Published : 01 Jan 2020, 05:20 PM
ফসলের হাসি সত্ত্বেও কৃষকের মুখ মলিন থাকে যে দেশে, তার নাম বাংলাদেশ। অবশ্য বিশ্ববাজারে উন্নয়নের 'রোল মডেল' হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা বাংলাদেশের সঙ্গে কৃষকের 'বাংলাদ্যাশে'র সাদৃশ্য নামকা-ওয়াস্তে। উন্নয়নশীল দেশের ট্যাগ ঝোলানো এই বাংলাদেশের আড়ালে পড়ে থাকা সেই 'দ্যাশে'র খবরও থাকে অগোচরে। 'ঈশ্বরবিহীন' সেই দ্যাশের বাসিন্দা কৃষকসহ শ্রমিক-মজুর, জেলে, কামার-কুমারের দুঃখ-দুর্দশা-বঞ্চনাও তাই ঘোচে না কখনো। চির গরিবীর সেই জনপদের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী কৃষকের কোমর গেল বোরো মৌসুমে ভেঙে গেছে। এবার আমনের মৌসুমে সেই ভাঙা কোমরে কষে আরেক দফা বাড়ি দেওয়ার ইন্তেজাম পাক্কা!
কৃষি অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, মণপ্রতি এবার ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৮৫০ টাকা। অথচ এখন বাজারদর ৬০০ টাকার মতো। অর্থাৎ প্রতি মণ আমনে কৃষকের লোকসান গুণতে হচ্ছে ২৫০ টাকা।
হাতে হাতে মুঠোফোনের বিপ্লব ঘটানো ডিজিটাল বাংলাদেশেও কৃষিতে জড়িত ৬০ ভাগের বেশি মানুষ। জিডিপিতে কৃষির হিস্যা ১৪ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানের নির্যাস হলো খাদ্যঘাটতির দেশ আজ খাদ্যে স্বাবলম্বী। সরকারও এই কথাটি নিজের ঢাকের কাঠি করে ছেড়েছে। অথচ বছরের পর বছর ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া এবং কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিই যেন নিয়তি কৃষকের। জমির বর্গা খরচ, বীজ, সার, মজুরের পারিশ্রমিক, সেচ, কীটনাশক ইত্যাদি খরচের পর লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষককে। এর ওপর আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মার। তবু অকাতরে আমাদের খাদ্যের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন তারা, যার 'সনদ' দিয়েছে স্বয়ং বিশ্বব্যাংকও। পুঁজিবাদী বিশ্বের মনপছন্দ প্রতিভূ এই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, পরপর কয়েক বছরের বাম্পার ফলনে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে; খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে সরকারের নীতিগত সমর্থন-সহযোগিতা, ভর্তুকির বিষয়টিও এখানে আমলযোগ্য। সরকারও তাই এমন সনদ পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। কেবল কৃষকের জীবনধারণ দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
গেল বোরো মৌসুমে দেশের কোথাও কোথাও ক্ষোভে-দুঃখে কৃষক খেতে আগুন পর্যন্ত দিয়েছিলেন। সরকারের তরফে তখন ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেমন বাড়তি চাল বিদেশে রপ্তানি করা হবে, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা হবে ইত্যাদি। উন্নয়ন-অগ্রগতির ফিরিস্তি মুখস্থে ব্যস্ত সরকার হয়তো তার মুখনিসৃত এসব কথা ভুলে গেছে! চাল রপ্তানির খবর নেই। সরাসরি ধান কেনার কার্যক্রমের তুলনা চলে কেবল শম্বুকগতির সঙ্গে। আমন মৌসুমে ৬ লাখ টন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত খাদ্য অধিদপ্তর কিনেছে মাত্র সাড়ে ৪১ হাজার টন।
দেশের অর্থনীতিতে পুষ্টির জোগানদাতা কৃষি খাতের দুর্দশা এখানেই শেষ নয়। প্রথমবারের মতো করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিএসএস) কৃষি ও পল্লী পরিসংখ্যান প্রতিবেদন বলছে, বারো মাস রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দেশের সাড়ে ৭৭ লাখ কৃষিশ্রমিক মাথাপিছু হিসাবের চেয়ে দৈনিক ৫২ টাকা কম রোজগার করেন। দেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৬০ হাজার ৬০ টাকা। এই হিসাবে প্রত্যেকের দৈনিক আয় ৪৩৮ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে শীত-গরম-বন্যা-খরায় সমান শ্রম দেওয়া কৃষিশ্রমিকের গড় মজুরি ৩৮৬ টাকা। এর মধ্যে নারী কৃষিশ্রমিকের আয় গড়ে আরও ৪২ টাকা কম। গাঁওগেরামের এই লৈঙ্গিক অসাম্যের চিত্র করপোরেট বাংলাদেশ থেকে উধাও, এ কথা অবশ্য বলার জো নেই।
বিএসএস এর হিসাবে, দেশের পল্লী এলাকায় কৃষিখাতে জড়িত ২ কোটি ৪৩ লাখ মানুষ। এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ সাড়ে ৭৭ লাখ শ্রমিক, আর ৮১ লাখ মানুষ নিজের জমিতে চাষাবাদ করেন। বাকিরা নানাভাবে কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট নানা কাজকর্মে যুক্ত। কিন্তু তাদের কারোর অবস্থাই সুবিধার নয়, যতটা সুবিধায় অর্থনীতি। দিন দিন যতটা পুষ্ট হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, ততটাই যেন অপুষ্ট হচ্ছেন কৃষক, কৃষিশ্রমিক।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি টাকায় নির্মাণের রেকর্ড গড়া মহাসড়ক, সুন্দরবনের নাসারন্ধ্র বুজিয়ে নির্মিতব্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, সোনার জলে চোবানো বালিশসহ মহামূল্যের বিছানাপত্রের কারণে এরই মধ্যে বিশ্বের মনোযোগ কাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বড় বড় খবরে হারিয়ে যান কৃষক। আমরা অস্ত্র আমদানিকারক শীর্ষ ২০ দেশের একটি। আমাদের আছে রাশিয়ান মিগ, চীনা ফাইটার জেট, সাবমেরিন। এর বিপরীতে কাস্তে-কোদাল, লাঙল-মই— কোনো তুলনাই চলে না!
নিজেদের স্যাটেলাইটে সম্প্রচারিত টেলিভিশনের পর্দায় পর্দায়, খবরের কাগজে, অনলাইন নিউজ পোর্টালসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরতে পরতে সমুদ্রজয়, পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল…। সরকারের সব পর্যায়ের হর্তাকর্তাদের মুখেও ঘুরেফিরে এসবেরই বয়ান-বিবৃতি। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও তারস্বরে উন্নয়নের জয়গানে মুখর।
কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিতে (কুইকেস্ট গ্রোইং) পয়সাওয়ালার দেশও যে বাংলাদেশ, এই কথাটি ততটাই অনুচ্চ থাকে। গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। গ্লোবাল ইন্টেগ্রিটির এই হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের রেকর্ড বাজেটের চেয়েও অংকটি বড়। বিএসএস এর সর্বশেষ হিসাবমতে, দেশের ৩৮ শতাংশ সম্পদ রয়েছে মাত্র ১০ ভাগ মানুষের কবজায়। আর সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের হাতে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ।
দেদার অর্থপাচার, ব্যাংক লুণ্ঠন, পুঁজিবাজারে নয়-ছয়, ক্রমবর্ধমান প্রবল আয়বৈষম্যের দেশে খেলাপি ঋণ তাই লাখ কোটির ঘর ছাড়িয়ে যাওয়ায় অবাক হয় না কেউ! পুরনো বছরের বিদায়লগ্ন বা নতুন বছর বরণের আবহ— সময় যা-ই হোক, কৃষকের দুর্গতি-দুর্দশাও যেভাবে কাউকে নাড়া দেয় না আর…