Published : 10 Oct 2019, 12:02 AM
প্রতিবছর ১০ অক্টোবরকে 'বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য 'মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ'।
আমাদের জীবন সবসময় একই গতিতে, একইভাবে চলেনা। কখনও আমরা সুখকর অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাই, কখনো বা দিন কাটে তীব্র মানসিক যাতনায়। এই যাতনা বা কঠিন সময়ের প্রতি সবার প্রতিক্রিয়া একইরকম হয়না। কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রেখে যেকোন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন হয় আবেগীয় বুদ্ধির (emotional Intelligence)। অর্থাৎ আবেগীয়ভাবে বুদ্ধিমান একজন ব্যক্তি নিজের আবেগ সঞ্চালনার দক্ষতা (Emotion regulation skills), মানসিক দক্ষতা (Mind skills) ও সামাজিক দক্ষতা (social skills) প্রয়োগ করে কঠিন পরিস্থিতিকে সামলে নেয়। অন্যদিকে এসব দক্ষতার ঘাটতি থাকলে কঠিন পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় আত্মহত্যার মত ভুল পথও বেছে নেয়। কেননা সেই মুহূর্তে কষ্ট থেকে মুক্তির আর কোন পথ তার জানা থাকে না। তাই কেউ কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপির জন্য এলে, আমরা একদিকে যেমন তাদের অতীতের কষ্টকর স্মৃতি বা অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে কাজ করি, অন্যদিকে বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য বেশ কিছু দক্ষতা অর্জনে সহযোগিতা করি। কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপির জন্য বিভিন্ন ধরনের টেকনিক বা অ্যাপ্রোচ আছে। মাইন্ডফুলনেস (মনোযোগিতা) তেমনই এক ধরনের টেকনিক যা অন্যান্য টেকনিকের সাথে বা আলাদাভাবেও কাউন্সেলররা ব্যবহার করে।
মাইন্ডফুলনেস বা মনোযোগিতা হলো 'বর্তমানে' বা 'এখন, এখানে' কী ঘটছে সে ব্যাপারে সজাগ ও সচেতন থাকার দক্ষতা। অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত মনকে অতীত ও ভবিষ্যতের ভাবনা থেকে বর্তমানে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াই হল মনোযোগিতা। মনোযোগিতার মাধ্যমে একদিকে যেমন আমরা নিজের শরীর ও মনে কি ঘটছে তা বুঝতে পারি, অন্যদিকে নিজেকে বর্তমানে কেন্দ্রীভূত করে প্রাণোচ্ছল ও কর্মদীপ্ত জীবনযাপন করতে পারি।
কোন একটা পরিস্থিতিতে ইতিবাচক, নেতিবাচক, বা নিরপেক্ষ যা কিছুই ঘটুক না কেন, সেই মুহূর্তে সজাগ ও সচেতন থাকার মধ্য দিয়ে আমরা পরিস্থিতিটিকে মোকাবেলা করতে পারি। যেমন- বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, রাগ, ভয় নানা ধরনের অনুভূতি ও আচরণগত বিষয় নিয়ে ক্লায়েন্টরা আমাদের কাছে আসে। যার পরীক্ষা ভীতি আছে, সে চাইছে এই ভীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে। এবং তা করার জন্য হয়ত ইতোমধ্যে সে এই ভীতি বা ভয়ের অনুভূতিকে দমিয়ে রাখার নানা চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। যতই সে এই ভয়কে দমন করার চেষ্টা করছে, তা আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। এক্ষেত্রে একটি কার্যকরী উপায় হল নির্ভয়ে 'ভয়ের' ভেতরে ঢুকে ভয়কে জয় করা! অর্থাৎ ভয়কে দমন-পীড়ণের চেষ্টা না করে বরং কিছুক্ষণের জন্য এই অবস্থাকে গ্রহন করে তাতেই মনোনিবেশ করা। সুখ, দুঃখ, রাগ, ভয় প্রতিটি অনুভূতিরই কিছু শারীরিক প্রতিক্রিয়া বা সংকেত থাকে। ভয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত আমাদের গলা শুকিয়ে যায়, বুক ধড়ফড় করে, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, হাত পা কাঁপে, ঘাম হয় ইত্যাদি। তাই পরীক্ষার কথা মনে হলে, বা পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলে বা অন্যদেরকে পড়তে দেখে ভয় লাগলে, তা এড়িয়ে না গিয়ে সেই মুহূর্তে ভয়ের শারীরিক প্রতিক্রিয়াগুলো খেয়াল করলে ধীরে ধীরে সেগুলোর তীব্রতা কমে আসবে ও আরাম লাগতে শুরু করবে। অর্থাৎ আমার ভয় লাগছে, এই ভয়ের কারণ, পরিনাম, ভাল-মন্দ ইত্যাদি চিন্তা না করে, সেই মুহুর্তে শুধুই নিজের ভেতরে কি ঘটছে তাতে মনোনিবেশ করলে আপনা-আপনিই ভয় কেটে যাবে। আর ভয়ের অনুভূতি ফিকে হলেই কিন্তু পড়ালেখায় মনোনিবেশ করা সম্ভব হবে।
অতীতের বোঝা কাঁধে নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে অবিরাম ছুটে চলার এই অনন্তযাত্রায় বর্তমানের মুহূর্তগুলো যেন হারিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে আমাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। তাই এখন, এখানে, এই মুহূর্তে কি ঘটছে কোন রকম মূল্যায়ন বা ভালমন্দ বিচার ছাড়া তাতে মনোযোগী হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে পারি। এই মনোযোগিতার প্রক্রিয়ায় অসংখ্যবার মনোযোগ ছুটে যেতে পারে, তাতে সমস্যার কিছু নেই। বরং কতবার মনোযোগ ছুটে যাচ্ছে সেই ব্যাপারে সজাগ থেকে পুনরার মনোযোগী হওয়াও মনোযোগিতার অংশ।
আপাত দৃষ্টিতে মনোযোগী হওয়াকে সহজ মনে হলেও বেশিরভাগ সময়ই আমরা মনোযোগী থাকি না। যা ঘটছে তা নিয়ে বিভিন্ন রকমের চিন্তা, মতামত, মূল্যায়নের ভারে আমরা অমনোযোগী হয়ে থাকি। আমাদের অমনোযোগিতার কিছু উদাহরণ হল- নির্বিকারে কোন কাজ করা, অর্থাৎ মনোযোগ সেই কাজে নয়, অন্য কোথাও অন্য কোন কিছুতে
ক. নির্বিকারে কোন কাজ করা, অর্থাৎ মনোযোগ সেই কাজে নয়, অন্য কোথাও অন্য কোন কিছুতে
খ. অমনোযোগিতা বা অসাবধানতাবশত কিছু ভেঙে ফেলা, নষ্ট করা, ভুল কথা বলা, বা ভুল কাজ করা
গ. নিজের ভেতরে কি ঘটছে বা কি ধরনের অনুভূতি হচ্ছে তা সনাক্ত করতে না পারা
ঘ. কারো নাম জানার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই তা ভুলে যাওয়া
ঙ. অতীত বা ভবিষ্যতের ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকা
চ. খাওয়ার সময় কি খাচ্ছি সেদিকে খেয়াল না রাখা
অন্যদিকে মনোযোগিতা হল বর্তমানে কী করছি, কী খাচ্ছি, কী অনুভব করছি তাতে মনোনিবেশ করা। অর্থাৎ মনোযোগিতার বিশিষ্টগুলো হল-
ক. কোনরকম চিন্তাভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া শুধুই পর্যবেক্ষণ
খ. অভিজ্ঞতার মাঝে ডুবে যাওয়া
গ. মুহূর্তগুলোয় সজাগ থেকে কষ্টকর অনুভূতি থেকে মুক্তি
মনোযোগিতার চর্চা: মনোযোগিতার বিভিন্ন স্তর বা ধাপ রয়েছে। কাউন্সেলিং সেশনে সাধারণত সহজ চর্চা দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে গভীর পর্যায়ে যাওয়া হয়। তবে যে কেউ যেকোন মুহুর্তে এর চর্চা করতে পারে। এমনকি সপ্তাহের সবচেয়ে বিক্ষিপ্ত ও ব্যস্ততম দিনেও আমরা কিছু সময়ের জন্য মনোযোগিতার চর্চা করতে পারি।
চর্চা ১- নাক দিয়ে গভীর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়া, মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা নিঃশ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার সময় নাকের ডগায় কেমন অনুভূতি হচ্ছে। বুক ও পেটের ওঠানামাও খেয়াল করা। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করা- 'এই মুহুর্তে আমি কি অনুভব করছি?', 'এই মুহুর্তে আমি কি করছি?', 'এই মুহুর্ত থেকে আমি কি আস্বাদন করছি?'।
চর্চা ২- মনোযোগী আহার: খাওয়ার সময় অন্য কোন কিছুতে নিজেকে ব্যস্ত না রেখে পঞ্চ ইন্দ্রিয় (চোখ, নাক, কান, জিহ্বা, ত্বক) দিয়ে খাওয়া। অর্থাৎ খাবারের রঙ, ঘ্রাণ, স্বাদ, হাত বা জিহ্বার সাথে সংস্পর্শ ও শব্দ সবকিছু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা।
চর্চা ৩- মনোযোগী হাঁটা: ধীরে ধীরে কিছু সময়ের জন্য হাঁটা ও অনুভব করা।
চর্চা ৪- মনোযোগী স্নান: কিছুটা সময় নিয়ে গোসল করা। পানির শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ খেয়াল করা। সাবান বা তোয়ালার ঘ্রাণ ও স্পর্শ অনুভব করা।
চর্চা ৫- জরুরী অবস্থায়: ভয়, কষ্ট, রাগ বা অন্য কোন কঠিন অনুভূতির মুহূর্তে শারীরিক পরিবর্তনগুলো একে একে খেয়াল করা। শরীরের সবচেয়ে অস্বস্তিকর অনুভূতির অংশটা সবার আগে খুঁজে বের করা ও কিছুক্ষণের জন্য তাতে মনোনিবেশ করা। শরীরের বিভিন্ন অংশে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে কিছুটা আরাম বোধ করলে স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসে মনোযোগ দেওয়া। তারপর ১ থেকে ৫ গুনতে গুনতে ধীয়ে ধীরে চোখ খোলা। সাধারনত পুরো চর্চাটি ৩-৫ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়।
অতীতকে অস্বীকার করার বা ভবিষ্যতকে অবহেলা করার কোন যৌক্তিকতা বা প্রয়োজন নেই। আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেব এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করব সেটাই বরং স্বাভাবিক। কিন্তু মত্রাতিরিক্ত অতীত ভ্রমণ ও ভবিষ্যৎ ভাবনা থেকে নিঃসৃত হয় মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা। তাই মনোযোগিতার চর্চা আমাদের সহযোগিতা করতে পারে বর্তমানে মনোনিবেশ করে জীবনকে উপভোগ করতে, জীবনের সমস্যাগুলো অনুধাবন করতে, কেমন আছি তা জানতে ও সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে।