্ন দিকনির্দেশনার মধ্যে দিয়ে এই বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলার? বিভিন্ন দেশে বিচ্ছিন্ন এবং অপরিকল্পিত বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তাতে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হল না। বিচ্ছিন্ন এবং অপরিকল্পিত পদক্ষেপে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না এটাই স্বাভাবিক। কারণ একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আধা-লকডাউন এবং আধা-স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলে কিছু নেই। করোনাকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশ্বব্যাপী পূর্ণ-লকডাউন এবং মৃত্যুর হার কমাতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদক্ষেপের বিকল্প নেই। হতে পারে তা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে।
তবে এটি ঠিক যে এর জন্য প্রয়োজন হবে বিলিয়ন-বিলিয়ন অর্থ। পূর্ণ লকডাউন মানেই বিলিয়ন মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া, আবাসনসহ সকল দায়িত্ব নেয়া। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এই বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ কোত্থেকে আসবে? উত্তর একটাই, যাঁদের ভাণ্ডারে অর্থ আছে, তাদের কাছ থেকেই এই অর্থ আসতে হবে। অর্থভাণ্ডার থাকে রাষ্ট্রের কাছে, বিভিন্ন আর্থিক-ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে, আর ধনকুবেরদের কাছে। তাহলে আবারও প্রশ্ন আসতে পারে, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি, যে কোষাগারেই অর্থ রক্ষিত থাকুক, তা তারা উজাড় করে কেন দেবে? উত্তর এইটাই যে, করোনাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ের অর্থ, যে কোষাগারেই সঞ্চিত থাকুক না কেন, তা একপর্যায়ে হয়ে উঠবে অর্থহীন। করোনাকে নিয়ন্ত্রণ না করে যদি কেউ ভাবেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হবে, এটি একটি ভুল ভাবনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর তাই করোনা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ের কোষাগার যদি শূন্যও হয়ে যায়, তথাকথিত অর্থনীতির চাকা যদি থেমেও যায়, তা মেনে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে রাষ্ট্র, আর্থিক-ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং ধনকুবেরদের। মানুষ বেঁচে থাকলে, নতুনভাবে শুরু করতে পারবে বিশ্বঅর্থনীতি। মানুষের অবশ্যই সেই সক্ষমতা আছে। বিভিন্ন সময়ে মানুষকে নতুনভাবে শুরু করতে হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় যদি ভবিষ্যত বিশ্বঅর্থনীতিকে নতুনভাবে শুরু করতে হয়, তাহলে তাই করতে হবে। বিশ্বের সকল মানুষকে এমন সদ্ধান্ত নিয়েই রাখতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
নতুনভাবে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সময় এও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে যে বৈশ্বিক অর্থনীতি যেভাবে পরিচালিত হয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে, তা কি যথাযথ ছিল? নাকি মানবজাতিকে ক্রমাগত হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল? পর্যালোচনা করতে হবে, বৈশ্বিক যে জলবায়ুর বিপর্যয়, তার পেছনে লাগামহীন অর্থনীতি কতটা দায়ী ছিল? আমরা কি যথেচ্ছ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আকাশকে কালো ধোঁয়ার আবরণে ঢেকে দেইনি? বর্তমান বাস্তবতা আমাদের বলে দিচ্ছে, প্রকৃতিবিরুদ্ধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসমূহ নিরূপণ করার সময় এসেছে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে এমন এক বিপর্যয়ের পরেও অর্থনৈতিক অবস্থার সংকটকে যতটা বিবেচনায় আনা হচ্ছে, তার সামান্যতম অংশও পরিবেশ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের একটি সম্পর্ক আছে, তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত না হলেও, এই সম্পর্ককে উড়িয়ে দেয়া তো যায়ই না, বরং বিশ্ববাসীকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে এই বিষয়টি বিচারবিশ্লেষণপূর্বক গভীরভাবে বিবেচনায় আনতে হবে।
তাই একজন বিশ্বনাগরিক হিসেবে মনে করি যে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে পরিবেশ বিপর্যয়কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া উচিৎ। বর্তমান বাস্তবতায় যেসব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকৃতিবিরুদ্ধ তা সুনির্দিষ্ট করে শুধু নিরূপণের সময়ই আসেনি, সময় এসেছে প্রকৃতিবিরুদ্ধ সকল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করে দেয়ার। সাদা চোখে বোঝা যায় যে স্থাপত্য, পরিবহন, ফ্যাশন, আহারের আধিক্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলা হয়েছে। আর সর্বোপরি রয়েছে যুদ্ধবিগ্রহ এবং প্রতিযোগিতায় নামা ক্ষমতা-প্রকাশের লাগামহীন ঘোড়া। এই সকল কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রকৃতিতে।
আমরা জীবন এবং জীবিকা যাই বলি না কেন, এই দুইয়েরই ভিত্তি হল প্রকৃতি। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার পথ খুঁজে নেয়া হবে আমাদের প্রধানতম দায়িত্ব। আর আমাদের এই পথ খুঁজে নিতে হবে প্রকৃতির ভেতর থেকেই। অর্থাৎ প্রকৃতিলব্ধ জ্ঞানের আলোকে নির্মিত পথেই সন্ধান করতে হবে জীবন, জীবিকা এবং আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ। আর প্রকৃতি থেকে এই পথের সন্ধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বিজ্ঞান।
প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নতুন কিছু উদ্ভাবন করে না, অতি ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ বস্তুকে ব্যখ্যা করে। পরামাণুর ভেতরের নিউক্লিয়াস থেকে মহাবিশ্ব, কতকিছুকেই ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে এই প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। কত উচ্চমার্গীয় চিন্তার সমাবেশ ঘটেছে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে- যা সাধারণ মানুষের বোধের অতীত। আবার পদার্থের গতিপ্রকৃতির কিছু ব্যাখ্যা, যা সাধারণ মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম। যেমন, বরফ, পানি এবং জলীয় বাষ্প, একটি পদার্থের তিনটি অবস্থান এবং অবস্থান যাই থাকুক না কেন, এই যৌগিক পদার্থটি হাইড্রজেন এবং অক্সিজেন, এই দুই মৌলিক পদার্থ দিয়ে গঠিত। ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পানির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি থাকে, শূন্য ডিগ্রিতে বরফ হয়, ১০০ ডিগ্রিতে জলীয় বাষ্প হয়। অর্থাৎ এই অবস্থা পরিবর্তনে প্রয়োজন পড়ে তাপ যোগ অথবা বিয়োগের। আবার পানিতে তড়িৎবিশ্লেষণের মাধ্যমে, পানি থেকে এর দুটি মৌল অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনকে আলাদা করা যায়। এতো গেল প্রাকৃতিক ভৌত বিজ্ঞানের কথা, প্রাকৃতিক জীববিজ্ঞানও অনুরূপ, কত পর্যবেক্ষণ, কত নিরীক্ষণই না করা হয়। বৃহত্তর পরিসরে উদ্ভিদ এবং প্রাণী নিয়ে যেমন বিচার-বিশ্লেষণ, তেমনি আণুবীক্ষণিক পর্যায়ে জীবকোষ, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি নিয়ে।
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, কোষ, জীব সৃষ্টির ঊষালগ্নের তিন সহোদরা। কোষ পূর্ণতা পেয়েছে, কিন্তু ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া পূর্ণতা পায়নি। এ নিয়ে কোষের উপর কম ক্ষোভ নেই ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার। আর তাই এরা মাঝে মাঝেই আক্রমণ করে বসে কোষকে, তা উদ্ভিদের কোষই হোক অথবা প্রাণের কোষই হোক। যেমন করোনা নামক এক ভাইরাস বর্তমানে মানবকোষকে অস্থির করে ছাড়ছে। মানব জাতির জীবনে এমন বিপর্যয় কখনো আসেনি। এত অগ্রগতির পরেও মানবজাতিকে নাস্তানাবুদ করে ফেলছে। এই ছোট একটি ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে কত ধরণেই পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে মানবজাতিকে।
এখন একটি প্রশ্ন আসতেই পারে যে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার পরে করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে কি না? সম্ভব। এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস নিয়ে যে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপিত হয়েছে, তাতে যথাযথ পদক্ষেপে এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এর জন্য যে নিশ্ছিদ্র পদক্ষেপটি নিতে হবে, তা হল, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিশ্ববাসীকে বাড়িতে অবস্থান করা। বাড়িতে অবস্থান মানে বাড়িতেই অবস্থান। "যদি", "জরুরি প্রয়োজনে", এই শব্দগুলিকে পরিহার করতে হবে, অর্থাৎ কোনো প্রয়োজনেই কোনো ব্যক্তি বাড়ির বাইরে একটি পা-ও রাখতে পারবে না।
এক্ষেত্রেও প্রাকৃতিক কিছু বিধিবিধানের দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। চিনি ও জলের মিশ্রণ থেকে চিনি ও জলকে আলাদা করার পদ্ধতি হল মিশ্রণকে উত্তপ্ত করা। জল জলীয় বাষ্প হয়ে বেরিয়ে যাবে এবং চিনি পাত্রে থেকে যাবে। সংগৃহীত জলীয় বাষ্পকে শীতল করলে জলে রূপান্তরিত হবে। নির্দিষ্ট তাপ ও সময়ে মিশ্রণকে উত্তপ্ত করলে সম্পূর্ণ চিনি এবং জলকে আলাদা করা যাবে। কিন্তু প্রয়োজনীয় তাপ ও সময়ে যদি মিশ্রণকে উতপ্ত না করা হয়, তাহলে মিশ্রণ থেকে কিছুটা জলীয় বাষ্প পাওয়া যেতে পারে অথবা তাপমাত্রার পরিমাণ খুব কম হলে অনেকটা ক্যালোরি তাপ খরচ হলেও কোন জলীয়বাষ্পই উৎপাদন করা যাবে না। ক্যালোরি ব্যয় হবে কিন্তু কোনো ফলাফল পাওয়া যাবে না। আবার কিছুটা সময় যদি মিশ্রণকে উতপ্ত না করে রেখে দেয়া হয় এবং যদি মিশ্রণটি পূর্বে দেয়া তাপ হারিয়ে ফেলে, তাহলে পুনরায় তাপ দেয়া শুরু করলে মিশ্রণ নতুনভাবে উত্তপ্ত হতে শুরু করবে। আগে যে তাপ দেয়া হয়েছিল তার আর কোনো কার্যকরতা থাকবে না। অর্থাৎ আগের দেয়া তাপের সবটুকুই অর্থহীন হয়ে যাবে।
আবার আমরা জানি, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন, এই দুই মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে যে যৌগিক পদার্থ, তা হল পানি। আবার পানিকে তড়িৎবিশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন, এই দুই মৌলে আলাদা করা যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রক্রিয়ায়, এ্যানোড, ক্যাথোড, ইলেকট্রন গ্রহণ-বর্জন ইত্যাদিতে না গিয়ে, যা বলা যায়, তা হল, পূর্ণ ফলাফলের জন্য সঠিক সময় এবং পরিমাণমত তড়িৎ সরবরাহ করতে হবে।
অসম্পূর্ণ মাত্রার তাপ এবং তড়িৎ প্রবাহ যেমন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দেয় না, বরং সময় ও শক্তির অপচয় করে, তেমনি অর্ধ-লকডাউনও পূর্ণ ফল দেবে না, শুধু সময় এবং কর্মের অপচয় ঘটাবে। পূর্ণ-লকডাউনের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি পূর্ণ-লকডাউনের প্রয়োজনে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ সরবরাহেরও বিকল্প নেই। আর এই অর্থের জোগান যে রাষ্ট্র, আর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং ধনকুবেরদের সরবরাহ করতে হবে তা বলাই বাহুল্য।
এই দুর্যোগ মোকাবেলায় অর্থাৎ করোনা নিয়ন্ত্রণে যদি রাষ্ট্র, আর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং ধনকুবেরগণ যথাযথ ভূমিকা পালন করতে না পারেন, মাস তিনচারেকের জন্য জনগণের দায় নিতে না পারেন, তাহলে বিশ্ববাসী যৌক্তিক প্রশ্ন তুলতেই পারেন, কেন আমরা দেশে দেশে নতুন নতুন রাজা বানালাম? কেন আমরা রাজাদের পেছনে এত ব্যয় করলাম? কেন আমরা এত এত অট্টালিকা গড়লাম? কেন আমরা জাঁকজমকপূর্ণ বিচিত্র ধরণের পরিবহন তৈরি করলাম? কেন আমরা পোশাক, সাজসজ্জা, খাবার, ক্রীড়া ইত্যাদি নিয়ে এত পরীক্ষানিরীক্ষা করলাম? এই যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিশাল কর্মযজ্ঞ, তা কি এটাই ঠুনকো যে বিপর্যয়ের দিনে মাত্র কয়েক মাসের জন্য সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবে না? রাজারা কি রাজদণ্ড হাতে নিয়ে শুধুই শাসন করার জন্য?
আমরা ভুল করেছি, ভুল পথে হেঁটেছি। করোনা অনেক বার্তা দিয়েছে, এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হল, আমাদের জানাশোনার আলোকে আমাদের চারিদিকে যে বলয় তৈরি করে রেখেছি, তা ভুল একটি বলয়। নিশ্চয় করোনা আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবতে শেখাবে এবং অবশ্যই তা হবে সকল বিষয়েই–প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক, ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, সামাজিক, ইত্যাদি। "পূর্বের অভিজ্ঞতা ও পথে আমাদের বর্তমান সংকটের উত্তরণ ঘটবে"- আমরা যদি এমনটা ভাবি, তাহলে আমরা পুনরায় ভুল পথেই হাঁটতে থাবব।
পরিশেষে, আপনার কাছে এই আবেদন করছি যে আপনিও একজন বিশ্বনাগরিক হিসেবে প্রকৃতিবান্ধব সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নতুন এক বিশ্ব উপহার দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
ধন্যবাদান্তে,
আবু সাইয়ীদ
জনৈক বিশ্বনাগরিক