Published : 24 Dec 2019, 06:08 PM
আবারও উত্তপ্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । ভিপি নূরকে বেধড়ক মারের ছবিতে সামাজিক মিডিয়াসহ দেশি মিডিয়া সয়লাব। বলা হচ্ছে, 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ' নামের সংগঠনের তরফ থেকে এ হামলা চালানো হয়। 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ' এর দাবি- 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত বিশেষত মৌলবাদী সংগঠনের ছাত্র নিয়ে এসে পরিস্থিতি অশান্ত করার অপচেষ্টা রুখে দেওয়া হয়েছে।'
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "দুপুর ১২টায় রাজু ভাস্কর্যে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ তাদের পূর্বনির্ধারিত একটি কর্মসূচি শেষ করে ডাকসু ভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যায়। একপর্যায়ে সেখানে ভিপি নূরসহ তার অনুসারীদের সঙ্গে মঞ্চের নেতাকর্মীদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পরে মঞ্চের কিছু নেতাকর্মী নূরদের লক্ষ্য করে ইট ছুড়তে থাকে। মঞ্চের কিছু নেতাকর্মী ডাকসু ভবনের দ্বিতীয় তলায় উঠতে থাকলে নুরের অনুসারীরা তাদের প্রতিহত করে ডাকসু ভবনের মুল ফটক বন্ধ করে দেয়। এরপর ঘটনার সূত্রপাত।"
যাই ঘটুক, আর যেভাবেই ঘটুক, আমরা কিন্তু একের পর এক ছাত্রলীগ কিংবা তার বন্ধু সংগঠনগুলোর নামে অপবাদ আর ভয়াবহ সব নৃশংসতার খবর পাচ্ছি। একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অশান্ত। সেটা কয়েকদিন পরপর টের পাই আমরা। যার মানে ছাত্রসমাজের ভেতর অশান্তি বিরাজমান। এ অশান্তি কেন?
নূর ভোটে জিতে আসা ভিপি। স্বীকার করতেই হবে একমুখী সব কিছুর ভিড়ে তার এই জয় নি:সন্দেহে ব্যাপক। এবং সে তা অর্জন করে দেখিয়েছে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার দেখা হবার খবর এবং গল্প পড়েছি। ছবি দেখে মনে হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্নেহই কুড়িয়েছে নূর। এই যে এই ঘটনার পর তার আহত হওয়া এবং হাসপাতালে যাওয়া, সেখানেও প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য বোধ আর আন্তরিকতা স্পষ্ট। তিনি শীর্ষ দুই নেতা নাসিম ও নানককে পাঠিয়েছেন খবর নিতে। তারপরও কাদের এ আক্রোশ? এবং তা এতো উগ্র কেন?
ভুলে গেলে চলবে না ঢাকার রাজপথে দর্জি যুবক খুন হবার ঘটনার দায়ও ছাত্রলীগের। বুয়েটে র্যাগিং এর নামে যে অস্বাভাবিক আচরণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ড, তার ফুটেজের দাগ এখনো মেলায়নি। তারপর আবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। আর এখন ডাকসুর ঘটনা। হচ্ছেটা কি? কেন এ বেপরোয়া মনোভাব? আমরা কি জানি না সরকারী দল মানেই প্রতাপশালী। আর এই বীরত্বের কারণ প্রশাসন ও বাহিনী। কিন্তু কোনওকালে তা শেষ পর্যন্ত কাউকে কি আসলেই নিরাপদ রেখেছে?
আজ যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শক্ত হাতে দেশ শাসন করে সকলকে সাথে নিয়ে অগ্রগতির পথে ধাবমান তখন কারা তাকে পেছন থেকে টেনে ধরছে? এ মনোভাব তো রাষ্ট্র এবং সরকারের জন্য একেবারেই অনিরাপদ। সাথে আছে ভয়াবহ ভবিষ্যতের কালো হাতছানি। যারা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী তাদের মনে যে সংশয় আর ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে তার মূল্য চুকাবে কে? ছাত্রলীগের নামধারী হোক আর ছাত্রলীগ-ই হোক দায়িত্ব এড়ানোর সময় শেষ। যেসব ছবি আর খবর আসছে মিডিয়ায় সেসব দেখার পর আতঙ্কিত হওয়ার বিকল্প কোথায়?
ঘটনায় আহত ফারাবীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তিনি চোখ খুলে তাকিয়েছেন। তাকে এখনও লাইফসাপোর্টে রাখা হয়েছে। এই শিক্ষার্থীকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান সোমবার জানান, সকাল ৮টার দিকে তুহিন ফারাবী চোখ মেলেছিলেন। কিছুক্ষণ পর আবার চোখ বন্ধ করেন। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরের অবস্থা আগের মতোই আছে।
একজন পিতা হিসেবে বা অভিভাবক হিসেবে আমি যখন এ খবরগুলো পড়ি আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। এরা কে কোন্ দল করে, কেন করে- সেসব প্রশ্ন বড়? নাকি তাদের জীবন বড়? এ পৈশাচিকতা বিশেষত বাতি নিভিয়ে অন্ধকার করে তারপর পেটানোর ভেতর দুটো বিষয় আছে।
প্রথমত, এতে নৃশংসতা বাড়ে। তারপর হলো নিজেদের আড়াল করা। অন্ধকারে ক্যামেরা ধারণ করলেও মুখ বা পরিচয় আড়ালে থেকে যাবে এই হয়তো ভাবনা।
ভাবুন একবার, ছাত্ররা পড়তে এসেছে। মা বাবা তাদের পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছে। সেখানে এ কী ধরনের পাগলামি? পাগলামি যখন নেশায় পরিণত হতে চলেছে তখন এর লাগাম টানা জরুরি।
ছা্ত্রলীগের সুনাম বা অহংকার এখন বিলুপ্ত প্রায়। ষড়যন্ত্র বলে পার পাওয়া যাবে না। কারণ আমরা আগেও এমন দেখেছি। মনে রাখা দরকার, একসময় ছাত্রদল বাকিদের মেরে ঠাণ্ডা করার নীতি নিয়েছিল, তারা আজ কোথাও নাই। সময় এমনই। যে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। আমাদের ভয় এভাবেই একদিন সময় তাদের বিপরীতে যাবে। আর তখন হাজার চেষ্টা করলেও ঘর সামলানো মুশকিল হয়ে উঠবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের রাজধানীর বুকে থাকা একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে ঘিরে আছে অজস্র ইতিহাস। যার একপাশে শহীদ মিনার। যার চারদিকে মুক্তিযুদ্ধের অম্লান সব স্মৃতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব নষ্ট করার অধিকার নাই কারও। প্রমাণ আছে যারা তার চেষ্টা করেছে তারাই পড়েছে সময়ের তোপে। একসময়কার এনএসএফ বা পরবর্তীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও এর স্পিরিট বা চেতনা রোধ করতে পারে নি। এতসব জানার পরও সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের নামে এত মারামারি সহিংসতার উৎস কোথায়? ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে যদি লাইট নিভিয়ে এভাবে কাউকে মারা সম্ভব হয় তো, দেশের বাকি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হতে পারে? এসব ভাবনা এখন অভিভাবকদের মনে ভিড় করছে।
মানুষ মুখ খুলছে না ঠিকই। কিন্তু তাদের মন তো কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। মনের ভেতর গুন্ডামি-মারামারি-হত্যা আর নৃশংসতার যেসব ছবি দাগ ফেলেছে তা মোছা কি খুব সহজ হবে? সবাই মানেন রাজনীতি, বিশেষত ছাত্র রাজনীতি কখনো কখনো কতটা নির্মম হতে পারে।
সে নির্মমতার অভিশাপ এড়াতেই তো আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। আজ আমাদের জাতি যখন নানা দিকে উদ্ভাসিত তখন দেশের ভেতর ক'দিন পর পর এমন সব ঘটনা তাও কিনা 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ' এর নামে কিসের আলামত বহন করে? 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ' নামটির ভেতর যে পবিত্রতা আর আবেগ তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা এটি? কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের নীল নকশা? লাল-নীল যে নকশাই হোক এগুলো বলেও কিন্তু পার পাওয়া যাবে না আর। মানুষের ক্রোধ পুঞ্জিভুত হচ্ছে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ঘৃণার আগুন যেন মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র নাম স্পর্শ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে দায়ী সব নেতা কর্মীদের বিচার ও শাস্তি দেওয়া জরুরি। 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ' এর নামে এমন আস্ফালন আর নিপীড়ণে যদি তার গৌরব নষ্ট হয় আমাদের আর কী থাকে? এটাও বুঝবো না আমরা?
অচিরেই এর বিহিত করা হোক। করাটা কঠিন না। যদি 'গড ফাদার' আর ষড়যন্ত্রকে রুখে দাঁড়ানো যায়, 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চে'র নামে মুক্তিযুদ্ধের অপমানও রোধ করা যাবে। দেশের তরুণ প্রজন্মের ভেতর এমনিতেই ইতিহাস বিকৃতি আর ঝামেলার শেষ নাই। তার ভেতর এই আগুন কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের? ভাবনার দরজাটা খুলুন এবার। বিজয়ের মাসে 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ' এর নামে এ অনাচার আর ভয়াবহতা বন্ধ হোক।