Published : 07 Mar 2020, 07:11 PM
আমার জন্ম আশির দশকে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ বিশ্বজুড়ে নানা ভাঙা-গড়ার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিগুলো চলছে। পৃথিবীর এক কোণে বাংলাদেশ। সেনা শাসনে বিপর্যস্ত 'তলাবিহীন ঝুড়ি'র তকমা মাথায় নিয়ে মাত্র কৈশোর পেরুচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে আমার প্রজন্ম। বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে কান্না, বেকারত্ব, দুর্নীতি, অপশাসন, দু:শাসন, আয় নেই, খাবার নেই, মূল্যবোধ ক্ষয়িষ্ণু। কৈশোরের বাংলাদেশে তখন ৭ই মার্চ নিয়ে গৌরব হয় না, প্রশ্ন হয়, বিতর্ক হয়। ইতিহাস এরইমধ্যে অন্যপথে এগিয়ে গেছে অনেকটা। আমরা যারা বড় হচ্ছি, বেড়ে উঠছি – বিষিয়ে যাচ্ছে আমাদের মন-চিন্তা।
এরপর এলো ১৯৯০ এর সেই সব মুহূর্ত। না, আমি দাবি করছি না, আমার সব স্পষ্ট মনে আছে, বয়স কতোই বা, মাত্র স্কুল নামক প্রতিষ্ঠান চিনতে শিখছি। নব্বইয়ের নভেম্বর – ডিসেম্বর জুড়ে কারফিউ। গলিতে গলিতে সেনা টহল। থাকতাম ঢাকার মিরপুরে। মনে আছে, স্বৈরাচার পতনের ওই দিনগুলোতে মেইন রোড ফাঁকা, গাড়ি নেই, আমরা ফুটবল খেলতাম, খেলতাম ক্রিকেট।
হ্যাঁ ক্রিকেট, তখনও দেশে খুব একটা জনপ্রিয় নয়, যতোটা দাপট ছিলো ফুটবলের। আমরা পেয়েছি সেই আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথের মুহূর্তগুলো! ১৯৮৬ তে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের আবির্ভাব। সেই আশির দশক। কারা খেলতো ক্রিকেট, সবাই তো নয়। তখনতো ভাবনাতেও আসেনি তিরিশ বছর পর এই খেলাটাই দেশের তারুণ্যকে প্রতিনিধিত্ব করবে। বাংলাদেশ আসছে ২৬শে মার্চে ৪৯ বছর পূর্ণ করে ৫০-এ পা দেবে। মাত্র অর্ধশতাব্দির এই বাংলাদেশে ক্রিকেটই এখন সবচেয়ে বড় ক্রেজ (পাগলামি হয়তো এর একটি বাংলা রূপ হতে পারে) ।
আশির দশকের সেই ক্রিকেটের সাথে হাতে হাত ধরেই আশির প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। পথ খুব মসৃণ ছিল না এই বেড়ে ওঠায়। খুব ভালোভাবে লালন-পালন হয়নি, না আক্ষেপ নয়, বাস্তবতা- অভিভাবকের সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু ক্রিকেট বেড়ে উঠেছে, বড় হয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এখন সে পরিণত যুবক। পরিণতি আমাদের প্রজন্মেরও অনেকটাই একই। যে দেশ ছিল তলাবিহীন ঝুড়ি, বাজেটের অর্ধেকের বেশি ছিল বিদেশি সাহায্য নির্ভর, ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্ব দরবারে ঘুরতে হতো- সে দেশ এখন উদাহরণ। একাত্তরে শরণার্থী হওয়া কোটি মানুষের দেশ এখন অন্তত লাখো শরণার্থীর দায়িত্ব নিতে পারে নির্দ্বিধায়। ক্রিকেটের বাংলাদেশ হয়েছে গার্মেন্টসের বাংলাদেশ, হয়েছে শান্তিরক্ষীর বাংলাদেশ, হয়েছে প্রায় পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ- অর্জন বাড়ছে। আর এই অর্জনে আশির দশকের আমরাই অগ্রপথিক, শ্রমিক, চালিকাশক্তি।
দেশ যখন ১৯৯১ এ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরলো, বাড়লো ফেরেববাজি। অর্থনীতির দরজা খুলতে লাগলো, বাড়তে লাগলো দুর্নীতির দোকানগুলোও। মূল্যবোধ, নীতি, সততা, নিষ্ঠা, বিনয়- হায় হায়! প্রতিযোগিতার দৌঁড়ে সবার আগে দৌঁড়ে চললো ঘুষ আর স্বজনপ্রীতি। বাংলাদেশ তখন মাত্র তারুণ্যে, আর আমরা শৈশবে। দেশে মাদক যতোটা আমাদের প্রজন্মকে ক্ষয় করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষয় হয়তো সেই ইতিহাস বিকৃতি আর সমাজের একশ্রেণির লম্পটের কুচ্ছিত লুটপাটের প্রতিযোগিতার ফসল। আমাদের অবশ্যই দোষ দেবেন, ছেড়ে দেবেন না, কিন্তু শুধু নিজেদের দোষে আমরা পুরোটা বখে যাইনি। ইতিহাস সাক্ষী। আমরা লড়েছি, লড়ছি- আজকের বাংলাদেশের নির্মাণ আমাদের হাতেই। তাই, এর ক্ষয়, লয়, পরাজয়ের দায় নিতে রাজি আছি – কিন্তু এর নিয়ন্তা এখনও আমরা নই, ছিলাম না, এটাই বাস্তবতা।
আমরা যারা আশির প্রজন্ম, আমাদের হাতে নেতৃত্ব ছিল না- রাজনীতিকে দুমড়ে-মুচড়ে সেই পথ এতোটাই নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল যে হাঁটতে খুব সাহস দরকার ছিল। অনেকেই চেষ্টা করে হারিয়ে গেছেন- ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। আমরা যারা দেশের চেহারা গড়ছি, তাদের পুতুল করে রাখার, বাক্সবন্দি করবার ফিকিরও সমান তালে চলেছে। সেই চেষ্টা শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়েছে ব্যবসায়, চাকরিতে, শিক্ষায়, এমনকী খেলায়। হ্যাঁ ক্রিকেটেও।
৬ মার্চ মাশরাফি তার নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেন, বিদায় নিলেন অধিনায়কের পদ থেকে। মাশরাফির বিদায় এক মাহেদ্রক্ষণ- একটি টার্নিং পয়েন্ট, অন্তত আমার কাছে। কারণ মাশরাফি আমার প্রজন্মের, আমার ক্যাপটেন। অধিনায়ক দেখিয়েছেন, কেমন হয় অধিনায়কত্ব। কি তার রঙ, কি তার ঢঙ, কি তার গুরুত্ব, আর কখন তা মলিন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এর আগের অধিনায়কেরাও কম ছিলেন না। কিন্তু মাশরাফি আলাদা হয়ে গেলেন, কেন? কেন তাকে ঘিরে এই উন্মাদনা, এই আবেগ- কারণ আমরা আশির প্রজন্ম।
একজন মাশরাফি– একটি বাংলাদেশের পথ চলার সাক্ষী, বেড়ে ওঠার সাক্ষী– খেলোয়াড় থেকে অধিনায়ক, অত:পর রাজনীতির মাঠে। এই পথ পরিক্রমা শুধুই ব্যক্তি মাশরাফির পরিণত হয়ে ওঠার গল্প নয়, আমার কাছে এটা বাংলাদেশের বেড়ে ওঠার গল্প-হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, পরাজয়-আপস-ত্যাগ আর অর্জনের গল্প। এখানে যেমন প্রাপ্তির সুখ-গর্ব আছে, তেমনি আছে হতাশা আর নুয়ে পড়ার আখ্যান। এখানেই মাশরাফির গল্পটি অনন্য- অনন্য বাংলাদেশ কারণ বারবার ভেঙে পড়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার এই মানসিকতা এতোটা স্পষ্ট আর কেউ হয়তো প্রতিফলিত করতে পারেনি। এটাই তো আমাদের প্রজন্মের চরিত্র – এটাই মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা – ধারাভাষ্যকারের ভাষায় 'ক্যাপটেন ফ্যানটাসটিক'! তোমাকে অভিবাদন ক্যাপটেন।
পুনশ্চ: প্রিয় বাংলাদেশ- তোমার আরও মাশরাফি চাই, তুমি এখন দারুণ দোলাচলে – তোমার দেখভালের জন্যই মাশরাফিদের জায়গা করে দিতে হবে, তাদের ওপর ভরসা করতে হবে, তাদেরকে ক্যাপটেন বানাতে হবে। জয় বাংলা।
ক্রিশচিয়ানসান্ড, নরওয়ে ০৬.০৩.২০২০